না’তে রসূল মৌখিক জিহাদের উত্তম হাতিয়ার

0

শানে রিসালত
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

না’তে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মৌখিক জিহাদের উত্তম হাতিয়ার
হুযূর-ই আকরাম, সরকার-ই দু‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদা আনসারকে সম্বোধন করে এরশাদ করেন, যেসব লোক আল্লাহর রসূলের সাহায্য সম্পদ ও হাতিয়ার দ্বারা করেছে, তাদের জন্য কোন্ জিনিষ বাধ সেধেছে তাদের মুখেও রসূলের সাহায্য করতে? হযরত হাস্সান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এটা এরশাদ করার সময় শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন। তিনি আরয করলেন, ‘‘এয়া রসূলাল্লাহ্! সেটার যিম্মাদারী আমি নিচ্ছি।’’ সুতরাং আজ ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে যে, তিনি নিজে নিজেকে এ গুরু দায়িত্ব পালনের যথার্থ উপযোগী বলে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। আর গোটা জীবনটুকু হুযূর-ই আকরামের প্রশংসা এবং উচ্চাঙ্গের কবিতার মাধ্যমে হুযূর-ই আকরামের বিরোধীদের এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের খণ্ডনে অতিবাহিত করেছেন।
এখন দেখুন এর ফলে দরবারে রিসালতে তাঁর মর্যাদা কত বৃদ্ধি পেয়েছে
হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সর্বাপেক্ষা বড় স্বাতন্ত্র্য এই যে, তিনি দরবারে রিসালতের শা‘ইর (কবি) ছিলেন। আর তিনি রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে কাফিরদের খণ্ডনে শে’র আবৃত্তি করতেন। তিনি একদা মসজিদে নবভী শরীফে শে’র পড়ছিলেন। হযরত ওমর ফারুক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিষেধ করতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনি কি জানেন না যে, আমি আপনার চেয়ে উত্তম সত্তার সামনে শে’র পড়তাম?’’ অর্থাৎ রসূলে-ই আকরামের সামনে।
হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত মদীনা মুনাওয়ারার আনসারের গোত্র খাযরাজের লোক ছিলেন। তাঁর পিতৃপুরুষগণ তাঁদের গোত্রের সরদার ছিলেন। তাঁরা সবাই দীর্ঘ জীবন লাভ করেছেন। খোদ হযরত হাস্সান ইবনে সাবিতের বয়স ১২০ বছর ছিলো।
হযরত হাস্সান বার্দ্ধক্যে ঈমান আনেন। হিজরতের কালে তাঁর বয়স ৬০ বছর ছিলো। হযরত হাস্সানের জীবনীতে কবিত্বের একটি বিশেষ অধ্যায় রয়েছে। তিনি তা দ্বারা এক মহান মুজাহিদ সূলভ অবদান রেখে গেছেন। উল্লেখ্য যে, কবিতা রচনা ও আবৃত্তি এবং কথা শিল্প আরবের বিশেষ লোকদের বিশেষ রুচিবোধই ছিলো। কোন কোন গোত্র তো কবিদের খনিই ছিলো। আবার ওইসব গোত্রের কয়েকটা বিশেষ খান্দান ছিলো, যাদের নিকট শা’ইরী (কবিত্ব) তাঁদের বাপ-দাদা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছিলো। হযরত হাস্সানও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাঁর দাদা, পিতা, তিনি নিজে, তাঁর পুত্র আবদুর রহমান এবং পৌত্র প্রত্যেকেই প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন।
আরবের তামাদ্দুন তথা সভ্যতার সুবহে সাদিক্ব তো আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় সত্তা এবং ক্বোরআন মজীদ থেকেই উদিত হয়েছে। ক্বোরআন-ই করীম ফাসাহাত ও বলাগত (আরবী অলংকার শাস্ত্র)-এর সর্বাপেক্ষা বড় মু’জিযা। বড় বড় কথা সাহিত্যিকদেরকে সেটার সামনে নিশ্চুপ-নির্বাক করে ছেড়েছিলো। এতদ্ ভিত্তিতে যারা ইসলামী কাব্যে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের মধ্যেও ফাসাহাত ও বলাগত (আরবী অলংকার শাস্ত্র)-এর এক নতুন প্রাণ ও আত্মার সঞ্চার হয়েছে। হযরত হাস্সান তাঁদের সবার থেকে এগিয়ে গিয়ে ছিলেন। হযরত হাস্সান যখন প্রতিরক্ষা ও খন্ডন মূলক কবিতা পড়তেন, তখন আঁ হযরত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খুব খুশী হতেন। একদা হুযূর-ই আকরাম নির্দেশ দিলেন, ‘‘হে হাস্সান! তুমি আমার পক্ষ থেকে জবাব দাও (খণ্ডন করো), খোদা তা‘আলা রূহুল কুদুস (হযরত জিব্রাঈল) দ্বারা তোমাকে সাহায্য করবেন।’’

তীর ও ধারাল ছোরা
মুশরিকদের উপর ওইসব শে’রের যে প্রভাব পড়তো, সেটাকে আঁ-হযরত সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এভাবে বর্ণনা করেছেন- ‘‘হাস্সানের কবিতাগুলোর প্রভাব তেমনিভাবে পড়ে, যেমন তীর ও ধারাল ছোরার প্রভাব পড়ে থাকে।’’
হযরত হাস্সান হুযূর-ই আকরামের প্রশংসায়ও কবিতা রচনা করেছেন। রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে তিনি যেসব প্রশংসামূলক কবিতা লিখেছেন সেগুলো ছিলো অতুলনীয়। সেগুলোর প্রতিটি পংক্তি মুর্চ্ছনার মুখনিসৃত প্রতিকৃতি ছিলো। এক প্রাচীন অনুশীলনের কবি, এক বায়োপ্রাপ্ত বুযুর্গ, সর্বোপরি একজন পবিত্র সাহাবী অনুসারে হযরত হাস্সানের কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু শিক্ষা ও উপদেশ এবং উচুঁ মানের চরিত্রের দিকে মুসলিম জাতির মধ্যে আগ্রহের উদ্রেক করে।
হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত সরকার-ই দু’আলমের না’ত বা প্রশংসায় এত বড় সম্মান অর্জন করেছেন যে, খোদ্ হুযূর-ই আকরাম মসজিদে নবভী শরীফে তাঁর জন্য মিম্বর বিছিয়ে দিয়েছেন। আর হযরত হাস্সান ইবনে সাবিতকে সেটার উপর দাঁড় করিয়ে তাঁর কবিতাগুলো (আশ্‘আর) শুনেছেন।
হযরত হাস্সান ইসলাম বিরোধীদের অশোভন আক্রমনের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন। ৫৪ হিজরীতে রসূল-ই পাকের দরবারের এ শীর্ষস্থানীয় কবি, সাহাবী ও না’ত খাঁ ওফাত প্রাপ্ত হন এবং তাঁর প্রকৃত ¯্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান। মদীনা মুনাওয়ারার জান্নাতুল বাক্বী’তে দাফন হন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলায়হি রাজিঊন।

দিওয়ান-ই হাস্সান
হযরত হাস্সানের অমূল্য শে’রগুলো দীর্ঘকাল যাবৎ লোকজনের মুখে মুখে এবং বক্ষগুলোতো সংরক্ষিত ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে, সেগুলো গ্রন্থাকারে একত্রে সংকলিত হয়েছে। আবূ সা‘ঈদ সেগুলোকে সংকলন করে সেগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর পরে অন্য একজন লোকও সেগুলোর ব্যাখ্যা লিখেছেন। তাঁর কবিতাগ্রন্থ (দিওয়ান-ই হাস্সান) ভারত ও তিউনিসিয়ায় মুদ্রিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাঁর কবিত্বের মধ্যে সব ধরনের কথা, যেমন প্রশংসা, খন্ডন, ক্বাসীদাহ্, গযল, শোকগাঁথা, সর্বোপরি না’ত ইত্যাদি মওজুদ রয়েছে। কিন্তু সরওয়ার-ই কা-ইনাত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় সত্তা সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন, তাঁর সব দিওয়ানে, সেগুলোর তুলনা নেই।

ইমাম বূ-সীরী ও কসীদাহ্ বোর্দাহ্ শরীফ
প্রসিদ্ধ ‘ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ্’ শরীফের সম্মানিত রচয়িতা আল্লামা শরফ উদ্দীন মুহাম্মদ বূ-সীরী মিশরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মিশরের এক গ্রাম/নগরী বূ-সীরের মহান সর্দার ও জ্ঞান সমুদ্র আলিম, ফাসাহাত ও বলাগত (আরবী অলংকার শাস্ত্রের এমন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন যে, তাঁর যুগে তিনিই তাঁর উপমা ছিলেন। তাঁর যুগের আলিমদের মধ্যে তিনি এক প্রখ্যাত আদীব (সাহিত্যিক) ছিলেন।
প্রাথমিক বয়সে তিনি তার খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতা ও জ্ঞান গভীরতার কারণে ইসলামী সুলতান (রাজা-বাদশাহ্)দের নৈকট্য ধন্য ও প্রিয়ভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সুলতানগণ ও তাঁদের আমীর উমারার প্রশংসায় কবিতা আবৃত্তিতে বিশেষভাবে অংশগ্রহণ করতেন। আর তাঁদের শ্রত্রুদের খণ্ডনে ক্বসীদা (কবিতাগুচ্ছ) রচনা ও আবৃত্তি করতেন।

একদিন তিনি বাদশাহ্র দরবার থেকে তাঁর ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এক বুযুর্গ ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি আল্লামা বূ-সীরীকে জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কি কখনো হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছেন? স্বপ্নযোগে হুযূর-ই আকরামের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন? তিনি জবাবে বললেন, ‘‘আজ পর্যন্ত আমি হুযূর-ই আকরামের সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হইনি।’’ আল্লামা বূ-সীরী বলেছেন, ‘‘ এ জবাব দেওয়ার পর থেকে আমার অন্তরে হুযূর-ই আকরামের ইশ্ক্ব ও মুহাব্বত-এর প্রেরণা এমনভাবে ঢেউ খেললো যে, আমার হৃদয় ওই ভালবাসা ব্যতীত অন্য কিছু অনুভব করতে পারছিলো না। ঘরে এসে ওই অস্থিরতা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ওই রাতেই আমি আপাদমস্তক শোভা মাহবূবে দু’-আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যিয়ারত (সাক্ষাৎ) লাভ করে ধন্য হলাম। আমি হুযূর-ই আন্ওয়ারকে সাহাবা-ই কেরামের জমা‘আতে এমন শান-শওকতের সাথে দেখলাম যেন অনেকগুলো তারার মধ্যখানে চন্দ্র।’’

চোখ খুললে আমি আমার হৃদয়কে ওই নূরানী সত্তার ভালবাসায় এবং তাঁর বরকতময় সাক্ষাতের আনন্দে ভরপুর পেলাম। এর পর থেকে একটা মুহূর্তের জন্যও সশরীর নূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা আমার নিকট থেকে পৃথক হয়নি। আর আমি এ ভালবাসা ও আনন্দের মধ্যে কয়েকটা ক্বসীদা লিখে ফেললাম। ‘ক্বসীদাহ্-ই মুদ্বারিয়াহ্’ ও ‘ক্বসীদাহ্-ই হামাযিয়াহ্’ ওই সময়েই রচিত।

এরপর একদিন হঠাৎ আমাকে অর্দ্ধাঙ্গ রোগ পেয়ে বসলো। আর আমার শরীরের অর্দ্ধভাগ অনুভূতিহীন হয়ে গেলো। এ মুসীবতের সময়ে আমার হৃদয়াত্মা আমাকে পরামর্শ দিলো যেন আমি একটি ‘ক্বসীদাহ্’ হুযূর-ই আকরামের প্রশংসায় রচনা করি। আর সেটার মাধ্যমে আরোগ্যের ওই মূল ফটক (باب الشفاء)-এর মহান দরবারে আমার শেফার জন্য দরখাস্ত পেশ করি। সুতরাং ওই অবস্থায়ই আমি এ ক্বসীদাহ্-ই মুবারকাহ্ (ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্ শরীফ) রচনা করেছি।

রচনা শেষে যখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, তখন স্বপ্নে ওই মসীহে কাওনাঈন, শিফা-ই দারাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাৎ (দিদার) পেয়ে আবারো ধন্য হলাম। ওই স্বপ্নেই আমি এ ক্বসীদাহ্ হুযূর-ই আকরামের সামনে পড়লাম। ক্বসীদাহ্ পাঠ শেষ করার পর দেখলাম সরকার-ই দু’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার শরীরের অসুস্থ অংশের উপর নূরানী হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। যখন আমার চোখ খুললো, তখন দেখলাম আমি পূর্ণ সুস্থ হয়ে গিয়েছি।
এ খুশীতে আমি ভোরে ঘর থেকে বের হয়েছি। পথিমধ্যে শায়খ আবুর রাজা আস্সিদ্দীক্বের সাথে সাক্ষাৎ হলো। যিনি তাঁর যুগের ক্বুত্ববুল আক্বতাব ছিলেন। তিনি আমাকে বলতে লাগলেন, ‘‘হে ইমাম, আমাকে ওই ক্বসীদা শুনিয়ে দিন, যা আপনি হুযূর-ই আকরামের প্রশংসায় লিখেছেন।’’ যেহেতু ওই ক্বসীদা শরীফ সম্পর্কে আমি ব্যতীত কেউ জানতেন না, সেহেতু আমি আরয করলাম, ‘‘হযরত! আপনি কোন্ ক্বসীদাহ্ চাচ্ছেন, যা আমি হুযূর-ই আকরামের প্রশংসায় রচনা করেছি?’’
শায়খ আবুর রাজা বললেন, ‘‘ওই ক্বসীদাহ্ শুনান, যার প্রারম্ভ এ পংক্তি দ্বারা করা হয়েছে-
اَمِنْ تَذَكُّرِ جِيْرَانٍ بِذْىْ سَلَم
مَزَجْتَ دَمْعًا جَرٰى مِنْ مُقْلَةٍ بِدَم
আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে আরয করলাম, ‘‘হে আবুর রাজা! আপনি এ পংক্তিটুকু কোত্থেকে মুখস্ত করলেন, আমি তো এ ক্বসীদা আমার সরকার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত কাউকে এ পর্যন্ত শুনাইনি? এ পর্যন্ত আমার নিকট এমন কেউ আসেওনি, যাকে আমি এ ক্বসীদাহ্ শুনিয়েছি।’’ হযরত আবুর রাজা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেছেন, ‘‘এ ক্বসীদাহ্ গত রাতে আমি ওই সময়ে শুনেছি, যখন আপনি রসূলে আকরামের পবিত্র দরবারে আরয করছিলেন। আর হুযূর-ই আকরামও এ ক্বসীদাহ্ শুনে আনন্দ প্রকাশ করেছেন।’’

ইমাম বূ-সীরী বলেছেন, ‘‘এ কথা শুনে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ওই ক্বসীদাহ্ তাঁর খিদমতে পেশ করলাম। এর সাথে সাথে ওই খবর গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়লো। ‘আশ্-শাওয়ারিদুল ফরদাহ্’র লেখক মহোদয় এর সাথে এও বৃদ্ধি করেছেন যে, ক্রমশ: এ খবর মালিকুয্ যাহিরের উজির বাহাউদ্দীন পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি ওই ক্বসীদাহ্ শরীফের কপি সংগ্রহ করলেন। আর প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি প্রতিদিন এ ক্বসীদাহ্ মুবারক খোলা পায়ে খোলা মাথায় দাঁড়িয়ে পড়িয়ে শুনবেন। সুতরাং তিনি তাই করলেন। ফলে তাঁর দ্বীন ও দুনিয়ার অনেক কাজ পূর্ণ হলো, অনেক মুসীবৎ দূরীভূত হলো।

এরপর ওই উজিরের ফরমান লিখক সা‘দ উদ্দীন ফারুক্বীর চোখ দু‘টি অসুস্থ হয়ে গেলো। এমনকি চোখের জ্যোতি চলে যাবার আশংকা করলেন। স্বপ্নে তাঁকে কেউ বললো, ‘‘বাহাউদ্দীন থেকে ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ্’ নিয়ে তোমার চোখে লাগাও!’’ তিনি তাঁর নিকট গেলেন এবং স্বপ্নের কথা বললেন। বাহাউদ্দীন (উজির) বললেন, ‘‘বোর্দার কথা তো জানি না, অবশ্য হুযূর-ই আকরামের একটি প্রশংসা গাথাঁ (ক্বসীদাহ্) আমার নিকট আছে, যা রোগ-ব্যাধির শেফার জন্য অত্যন্ত উপকারী।’’ সুতরাং সা‘দ উদ্দীন ওই ক্বসীদাহ্ নিলেন এবং চোখে লাগালেন এবং পড়লেন। সাথে সাথে আরোগ্য লাভ করলেন।

প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লামা বূ-সীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উজির বাহাউদ্দীনের সমকালীন ছিলেন। উজির বাহাউদ্দীন ৫৮১ হিজরী সালের অভ্যন্তরে মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী ওয়াদী-ই নাখলায় জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ৬৭৭ হিজরীতে মিশরের কায়রোতে ইনতিকাল করেছেন। উজির বাহাউদ্দীন নিজেও একজন ভাল কবি ছিলেন। ইমাম বূ-সীরী আলায়হির রাহমাহ্ ৬৯৪ হিজরীতে ওফাত পান।

ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ্র নামকরণ
১. ‘বোর্দাহ্’ বলা হয় বিভিন্ন রংয়ের রেখা বিশিষ্ট্য কাপড়কে। যেহেতু এ ক্বসীদাক্বেও ইমাম বূ-সীরী বিভিন্ন বিষয়বস্তু দ্বারা সাজিয়েছেন, সেহেতু এ ক্বসীদাকে ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্ বলা হয়।
২. কেউ কেউ বলেছেন, বোর্দাহ্ ‘বরদুন’ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শৈথিল্য ও সোজা করা ইত্যাদি। যেহেতু কবি তাঁর এ কবিতাকে অমূলক ও অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু দ্বারা সজ্জিত করেননি, বরং তা পাঠ করলে হৃদয় ঠাণ্ডা হয়ে যায়, পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়, সেহেতু সেটাকে ‘ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্ বলা হয়।
৩. কেউ কেউ বলেছেন, ‘যখন এ ক্বসীদাহ্ স্বপ্নে ইমাম বূ-সীরী আলায়হির রাহমাহ হুযূর আকরামকে পড়ে শুনিয়ে ছিলেন, তখন হুযূর-ই আকরাম নিজের ‘বুর্দে ইয়ামানী’ (ইয়ামনী চাদর শরীফ) তাঁর শরীরের উপর রেখে দিলেন। আর তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। সুতরাং ওই ক্বসীদাহ্ও ‘ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্’ হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে গেলো।
তাছাড়া, শায়খ মুহিউদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে মোস্তফা, ওরফে শায়খ যাদাহ্’র ব্যাখ্যাগ্রন্থেও এমনটি লিখা হয়েছে। মোটকথা, ইমাম বূ-সীরীকে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর এ ক্বসীদাহ্র জন্য তাঁর দেহে নূরানী হাত বুলিয়ে আপন চাদর শরীফ ‘বুর্দে ইয়ামানী’ দান করেছিলেন এবং এসবের বরকতে তিনি পূর্ণ সুস্থতা লাভ করেছিলন, ঘটনার বাস্তবতা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যাদির ভিত্তিতে এ ক্বসীদাহ্ ‘ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। সর্বোপরি একথাও প্রতীয়মান হয় যে, অকৃত্রিম ইশ্ক্বে রসূল ও রসূলে পাকের প্রশংসা (না’ত) শরীফের বরকতে আল্লাহ্-রসূলের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং নানাবিধ বালা-মুসীবৎ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •