নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত-
ড. সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী >
উপরোক্ত শিরোনামটি পবিত্র কুরআনের আয়াত- إِنَّكَ لَعَلىٰ خُلُقٍ عَظِيمٍ
তরজমা: নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত। [সূরা কলম, আয়াত-৪]
এ আয়াতে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সুমহান চরিত্র বর্ণিত হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জীবন মানবসভ্যতার জন্য অনুপম উপহার। প্রতিটি মানুষের জন্যই তাঁর জীবন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে বর্বর আরব জাতির আস্থা অর্জন করেছিলেন। ফলে সবাই তাঁকে ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল। দুনিয়ার মানুষকে তিনি অর্থ বা প্রভাব-প্রতিপত্তির দ্বারা বশীভূত করেননি। বরং স্বভাবজাত উত্তম ব্যবহার দিয়ে বশীভূত করেছিলেন।
সমাজে যে যতটুকু মর্যাদার অধিকারী তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করতেন তিনি। সাহাবায়ে কেরামকে নম্র ও সুন্দর ব্যবহারের উপদেশ দিতেন। অযথা ক্রোধ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন। মানুষকে তিনি কখনও তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সাথে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। অন্য ধর্মের লোকেরাও তাঁর কাছে সুন্দর ও কোমল আচরণ লাভ করত। তাঁর নমনীয়তা ও কোমলতার কারণে সাহাবি ও অমুসলিম সবাই তাঁকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো।
তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহংকার, পরোপকারী, সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ মহামানব। মন্দের প্রতিবাদ তিনি মন্দ দিয়ে করতেন না, বরং মন্দের বিনিময়ে উত্তম আচরণ করতেন। তিনি ক্ষমাকে প্রাধান্য দিতেন। তিনি সব সময় মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন ও সদালাপ করতেন। তার মধুর বচনে সবাই অভিভূত হত। তার অভিভাষণ শুনে সাধারণ মানুষ অশ্রু সংবরণ করতে পারত না।
‘খুলুক শব্দটির বহুবচন اخلاق। আভিধানিক অর্থ ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, স্বভাব, জন্মগত স্বভাব প্রভৃতি’।( )
আর حسنة শব্দের অর্থ সুন্দর, উৎকৃষ্ট, ভাল প্রভৃতি। সুতরাং আল- আখলাকুল হাসানা অর্থ : সুন্দর স্বভাব, উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব, ভাল অভ্যাস, উত্তম চরিত্র প্রভৃতি। পরিভাষায়, কথায়-কাজে নিরহংকার ও উত্তম আচরণ ফুটে ওঠার নাম আখলাকে হাসানা।
আল্লামা জুরজানী আখলাকে হাসানার একটি যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তৎপ্রণীত ‘কিতাবুত তা‘রীফাত’ নামক গ্রন্থে। তিনি বলেন,
‘খুলুক বা চরিত্র হচ্ছে আত্মার বদ্ধমূল এমন একটি অবস্থা, যা থেকে কোন চিন্তা-ভাবনা ব্যতীতই অনায়াসে যাবতীয় কার্যকলাপ প্রকাশ পায়। আত্মার ঐ অবস্থা থেকে যদি বিবেক-বুদ্ধি ও শরীআতের আলোকে প্রশংসনীয় কার্যকলাপ প্রকাশ হয় তবে তাকে আখলাকে হাসানা নামে অভিহিত করা হয় ( )
ঙীভড়ৎফ ফরপঃরড়হধৎু তে বলা হয়েছে-
Oxford dictionary তে বলা হয়েছে Character is the particular combination of qualities in a person that makes him different from other. It is such a quality which leads a man to be determined and able to bear difficulties.
‘চরিত্র হচ্ছে কোন মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো স্বতন্ত্র গুণাবলীর সমাবেশ, যা মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এগুলো এমন কিছু গুণ, যা মানুষকে সংকল্পবদ্ধ হতে ও কঠিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে।
হাসান বছরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
حُسْنُ الخُلُقِ بَسْطُ الْوَجْهِ وَبَذْلُ النَّدَى وَكَفُّ الْأَذَىَ
‘সচ্চরিত্র হল হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, দানশীলতা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া’( )
আখলাকে হাসানার গুরুত্ব ও ফযীলত
উভয় জাহানে সফলতার মানদন্ড হল আখলাকে হাসানা। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিকে প্রর্বোত্তম মানুষ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمُ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا
‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভাল’ ( )
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও এরশাদ করেন,
مَا شَيْئٌ اَثْقَلَ فِىْ مِيْزَانِ المُؤْمِنِ يَوْمَ القِيَامَةِ مِنْ خُلْقٍ حَسَنٍ
‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে তা হচ্ছে উত্তম চরিত্র’( )
হযরত আবূ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে বলতে শুনেছি,
مَا مِنْ شَيْئٍ يُوْضَعُ فِى المِيْزَانِ اَثْقَلُ مِنْ حُسْنِ الخُلْقِ، شَأنَ صَاحِبِ حُسْنِ الخُلْقِ لَيَبْلُغُ دَرَجَةَ صَاحِبِ الصَّوْمِ وَالصَّلاَةِ.
‘মুমিনের মিযানের পাল্লায় সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী কোন কিছুই রাখা হবে না। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বদা (দিনে নফল) রোযা পালনকারী ও (রাতে নফল) নামায আদায়কারীর ন্যায়’( )
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
اَكْمَلُ الْمُؤْمِنِيْنَ اِيْمَامًا اَحْسَنُكُمْ خُلُقًا، وَخِيَارُكُمْ خِيَارُكُمْ لِنِسَائِهِمْ خُلُقًا
‘ঈমানের দিক দিয়ে সর্বাধিক কামিল সে ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের সাথে সর্বোত্তম আচরণকারী’ ( )
নবীজীর চরিত্র গুণাবলী
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুমহান, পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতর চরিত্রে সুসজ্জিত, সচ্চরিত্রের মূর্তিমান, সবদিকে অতুলনীয় আদর্শ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর চরিত্রের প্রশংসায় ও তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ ্ তাআলা এরশাদ করেন,
وَإِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيمٍ
“এবং নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত”।
[সূরা কালাম :৪]
তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ ্ তাআলা এরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآَخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا
“যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মাঝে অনুকরণীয় উত্তম আদর্শ রয়েছে।” [সূরা আহযাব: ২১]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّ مِنْ أَحَبِّكُمْ إِلَىَّ وَأَقْرَبِكُمْ مِنِّى مَجْلِسًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَحَاسِنَكُمْ أَخْلاَقًا
‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম সে আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয়। আর ক্বিয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে ( )
সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাঁকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
بُعِثْتُ لِاُتَمِّمَ حُسْنَ الاخلاقِ
‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি ( )
এত অনুপম সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হবার পরও তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর চরিত্রকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করার জন্য ফরিয়াদ করে বলতেন,
عَنِ عائشة قالت: ” كَانَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: اللهُمَّ أَحْسَنْتَ خَلْقِي ، فَأَحْسِنْ خُلُقِي
‘হে আল্লাহ তুমি আমার গঠন সুন্দর করেছ, সুতরাং আমার চরিত্রকে সুন্দর কর ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাকওয়া ও আল্লাহর ভীতি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা তাকওয়া অবলম্বনকারী ছিলেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
أَنَي لأَعْلَمُكُمْ بِاللهِ وَأَشَدُّكُمْ لَهُ خَشْيَةً
“আল্লাহ সম্পর্কে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি অবগত এবং আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি।”( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানশীলতা, উদারতা ও বদান্যতায় ছিলেন সর্বোচ্চ উদাহরণ। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন
مَا سُئِلَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَيْئًا قَطُّ فَقَالَ: لَا
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট কিছু চাওয়া হলে তিনি কখনও ‘না’ বলতেন না।”( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহনশীলতা
সহনশীলতায় ও ক্রোধ-সংবরণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ আদর্শ। কখনো তাঁর পক্ষ হতে মন্দ কথন ও কর্ম প্রকাশ পায়নি, নির্যাতন-অবিচারের শিকার হলেও কখনো প্রতিশোধ নেননি। কখনো কোন সেবক বা স্ত্রীকে প্রহার করেননি। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা ব্যতীত তিনি কখনো কোন কিছুকে স্বীয় হস্ত দ্বারা প্রহার করেননি। এবং তিনি কখনো কোন সেবক বা স্ত্রীকে প্রহার করেননি। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা প্রদর্শন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশোধ নেয়ার সামর্থ্য থাকা সত্বেও সীমা-লঙ্ঘন কারীকে মার্জনা করার এ মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর কোরাইশরা তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় নতশীরে উপবিষ্ট, যে কোন হুকুম তাদের মেনে নেয়া ছাড় উপায় ছিলনা, তিনি তাদেরকে বললেন:
হে কোরাইশগণ ! তোমাদের সাথে এখন আমার আচরণের ধরন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি? তারা বলল : আপনি উদার মনস্ক ভাই ও উদার মনস্ক ভাইয়ের ছেলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘যাও, তোমরা মুক্ত।’ ( )
আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ
“(হে হাবীব!) তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কর্মের আদেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলো।
[সুরা আ’রাফ: ১১৯]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহসিকতা
সাহসিকতা, নির্ভীকতা, যথা-সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ গুণ। তাঁর সাহিসকতা বড় বড় বীরদের নিকট অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত। হযরত আলি ইবনে আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলতেন:
যুদ্ধ যখন প্রচন্ড রূপ নিত, (প্রবলভাবে ক্রোধান্বিত হওয়ার ফলে চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করত) তখন আমরা (তীর-তরবারির আঘাত থেকে বাঁচার জন্য) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা-কবচ হিসেবে গ্রহণ করতাম।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধৈর্যধারণ
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করা ও আত্মঃসংবরণশীল হওয়া এক মহৎ গুণ। ধৈর্যের মহত্ত্বতার দিকে লক্ষ্য রেখে আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ
“(হে হাবীব!) অতএব, তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ। [সুরা আহকাফ:৩৫]
ধৈর্যধারণ তাঁর অনন্য ও সুমহান চরিত্রে মূর্ত-মান ছিল সর্বদা। তিনি রেসালতের দায়িত্ব পালনের স্বার্থে দাওয়াতের কণ্টকাকীর্ণ পথে দীর্ঘ তেইশ বছর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিচলিত কিংবা রাগের বশবর্তী হননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ন্যায় পরায়ণতা
ন্যায় পরায়ণতা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক উৎকৃষ্ট চরিত্র ও অত্যবশ্যকীয় বিশেষ গুণ। মাখযুমিয়্যাহ গোত্রের মহিলা যখন চুরি করল, সে অভিজাত পরিবারের সদস্য হওয়ায় কিছু লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে তার ব্যাপারে সুপারিশ করলেন। জওয়াবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
তুমি কি আল্লাহ কর্তৃক অবধারিত দন্ডবিধি মওকুফের ব্যাপারে সুপারিশ করছ? আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দেব। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়া বিমুখতা
প্রয়োজনের অধিক পার্থিব বস্তু ভোগ পরিহার করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনযাত্রা দেখলে এ সত্যটি আরও ধ্রুব হয়ে ওঠে। যিনি উভয় জগতের বাদশা, যাঁকে পৃথিবীর সকল ধনভান্ডারের মালিক করে দিয়েছে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও আল্লাহর প্রিয় হাবীব ও আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। এতদসত্ত্বেও তাঁর জীবনধারা ছিল অতি সাধারণ। প্রাচুর্যের খনিতে পরিপুষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকার পরও সাদাসিধে ও আড়ম্বরহীন জীবনকে নিজের জন্য বেছে নিয়েছিলেন তিনি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায়ে স্থাপন করে গেছেন অল্পে তুষ্টির বিরল দৃষ্টান্ত । হাদীছে এসেছে,
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর ভগ্নিপুত্র হযরত ‘উরওয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, ‘হে ভগ্নিপুত্র! আমরা দু’মাসের মধ্যে তিনবার নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু এর মধ্যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়া সাল্লামের গৃহসমূহে (রান্নার) জন্য আগুন জ্বালানো হত না। হযরত ‘উরওয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, খালা! তাহলে আপনারা কী খেয়ে জীবন কাটাতেন? তিনি বললেন, কালো দু’টি জিনিস দিয়ে। অর্থাৎ শুকনো খেজুর আর পানি। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়া সাল্লামের প্রতিবেশী কয়েকজন আনছারীর দুগ্ধবতী উটনী ও ছাগী ছিল। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য দুধ পাঠাতেন, তখন তিনি আমাদেরকে তা পান করাতেন।( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লজ্জাশীলতা
লাজুকতা অন্যতম উৎকৃষ্ট গুণ, এ-গুণেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তমরূপে গুণান্বিত । এ-বিষয়ে আল্লাহ তাআলা নিজেই সাক্ষী দিয়ে বলেন:
إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنْكُمْ وَاللهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ
নিশ্চয় তোমাদের এ আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে, কিন্তু আল্ল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না।
[সূরা আহযাব ৫৩]
বিশিষ্ট সাহাবি আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরদায় অবস্থানকারী কুমারী মেয়ের চেয়েও অধিক লাজুক ছিলেন। তিনি যখন কোন কাজ অপছন্দ করতেন তাঁর চেহারায় আমরা তা চিনতে পারতাম। ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহচরদের সাথে উত্তম আচরণ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহচরদের সাথে উত্তম ও সুন্দরভাবে মেলামেশা করতেন। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী, সর্বাপেক্ষা সত্যভাষী, সর্বাপেক্ষা সম্মান জনক লেনদেনকারী। [তিরমিযী-৩৬৯৩৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়
বিনয় উঁচু মাপের চারিত্রিক গুণ। এ-গুণের ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ উদাহরণ। নিজ হাতে জুতা মেরামত করতেন, কাপড় সেলাই করতেন, দুধ দোহন করতেন। সেবকদের কাজে সহায়তা করে আটা পিষতেন। নিজ হাতে রুটি তৈরি করে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খেতেন। নিজে হাটবাজার থেকে সওদা নিয়ে আসতেন। পরিবারের কেউ কোনো কাজের সহায়তা কামনা করলে তখনই সাহায্যের জন্য সাড়া দিতেন। একদা এক লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসল, কিন্তু সে তাঁর ভয়ে শিহরিত হল, তিনি তাকে বললেন :
তুমি নিজকে হালকা (স্বাভাবিক) করে নাও, কেননা আমি রাজা বাদশা নই। নিশ্চয় আমি কোরাইশের এমন এক মহিলার সন্তান, যে শুকনো গোশত খায়। [ইবনু মাজা-৩৩১২]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া
দয়া আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এক বিশেষ গুণ। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে হতে তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছেন, তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে, তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। [সূরা তাওবা ১২৮]
তিনি আরো এরশাদ করেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ
আমি আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমত রূপে প্রেরণ করেছি। [সূরা আম্বিয়া ১০৭]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্য-নিষ্ঠতা
সত্য-নিষ্ঠতা ও বিশ্বস্ততা ছিল রাসূলের অন্যতম গুণ, হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
“আমি কোন মহিলার ব্যাপারে ঈর্ষা করতাম না, যা খাদিজার ব্যাপারে করতাম। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর কথা স্মরণ করতে শুনতাম। এমনকি তিনি কোন ছাগল জবাই করলে তাঁর বান্ধবীদের নিকট তা থেকে হাদিয়া প্রেরণ করতেন। একদা তাঁর বোন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং স্বস্তি বোধ করলেন। অন্য একজন মহিলা প্রবেশ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎফুল্ল হলেন, সুন্দরভাবে তার খোঁজখবর নিলেন। যখন তিনি বের হয়ে গেলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন এ মহিলা খাদিজার জীবদ্দশায় আমার কাছে আসতো। নিশ্চয় সু-সম্পর্ক রক্ষা ঈমানের পরিচায়ক।
[বুখারী-৩৮১৮, মুসলিম- ২৪৩৫, তিরমিযী-৩৮৭৫]
আমরা যদি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুপম গুণাবলী অনুশীলন করে চলি তাহলে আমরা ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তি লাভ করব ইনশাল্লাহ।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ
তথ্য সূত্র
– (আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ওয়াল আ‘লাম, ১ম খন্ড (বৈরুত : দারুল মাশরিক, ১৯৭৩ইং), পৃঃ ৯৪)। (আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ওয়াল আ‘লাম, ১ম খন্ড (বৈরুত : দারুল মাশরিক, ১৯৭৩ইং), পৃঃ ৯৪)।
– (শরীফ আলী বিন মুহাম্মাদ আল – জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত, পৃঃ ১০১। অর্থাৎ কোন মানুষের নিকট থেকে যদি স্বভাবগতভাবে প্রশংসনীয় আচার-আচরণ প্রকাশ পায় তবে তাকে আখলাকে হাসানা বলা হয়।
– (আবূ বকর আল জাযাইরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃঃ ১১৫)।
– (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৫৪, ৯/১৬৮, ‘কোমলতা, লাজুকতা ও সচ্চরিত্রতা’ অনুচ্ছেদ)।
– (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০২, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ হা/৪৭৯৯, ‘সচ্চরিত্র’ অধ্যায়)।
– (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০০৩, সনদ ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৭৯৮)। দিনভর ছিয়াম রেখে, রাতভর ছালাত আদায় করে কোন ব্যক্তি যে নেকী পাবেন, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সচ্চরিত্রের কারণে সে পরিমাণ নেকীর ভাগীদার হবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে তার চরিত্রকে সুন্দর করেছে, আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য যামিন হব’ (তাহক্বীক্ব আবূদাঊদ, হা/৪৮০০, সনদ ছহীহ)।
– (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/১১৬২; সনদ হাসান ছহীহ; তাহক্বীক্ব আবূ দাঊদ হা/৪৬৮২)।
– (তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/২০১৮, সনদ ছহীহ)।
– (তাহক্বীক্ব মিশকাত হা/৫০৯৭, সনদ হাসান, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭০, ৯/১৭২)।
– (আহমাদ-২৪৩৯২, তাহক্বীক্ব-৮১৮৩, মিশকাত হা/৫০৯৯, সনদ ছহীহ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৮৭২, ৯/১৭৩)।
– বুখারী-২০
– মুসলিম-৬১৫৮
– বুখারী-৬৪৯২, মুসলিম-৪৪২১
– ইবন হিশাম: সীরত ২/৪১২
– মুসনাদ এ আহমদ-১৩৪৬
– বুখারী-৩৩১৬
– ছহীহ বুখারী, হা/২৫৬৭, ৬৪৫৮, ৬৪৫৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৭২।
– (বুখারী-৫৬৩৭)