কারবালা: নজিরবিহীন উপাখ্যান- শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম

0

৬০ হিজরির ২২ রজব হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওফাতের পর ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহন করে। তারপর বিভিন্ন অন্যায় বর্বরোচিত কার্যকলাপ শুরু করে। মদীনার গভর্ণর ওয়ালিদের মাধ্যমে হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বার্তা পাঠায় পাষণ্ড ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে প্রত্যুত্তরে বলেন, কোন মতেই নীতিভ্রষ্ট ইয়াজিদকে শাসক হিসেবে মেনে নেয়া যায় না।
৬০ হিজরির ২৮ রজব হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মদীনা ছেড়ে মক্কায় গমন করেন। তিনি ওখানে শাবান, রমযান, শাওয়াল, জিলক্বদ মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। মক্কায় থাকাকীলন তাঁর কাছে মুসলিম বিশ্বের নানা স্থান থেকে দূত মারফত খবরাখবর আসতে থাকে। এসময় কুফাবাসীদের তরফ থেকেও অনেক চিঠিপত্র আসতে থাকে। তারা তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় সেখানে গিয়ে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তাদের প্রতি সাড়া দিয়ে প্রথম পর্যায়ে তিনি তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আক্বিল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে আরো কয়েকজন সহচরসহ দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। কুফাবাসীরা তাঁকে স্বতস্ফূর্তভাবে সংবর্ধনা জানায় এবং হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর প্রতি অকুন্ঠ আনুগত্য স্বীকার করে। কুফাবাসীদের সমর্থন ও উৎসাহ দেখে হযরত মুসলিম বিন আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে কুফায় আগমনের সুসংবাদ জানায় এবং পরিস্থিতির পক্ষে এই মনোভাব ব্যক্ত করেন।
হযরত মুসলিম বিন আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর পর্যবেক্ষণ সত্বর পরিবর্তন হল ইয়াজিদের নিয়োজিত কুফার গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ্ বিন যিয়াদের আগমনের সাথে সাথে। ওবাইদুল্লাহ্র নির্দেশে ৬০ হিজরির ৯ জিলহজ্ব (সেপ্টেম্বর ১০, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) হযরত মুসলিম বিন আকিল, তাঁর দু’পুত্র ও তাঁর আশ্রয়দাতা হানি বিন উরওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে শহীদ করা হলো। হযরত মুসলিম ইবনে আকিলের চিঠির ভিত্তিতে হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ৬০ হিজরির ৮ জিলহজ্ব মক্কা শরীফ থেকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন বিশ্বস্থ সহচর ও আহলে বায়তদের সঙ্গী করে।
মক্কা শরীফ পরিত্যাগের আগে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে জুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সাথে মিলিত হন, তাঁরা তাঁকে পরামর্শ দেন এই দুর্গম যাত্রায় আহলে বায়ত-এর নারী ও শিশুদের সাথে না নেয়ার জন্য। সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করলেন তিনি কুফার উদ্দেশে হিজরত করবেন এবং যাত্রার প্রাক্কালে উপস্থিত সবাইর উদ্দেশে বললেন, ‘মৃত্যু মানুষের জন্য অবধারিত। যারা সত্য ও ন্যায়ের জন্য আল্লাহর পথে রক্ত বিসর্জন দিতে চায় তাঁরা আমার সঙ্গী হবে।’
হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ছোট কাফেলা কুফার উদ্দেশে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে হযরত মুসলিম বিন আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও তাঁর দু’সন্তান-এর শাহাদাতের সংবাদ ও কুফার লোকজনের মতবিরোধের কথা জানতে পারলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি যাত্রা থামালেন না এবং সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকে।
কুফা থেকে দু’দিনের দূরত্বের যাত্রা পথে ইয়াজিদ ১০০০ লোকের বাহিনী হুর ইবনে রিয়াহের নেতৃত্বে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ছোট্ট কাফেলাকে অবরোধ করে। তিনি বললেন, কুফার যেসব লোক আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আমি তাদের সাথে মিলিত হয়ে আবার মদীনায় ফিরে যাবো। হুর তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে আহলে বায়তের ছোট্ট কাফেলাকে ঘিরে রেখে শুষ্ক বিরান মরু অঞ্চল কারবালা প্রান্তে নিয়ে আসে ৬১ হিজরির মহরমের ২ তারিখ (২ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ)।
কুফার গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ্ বিন যিয়াদ আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে ৪০,০০০ সৈন্য বাহিনী দিয়ে ৬১ হিজরির মহররমের ৩ তারিখ কারবালা প্রান্তরে প্রেরণ করে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ছোট্ট কাফেলার বিরুদ্ধে।
ইয়াজিদের নির্দেশে আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে ৫০০০ অশ্বারোহী নিয়োগ করা হলো ফোরাত নদীর তীরে যাতে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বাহিনী পানি আনতে না পারে এবং তাঁরা এক ফোটা পানিও যেন না পায়। হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র পক্ষে একজন গিয়ে আমর ইবনে সাদকে পানি নেয়ার সুযোগ করে দিতে বললে সে পাষণ্ড সরাসরি অস্বীকৃতি জানাল। ১০ মহররম পর্যন্ত তারা ফোরাতের পানি অবরোধ করে রাখে। ওবাইদুল্লাহ্ বিন যিয়াদ আমর বিন সাদকে ৯ মহররম আক্রমণ করার জন্য হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ক্যাম্পের দিকে ধাবিত হতে বলে। হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আব্বাস ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে আমর বিন সাদের কাছে পাঠান ৯ মহররম রাত্রি পর্যন্ত কিছুটা অবকাশ দিতে যাতে করে ক্যাম্পে সবাই ইবাদত-বন্দেগী করতে পারেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হন। ওই রাত্রে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ক্যাম্পের সবাইকে ডেকে বললেন, রাতের অন্ধকারে শত্র“র অগোচরে যার যার ইচ্ছা হয় তারা চলে যেতে পারেন। এতে কেউ সাড়া না দিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সাথে সত্য ও ন্যায়ের পথে রয়ে গেলেন আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের কোরবানি দিতে।
৬১ হিজরির ১০ মহররম (১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে) ইসলাম তথা বিশ্ব ইতিহাসে এক মর্মন্তুদ করুণ হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দেয়। ৯ মহররম বিরতির পর ১০ মহররম ভোর-সকালে নিজের বিশ্বস্ত অনুচরদের সাথে নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা ফজরের নামায আদায় করেন। এরপর ভোরে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে হযরত জুবাইর ইবনে কায়ান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে সেনাদলের ডানপার্শ্বে, হযরত হাবিব ইবনে মুজাহির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বামপার্শ্বে এবং হযরত আব্বাস ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে মূল বাহিনীর পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করেন।
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সঙ্গে ৩২ জন অশ্বারোহী, ৪০ জন পদাতিক বাহিনী ছিল তিনি তাঁর ঘোড়া ‘জুলজিনাহ্’-এর উপর সওয়ার হন।
অন্যদিকে শত্র“ পক্ষে আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে সিমার সেনাধ্যক্ষের নিয়োগ পায়। হুর ও তার সন্তান এই বাহিনীতে যুক্ত ছিল। হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর অনুসারীদের আহ্বান জানালেন আল্লাহর ওয়াস্তে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারকে সাহায্য করতে। সত্য ও ন্যায়ের পথে তাঁর জোরালো আহ্বান শুনে তামিম ও হামদান গোত্রের সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ আল রিয়াহী শত্র“ পক্ষ ত্যাগ করে ইমাম বাহিনীর সাথে যুক্ত হলেন। তাঁর সাথে শত্র“ পক্ষের আরো কয়েকজন বীর যোদ্ধা এসে গেলেন ইমাম বাহিনীতে।
আক্রমণ শুরু করে শত্র“ পক্ষের নেতা আমর ইবনে সাদ ইমাম বাহিনীর প্রতি প্রথম তীর নিক্ষেপ করে এবং সদর্পে বলে ওঠলো ইয়াজিদকে যেন সাক্ষ্য দেয় সেই প্রথম তীর ছুঁড়ে। শত্র“ পক্ষ উত্তেজিত হয়ে আক্রমণ শুরু করলে ইমাম বাহিনী বীরদর্পে মোকাবিলা, শত্র“দের ঘায়েল করে একে একে শাহাদাতের পথ বেছে নেন।
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ডানপার্শ্বের সেনাদলের সাথে ইয়াজিদ বাহিনীর বামপক্ষের যুদ্ধ লেগে যায়। হযরত জোহাইর ইবনে কারান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর বাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শত্র“বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে।
তাদের এলোপাথাড়ি তীর ছোঁড়াছুঁড়ির জন্য হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ক্যাম্পের নারী ও শিশুরা বেকায়দায় পড়েন। একে একে হযরত বুরাইর ইবনে খুদিয়ার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত মুসলিম ইবনে আযুজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হাবিব ইবনে মুজাহির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বীরত্বের সাথে লড়ে শহীদ হন। তাঁরা হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বাঁচানোর জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন আল্লাহর রাস্তায়। ইমামের অনুচররা একে একে বীরত্বের সাথে লড়ে শহীদ হতে থাকেন।
হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর বিশ্বস্ত সহচরেরা একে একে শাহাদাত বরণ করার পর আহলে বায়তগণ মোকাবেলায় শরীক হলেন। বনু হাশেমের গোত্রের যোদ্ধারা সামিল হলেন।
এদিকে হযরত হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা তাঁর ভাই হযরত আব্বাস ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে সঙ্গে নিয়ে এক মশক পানির জন্য ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন যাতে তাঁবুর শিশুদের জন্য হলেও কিছুটা পানি আনা যায়। ইবনে সাদের বাহিনী তাদের প্রতিরোধ করে। হযরত আব্বাস ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শত্র“ বাহিনীর অজস্র তীর নিক্ষেপ উপেক্ষা করে সামনে ফোরাতের দিকে আগ্রসর হতে লাগলেন বীরত্বের সাথে। তিনি শত্র“ বাহিনীর অনেককে একাই ঘায়েল করে তাদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করলেন। বিশাল প্রতিরোধের মাঝেও তিনি সব কিছুকে পরাভুত করে ফোরাতে গিয়ে মশকে পানি ভর্তি করলেন। তাঁবুর পিপাসার্তদের কথা ভেবে তিনি পানি পান না করে তাঁবুর দিকে রওয়ানা দিলেন। ডান কাঁধে পানির মশক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে তাঁবুর দিকে ফিরছিলেন। পানির মশক নিয়ে যদি হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁবুতে ফিরতে পারেন তাহলে শত্র“ বাহিনীর জন্য বিপদ ডেকে আনবে এবং তারা পরাভুত হবে এই ভেবে সাদের বিশাল শত্র“ বাহিনী তাঁকে চারিদিকে ঘেরাও করে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি পানির মশক বাম হাতে নিলেও তাও কব্জি থেকে কেটে ফেলে। এতে তিনি না দমে দাঁতের সাহায্যে মশক ধরে রাখলেন এ সময় একটি তীর এসে মশক ছিদ্র করলে পানি গড়িয়ে পড়লে তিনি চীৎকার করে শত্র“ বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন। এ সময় অতর্কিত শত্র“র একটি বল্লম তাঁর মাথায় আঘাত করলে তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান। অসংখ্য তীরের আঘাতে তিনি জর্জরিত হয়ে পড়েন। তাঁকে ফেলে শত্র“বাহিনী চলে যায় অন্তিম মুহূর্তে তাঁর চোখ-মুখের রক্তধারা হযরত ইমাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র পবিত্র হাত দিয়ে মুছে ফেলেন যাতে ইমামের চেহারা মোবারক শেষবারের মতো দেখতে পারেন। হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর মৃতদেহ ক্যাম্পে না নিতে অনুরোধ করেন, কারণ তিনি পানি আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্যাম্পের মধ্যে ছয়মাসের শিশু আলি আসগর পানির পিপাসায় কাতরাচ্ছিলেন তখন এক ঢোক পানির জন্য অনুরোধ করলে পানির বদলে তীর এসে শিশুর বুকে বিঁধে তখনই শহীদ হন। তাঁর পেছনে তলোয়ার দিয়ে মাটি খুঁড়ে শিশু আলি আসগরকে দাফন করা হয়। এই ছোট্ট শিশুর কবরটি ইমামের চোখের পানিতে ভিজে যায়।
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবার অসীম সাহসিকতার সাথে লড়ে শত্র“ বাহিনীর বীরদের একে একে ঘায়েল করতে থাকেন। তিনিও তাঁর বীরপুত্র আলি আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা গর্জে উঠলেন, ‘ওহে আবু সুফিয়ানের বংশধরেরা তোমরা কি ধর্মীয় শিক্ষা নাওনি তোমাদের অপকর্মের জন্য শেষ বিচারের দিনে তোমাদের জবাব দিহি করতে হবে।’
হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর শরীরে অসংখ্য আঘাতে জর্জরিত হওয়ায় তিনি কিছুটা থেমে গেলেন। এ সময় তাঁর কপালে শত্র“র ছোড়া পাথরে প্রচণ্ড আঘাত লাগে, এসময় তিনি মুখ থেকে রক্ত মুছছিলেন তখন এক তীর তাঁর হৃদপিণ্ডের বরাবর আঘাত করলে তিনি সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ্, আল্লাহর নামে বলছি, তার রাসূলের নামে বলছি, তাঁরা এমন একজনকে মারলো যার পরে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর দৌহিত্র বলতে কেউ এ ধরার বুকে থাকবে না। তিনি সিনা থেকে তীরটা বের করলে প্রচণ্ড বেগে রক্তধারা প্রবাহিত হতে লাগলো। তিনি ক্রমে দুর্বল হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লেন।
শত্র“রা কিছুক্ষণ থেমে আবার তাঁকে ঘিরে, তখন তাঁবু থেকে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (তখন ছোট বালক) দৌঁড়ে এসে চাচার পাশে দাঁড়াতেই এক পাষণ্ড তলোয়ার দিয়ে তাঁর চাচাকে আঘাত করতে উদ্যত হলে তিনি নিজের বাহু পেতে দেন- এতে তাঁর বাহু দেহ থেকে আলাদা হয়ে ঝুলে পড়ে থাকে। হযরত হোসাইন তাঁকে আদরে চুমু খেলেন এবং একটা তীর এসে বালক আবদুল্লাহ’র ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।
হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েন, তাঁর ঘোড়াও গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তলোয়ারটা খাপে রেখে একটা বৃক্ষের নিচে বসলেন। এই সুযোগে ইয়াজিদ বাহিনী প্রধান আমর ইবনে সাদ কোওয়ালি ইবনে ইয়াজিদ আল্ আসবাহীকে পাঠালেন শেষ কাজটা সেরে ফেলতে। সে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর চোখাচুখি হলে ভয়ে পালিয়ে আসে, কারণ এতে সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। আরেকজনকে পাঠালেন সেও তলোয়ার ফেলে ভয়ে ফেরত আসে এবং বলে সে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে উদ্যত অবস্থায় দেখে। এতে করে পাষণ্ড সীমারকে আদেশ দেয়া হলো। সে লৌহশিরস্ত্রাণ ও জুতা পরে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সন্নিকটে গিয়ে তাঁর কোমরে লৌহ জুতার প্রচণ্ড আঘাত করে- তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পাষণ্ড সীমার তার ধারালো ছুরি ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর গলায় চালাতে লাগলো। এভাবে ২ বার চালানোর পর যখন গলা কাটা যাচ্ছে না তখন হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন- এভাবে পারবে না কারণ ওই গলায় আল্লাহর নবী চুমা খেতেন, বরং আমি সাজদারত অবস্থায় আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করবো তখন কেটে নিও। সাজদারত অবস্থায় হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর শির মোবারক পবিত্র দেহ থেকে কেটে দু’টুকরা করা হলো। কি মর্মন্তুদ, হৃদয়বিদায়রক এ দৃশ্য যা পুরো জাহানকে কাঁপিয়ে তুলেছে।
এ শোকাবহ মুহূর্তে ইয়াজিদ বাহিনী তাঁবুর সবকিছু লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহলে বায়তের সদস্যরা খালি পায়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় তাঁবু পরিত্যাগ করেন। হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র লাশ মোবারকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁরা ব্যাকুল হয়ে পড়েন। হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর প্রিয় কন্যা বাবার লাশকে জড়িয়ে ধরলে শত্র“ বাহিনী তাঁকে জোর করে ছাড়িয়ে নেয়। পাষণ্ড ইয়াজিদ বাহিনী হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর দেহ মোবারককে ঘোড়ার পায়ের তলায় দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে। হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র শির মোবারক ও তাঁর সহচরদের শির মোবারকসহ ওবাইদুল্লাহ্ বিন যিয়াদের কাছে কুফায় পাঠানো হয়। ওখান থেকে কুলাঙ্গার ইয়াজিদের কাছে দামেস্কে পাঠানো হয় শুধু ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর শির মোবারক।
শত্র“ বাহিনী যাওয়ার পর বনু আসাদ গোত্রের লোকেরা
কারবালার শোহাদার দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। মহররমের ১১ তারিখ (১১ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) বন্দী সকল নারী ও শিশুদের হাওদাবিহীন উটের উপর সওয়ার করে প্রথমে কুফায় এবং পরে দামেস্কে পাঠানো হয়। ওখানে হযরত আলি ইবনে হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অসুস্থ ও হযরত হাসান ইবনে হাসান আল্ মুসান্না রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু গুরুতর আহত অবস্থায় ছিলেন। পথিমধ্যে আহলে বায়তদের দেখার জন্য লোকজন জড়ো হলে তাদেরকে জয়নাব বিনতে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সাহসিকতার সাথে ইসলামের মহান বাণী পৌঁছিয়ে দেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকার আহ্বান জানান। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আবার পুনর্জাগরণ দেখা দেয়। এই ভয়ে ইয়াজিদ এক বছর পর বন্দী আহলে বায়তের সকল সদস্যকে মদীনায় প্রেরণ করে।
ইসলামের তথা পৃথিবীর ইতিহাসে কারবালা প্রান্তরের মর্মন্তুদ কাহিনী চির অক্ষয় হয়ে থাকবে। হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর পরিবার ও সহচরদের চরম আত্মত্যাগের কাহিনী যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সত্য ও ন্যায়ের আলোক-ছটা ছড়িয়ে দেবে। অন্যায়, জুলুম ও অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাবাইকে প্রেরণা যোগাবে।

লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •