প্রত্যেক সৃষ্টি বস্তুই মহান শ্রষ্টার মহিমা ও গুণ-কীর্তন করে

0

প্রত্যেক সৃষ্টি বস্তুই মহান শ্রষ্টার মহিমা ও গুণ-কীর্তন করে

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

لَوْ اَنْزَلْنَا هٰذَا الْقُرْاٰنَ عَلٰى جَبَلٍ لَّرَاَیْتَهٗ خَاشِعًا مُّتَصَدِّعًا مِّنْ خَشْیَةِ اللّٰهِؕ-وَ تِلْكَ الْاَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ یَتَفَكَّرُوْنَ (۲۱) هُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ-عٰلِمُ الْغَیْبِ وَالشَّهَادَةِۚ-هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِیْمُ(۲۲) هُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ-اَلْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلٰمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَیْمِنُ الْعَزِیْزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُؕ-سُبْحٰنَ اللّٰهِ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ(۲۳)هُوَ اللّٰهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰىؕ-یُسَبِّحُ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِۚ-وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ۠(۲۴)

আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা : (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-) যদি আমি এ কুরআনকে কোন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম, তবে অবশ্যই তুমি সেটাকে দেখতে অবনত, টুকরো টুকরো অবস্থায় আল্লাহর ভয়ে এবং আমি (আল্লাহ) এসব দৃষ্টান্ত মানুষের জন্য বর্ণনা করি, যেন তারা চিন্তা-ভাবনা করে। তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, প্রত্যেক অদৃশ্য ও দৃশ্যমানের জ্ঞাতা। তিনিই হন অসীম দয়ালু, পরম করুণাময়, তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, যিনি বাদশা, অতি পবিত্র, শান্তিদাতা, নিরাপত্তা প্রদানকারী, রক্ষাকারী, পরম সম্মানিত, প্রতাপান্বিত, মাহাত্ম্যশীল, মহান আল্লাহ পবিত্র তা হতে তারা (অর্থাৎ মুশরিকরা) যাকে তাঁর সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্থ করে। তিনিই আল্লাহ, ¯্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, প্রত্যেকের রূপদাতা, তারই রয়েছে উত্তম নামসমূহ। তাঁরই পবিত্রতা ঘোষণা করে যা কিছু রয়েছে নভোমন্ডলে ও ভূ-মন্ডলে। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়। [২১-২৪ নং আয়াত, সূরা আল-হাশর]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
لَوْ أَنزَلْنَا هَـٰذَا الْقُرْآنَ عَلَىٰ جَبَلٍ لَّرَأَيْتَهُ الخ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশ্ববিখ্যাত তাফসীর শাস্ত্র বিশারদ ইমাম যমখশারী তাফসীরে কাশশাফে বলেছেন- هذا تمثيل و تخييل অর্থাৎ এ আয়াতের মর্মবাণী হলো রূপকে ও দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যার উপর সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে আয়াতের শেষাংশ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ অর্থাৎ যদি কুরআনে করীমকে পর্বত মালার ন্যায় অতীব কঠিন ও ভারী বস্তুর উপর অবতীর্ণ করা হতো এবং পাহাড়কে মানবজাতির ন্যায় জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা দান করা হতো তবে বিশ^¯্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বাণী হিসাবে পবিত্র কুরআনের অপরিসীম মাহাত্ম্যের প্রভাবে শক্তিধর পর্বতমালা ও বিনয়াবনত-বরং-চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ খেয়াল-খুশি ও স্বার্থপরতায় লিপ্ত হয়ে তার স্বভাবজাত চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। সে কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয় না। অতএব, এটা যেন এক কাল্পনিক দৃষ্টান্ত। কারণ, বাস্তবে পাহাড়ের মধ্যে চেতনা নেই। উদ্দেশ্য হল- এর মাধ্যমে মানবকূলকে ধমক দেয়া ও ভয় প্রদর্শন করা যেন তারা কুরআন তেলাওয়াতে ও কুরআনের বিধি-বিধান চর্চায় বিনয়াবনত হয় আর কুরআনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কোন কোন তাফসিরকারক বলেন- পর্বতমালা, বৃক্ষরাজি ইত্যাদি বস্তুর মধ্যে চেতনা ও অনুভূতি বিদ্যমান আছে। কাজেই এটা কাল্পনিক নয়-বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টান্ত। [তাফসীরে কাশ্বাফ ও মাযহারি শরীফ]

মুফাসসেরীনে কেরাম আরো বলেন-মহামহিম আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বাণী হিসেবে কুরআনে করীমের অপরিসীম ও অকল্পনীয় মাহাত্ম, নুরানী তাজাল্লী ও ঐশী প্রভাবের কারণে। এটা পর্বতমালার উপর অবতীর্ণ হলে তা বিনয়াবনত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত। এহেন খোদায়ী কালাম কুরআনে মাজীদ কে সৃষ্টিকূল সরদার নবীকূল শিরোমণী আহমদে মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নূরানী ক্বলব মুবারকে নাযিল করা হল। অতঃপর নূরাণী ক্বলব মুবারক কুরআনের ধারক-বাহক ও সংরক্ষণকারী হয়ে স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক রইল। (সুবহানাল্লাহ) এর দ্বারা রাসূলে খোদা, আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ক্বলব মুবারকের অপরিসীম শক্তিমত্তা, অকল্পনীয় প্রশস্ততা এবং প্রগাঢ় গভীরতার কিঞ্চিত ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল্লাহর কুদরতের নূরের এক ঝলকের বিচ্ছুরনে তূর পর্বত জ¦লে-পুড়ে সুরমায় পরিণত হয়। আর ইমামুল আম্বিয়া মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মে’রাজ রজনীতে সৃষ্টি জগতের সকল বেষ্টনী অতিক্রম করে আরশে আজমে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের একান্ত সান্নিধ্যে উপনীত হয়ে দীদার-দর্শন সাক্ষাত লাভে এমন স্থির-স্থিতিশীল ও অবিচল ছিলেন চক্ষু মুবারক পর্যন্ত এদিক-সেদিক ফিরে নাই কিংবা সীমাতিক্রম করে নাই। ما زاغ البصر و ما طغي অতএব রাসূলে আকরাম নূরে মুজাসসামার নূরানী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুবারকের শান-আজমত যে কত অতুল-অনুপম উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে তা সহজে অনুমান করা যায়।

يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ الخ
আল্লাহর পবিত্রবাণী “তাঁরই পবিত্রতা ঘোষণা করে যা কিছু বিদ্যমান রয়েছে নভোমন্ডলে ও ভুমন্ডলে” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-আসমানে-যমীনে বিদ্যমান সকল সৃষ্ট বস্তুর এই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা অবস্থার মাধ্যমে হলে, তা বর্ণনা সাপেক্ষ নয়। কেননা, সমগ্র সৃষ্টি জগত স্বভাবজাত অন্তর্নিহিত কারিগর এবং আকার-আকৃতি নিজ নিজ অবস্থার মাধ্যমে অহর্নিশ ¯্রষ্টার প্রশংসাও গুন-কীর্তনে মশগুল রয়েছে। সত্যিকার উক্তির মাধ্যমে তাছবীহ পাঠ ও হতে পারে। কারণ, আল্লাহ রব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন- সকল সৃষ্টিই মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে, যদিও তোমরা তাদের তাছবীহ অনুধাবন করতে পার না।
এ আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে সুচিন্তিত অভিমত হলো প্রত্যেক সৃষ্টি বস্তুই নিজ নিজ সীমায় চেতনা ও অনুভূতি সম্পন্ন, জ্ঞান-বুদ্ধিও চেতনায় সর্ব প্রথম দাবী হচ্ছে ¯্রষ্টাকে চেনা ও তার কৃতজ্ঞ হওয়া। অতএব প্রত্যেক বস্তুর সত্যিকার তাছবীহ পাঠ করা উক্তির মাধ্যমে অসম্ভব নয়। তবে আমরা নিজের কানে তা শুনি না। এ কারণেই আল্লাহর কুরআনে বলে- و لكن لا تفقون تسبيحهم

সূরা হাশর এর সর্বশেষ আয়াত সমূহের অপরিসীম বরকত ও ফজিলত
মুফাসসেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন-সূরা “হাশর” এর সর্বশেষ আয়াত সমূহের অপরিসীম বরকত ও ফজিলত রয়েছে-যেমন-সাইয়্যেদুনা হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লহু আনহু বর্ণনা করেছেন- একদা আমি রাসূলে আকরম নূরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ইসমে আজম সম্পর্কে জানতে আরজ করলাম-জবাবে আল্লাহর হাবীব এরশাদ করলেন- عليك باخر الحشر فاكثر قرأته আর্থাৎ সূরা হাশরের সর্বশেষ আয়াত সমূহের অধিক পরিমাণে তেলাওয়াত করা কে নিজের উপর আবশ্যক করে নাও। এটাই মহান আল্লাহর ইসমে আজম। রাসূলে খোদার দরবারে ইসমে আজম সম্পর্কিত এ প্রশ্ন আমি পরপর আরো দুবার করলাম। জবাবে আল্লাহর রাসুল উপরোক্ত জাবাবই দিয়েছেন। অর্থাৎ সূরা হাশরের সর্বশেষ আয়াত সমূহই ইসমে আজম। সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়তে সূরা হাশর এর সর্বশেষ ছয়টি আয়াতের কথা উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ সর্বশেষ ছয়টি আয়াতই ইসমে আজম। [সা’লবি ও তাফসিরে কাশশাফ] সাহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত মনকুল ইবনে ইয়াছার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলে করীম রউফুর রহিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি সকালে তিন বার اعوذ بالله السميع العليم من الشيطان الرجيم পাঠ করার পর সূরা হাশরের সর্বশেষ তিন আয়াত অর্থাৎ هُوَ اللَّـهُ الَّذِي لَا إِلَـٰهَ إِلَّا هُوَ থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে মহান আল্লাহ তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা নিয্ক্তু করে দিবেন। এসব ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য রহমতের দোয়া করবে। এবং সে দিন যদি ঐ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তবে তাকে শহীদের মর্যাদা দান করা হবে। এবং যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় উপরোক্ত নিয়মে এ তিন আয়াত তেলাওয়াত করবে সেও উক্ত ফজিলত ও মর্তবা লাভ করে ধন্য হবে। [তিরমিজি শরিফ]

লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •