সাহাবায়ে কেরামই সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠতম মুমিন

0
সাহাবায়ে কেরামই সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠতম মুমিন
অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
قَدْ سَمِعَ اللهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللهِ وَاللهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا ۚ إِنَّ اللهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ ﴿١﴾ الَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِنكُم مِّن نِّسَائِهِم مَّا هُنَّ أُمَّهَاتِهِمْ ۖ إِنْ أُمَّهَاتُهُمْ إِلَّا اللَّائِي وَلَدْنَهُمْ ۚ وَإِنَّهُمْ لَيَقُولُونَ مُنكَرًا مِّنَ الْقَوْلِ وَزُورًا ۚ وَإِنَّ اللهَ لَعَفُوٌّ غَفُورٌ ﴿٢﴾ وَالَّذِينَ يُظَاهِرُونَ مِن نِّسَائِهِمْ ثُمَْ يَعُودُونَ لِمَا قَالُوا فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مِّن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۚ ذَٰلِكُمْ تُوعَظُونَ بِهِ ۚ وَاللَّـهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ ﴿٣﴾ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ مِن قَبْلِ أَن يَتَمَاسَّا ۖ فَمَن لَّمْ يَسْتَطِعْ فَإِطْعَامُ سِتِّينَ مِسْكِينًا ۚ ذَٰلِكَ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّـهِ وَرَسُولِهِ ۚ وَتِلْكَ حُدُودُ اللّهِ ۗ وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿٤﴾

আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমাঃ নিশ্চয় আল্লাহ শ্রবণ করেছেন তার কথা, যে (নারী) আপনার সাথে তার স্বামীর বিষয়ে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছে। আর আল্লাহ আপনাদের উভয়ের বাদানুবাদ শ্রবণ করছেন। অবশ্যই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। যারা তোমাদের মধ্যে নিজ স্ত্রীদেরকে নিজের মাতার স্থলে বলে বসে, (মূলত) তারা তাদের মাতা নয়, তাদের মাতাতো হচ্ছে তারাই যারা তাদেরকে জন্মদান করেছে। এবং নিশ্চয় তারা অসমীচীন ও ভিত্তিহীন কথাই বলছে। এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ অবশ্য মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল। এবং যারা আপন স্ত্রীদের কে আপন মাতার স্থলে বলে বসে অতঃপর তারা তাদের ঐ উক্তি প্রত্যাহার করতে চায়, যা তারা বলেছে তবে তাদের উপর (কাফফারা স্বরুপ) অপরিহার্য- একটি ক্রিতদাস মুক্ত করা এর পূর্বে যে, একে অপরকে স্পর্শ করবে। এটা তোমাদের জন্য উপদেশ হবে। এবং আল্লাহ তোমাদের কার্যাদী সম্বন্ধে অবহিত। অতঃপর যে ক্রিতদাস পাইনা, তবে সে লাগাতার দু’মাস রোজা রাখবে এর পূর্বে যে, একে অপরকে স্পর্শ করবে। অতঃপর যে এতেও অক্ষম, সে ষাটজন মিছকিনকে আহার করাবে, এটা এজন্য যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান রাখবে এবং এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।[সূরা আল মুজাদালাহ, ১-৪ নম্বর আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
শানে নুযুল ঃ উদ্ধৃত আয়াত সমূহের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-সাহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত আউছ ইবনে সামেত ও তাঁর বিবি হযরত খাওলাহ বিনতে সা’লাবাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার প্রসঙ্গে আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
একদা হযরত আউছ ইবনে সামেত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন انت على كظهر امي অর্থাৎ তুমি আমার নিকট আমার মাতার পৃষ্ঠদেশের ন্যায়, মানে হারাম। ইসলামপূূর্ব জাহেলী যুগে এই বচনটি স্ত্রীকে চিরতরে হারাম করার জন্য বলা হত, যা ছিল চূড়ান্ত তালাক অপেক্ষা কঠোরতর। এ ঘটনার পর হযরত খাওলাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ বিষয়ের শরীয়ত সম্মত সমাধান লাভের প্রত্যাশায় রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলেন। তখন পর্যন্ত এ বিষয় সম্পর্কে রাসূলে করীমের প্রতি কোন ওহী অবতীর্ণ হয়নি। তাই খাওলাকে উদ্দেশ্য করে রাসূল করীম বলেন- ما امرت فى شانك بشئ حتى الان অর্থাৎ তোমার মাসআলা সম্পর্কে আমার প্রতি এখন পর্যন্ত কোন ওহী অবতীর্ণ হয়নি। খাওলাহ রা. এ কথা শুনে বিলাপ শুরু করে দিলেন-এবং বললেন-আমি আমার যৌবন তার কাছে নিঃশেষ করে দিয়েছি, বার্ধক্যে এসে সে আমার সাথে এ ব্যবহার করেছে। আমি কোথায় যাব। আমার ও আমার বাচ্চাদের ভরণ পোষন কিরূপে হবে। তখন খাওলাহ নবীর আস্তানায় বসে ফরিয়াদ করলেন اللهم اني اشكواليك অর্থাৎ আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অভিযোগ করছি। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত আয়াত সমূহ অবতীর্ণ হয়েছে। [তাফসীরে দুররে মানসুর, ইবনে কাছীর ও নুরুল ইরফান]
قَدْ سَمِعَ اللَّـهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ
উদ্ধৃত আয়াতে উল্লেখিত মহিয়সী নারী- যার ফরিয়াদ শুনে মহান আল্লাহ সূরা মুজাদালাহ এর প্রারম্ভিক আয়াত সমূহ নাযিল করেছিলেন তিনি হলেন সাহাবীয়ে রাসূল হযরত খাওলাহ বিনতে সা’লাবাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। যার বদৌলতে মুসলিম উম্মাহ চিরতরে ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাহ তথা “যিহার” এর সমাধান লাভ করে কৃতার্থ হলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে সান্তনা ও সম্মান দান করে শুধু তার কষ্ট দূর করেন নি বরং তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য আয়াতের শুরুতে বলে দিলেন-“যে রমনী তাঁর স্বামীর ব্যাপারে ওহে রাসূল! আপনার সাথে বাদানুবাদ করছিল আমি আল্লাহ তাঁর কথা শুনেছি।” তাই সাহাবায়ে কেরাম ওই মহিলার প্রতি অত্যন্ত সম্মান প্রদর্শন করতেন। একদিন আমিরুল মুমেনিন সাইয়্যেদুনা ওমর ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একদল লোকের সাথে কোথাও গমন করছিলেন। পথিমধ্যে ওই মহিলা সামনে এসে দন্ডায়মান হলে তিনি দাঁড়িয়ে তার কথাবার্তা শুনলেন। কেউ কেউ বললঃ আপনি এই বৃদ্ধার খাতিরে এতবড় দলকে পথে আটকিয়ে রাখলেন ঃ সাইয়্যেদুনা ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, জানো ইনি কে? ইনি সেই মহিলা, যার কথা মহান আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশের ওপরে শুনেছেন। অতএব আমি কি তাঁর কথা এড়িয়ে যেতে পারি? আল্লাহর কসম, তিনি যদি স্বেচ্ছায় প্রস্থান না করতেন, তবে আমি রাত্রি পর্যন্ত তাঁর সাথে ওখানেই দাড়িয়ে থাকতাম। উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ সেই স্বত্ত্বা পবিত্র, যিনি সব আওয়াজ ও প্রত্যেকের ফরিয়াদ শুনেন। খাওলাহ বিনতে সা’লাবাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যখন রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করছিল, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু এত নিকটে থাকা সত্তেও আমি তাঁর কোন কথা শুনতে পাইনি। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা সব শুনেছেন এবং বলেছেন قَدْ سَمِعَ اللَّـهُ অর্থাৎ মহান আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন
ظهار প্রসঙ্গ
ইসলামী শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের নাম হলো- যিহার। স্ত্রীকে নিজের উপর হারাম করে নেয়ার বিশেষ একটি পদ্ধতিকে যিহার বলা হয়। এটা ইসলাম পূর্বকালে আরব দেশে প্রচলিত ছিল। আর যিহার হলো -স্ত্রীকে স্বামী নিজের মাতার সাথে কিংবা মুহাররামাতের কারো সাথে সম্পূর্ণরূপে কিংবা বিশেষ কোন অঙ্গের সাথে তুলনা করাকে যিহার বলে। যেমন স্ত্রীকে স্বামী বলবে- انت على كظهر امي অর্থাৎ তুমি আমার উপর আমার মাতার পৃষ্টদেশের মত হারাম। যিহার ’ এর বিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ইসলামী শরিয়ত এই প্রথার দ্বিবিধ সংস্কার সাধন করছে। প্রথমতঃ স্বয়ং যিহারের প্রথাকেই অবৈধ ও গুনাহ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, স্বামী-স্ত্রী পরষ্পর বিচ্ছেদ কাম্য হলে তার বৈধ পন্থা হচ্ছে তালাক। সেটা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয় । যিহার কে এ কাজের জন্য ব্যবহার করা সমীচীন নয়। কেননা, স্ত্রীকে মাতা বলা একটি অন্যায় ও মিথ্যা বাক্য। আল্লাহর কুরআন বলেছে- ما هن امهاتهم ان امهاتهم الخ অর্থাৎ তাদের এই অসার উক্তির কারণে স্ত্রী মাতা হয়ে যায় না। মাতাতো সেই যার পেট থেকে ভূমিষ্ট হয়েছে। এবং তাদের এই উক্তি মিথ্যা ও পাপ। কারণ, বাস্তব ঘটনার বিপরীতে স্ত্রীকে মাতা বলেছে।
দ্বিতীয়ত ঃ ইসলামী শরিয়ত এই সংস্কার করেছে যে, যদি কোন মূর্খ অর্বাচীন ব্যক্তি এরূপ করেই বসে, তবে এই বাক্যের কারণে ইসলামী শরিয়তে স্ত্রী চিরতরে হারাম হবেনা। কিন্তু এই বাক্য ব্যবহারের কারণে স্ত্রীকে পূর্ববৎ ব্যবহার করার অধিকারও দেয়া হবেনা। বরং তাকে জরিমানা স্বরূপ কাফফারা আদায় করতে হবে। অতএব সে যদি এ বাক্য প্রত্যাহার করতে চায় এবং পূর্বের ন্যয় স্ত্রীকে ব্যবহার করতে চায়, তবে কাফফারা আদায় করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত স্ত্রী হালাল হবেনা।
যিহার এর কাফফারা ঃ ইসলামী শরিয়তের সিদ্ধান্তানুসারে স্ত্রীর সাথে যিহারকারী ব্যক্তি যদি অনুতপ্ত হয়ে যিহার কে ভঙ্গ করতে চায় এবং স্ত্রীর সাথে পূর্ববৎ স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে ইচ্ছুক হয় তবে তার উপর কাফফারা আদায় করা বাধ্যতামূলক। কাফফারা নি¤œরূপঃ
প্রথমত ঃ فتحرير رقبة অর্থাৎ একটি ক্রিতদাস মুক্ত করে দেয়া। দ্বিতীয়তঃ فمن لم عبد فصيام سهرين متتابعين অর্থাৎ ক্রিতদাস মুক্ত করতে যদি যৌক্তিক কারণে অক্ষম বা অপারগ হয় তবে লাগাতার দু’মাস রোজা পালন করা।
তৃতীয়তঃ فمن لم يستطع فاطعام ستين مسكينا অর্থাৎ বার্ধক্যজনিত কারণে কিংবা দূরারোগ্য ব্যধির কারণে রোজা পালনে অপারগ হলে ষাটজন মিসকিনকে দুবেলা উদরপূর্তি সহকারে আহার করাবে।

লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •