ইমাম আহমদ রেযা (রাহ.)’র জীবনকর্ম
মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
বিশ্বে এমন অসংখ্য জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত ও মহাব্যক্তিত্ব রয়েছে যাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বহুমুখী অবদানের নিরিখে মুসলিম সমাজ তাঁদের চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এদের জ্ঞান গবেষণা মুসলিম জাতির অমূল্য সম্পদ। তাঁদের অনেকে ক্বোরআন সুন্নাহর তাফসীর ও ইলমে ফিকহ শাস্ত্রের ধারক বাহক ব্যাখ্যাকারক ও উদ্ভাবক। ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন, সভ্যতা সংস্কৃতির নির্মাতা, কেউ বিজ্ঞান ও দর্শনের জনক। কেউ ভুগোল ও যুক্তিবিদ্যার পথিকৃৎ। কেউ আবার ধর্মতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। প্রত্যেকেই খোদা প্রদত্ত প্রজ্ঞায় আপন মহিমায় সমুুজ্জল। চতুর্দশ শতাব্দীতে এরূপ এক মহান ব্যক্তিত্বের নাম ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আলোচ্য প্রবন্ধে তাঁর বিশাল কর্মের কিছু দিক আলোকপাত করব।
ইমাম আহমদ রেযার (রাহ.) জন্ম
ভারতের উত্তর প্রদেশে বেরলী শহরে ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরি, মুতাবেক ১৪ জুন ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে শনিবার জোহরের নামাযের সময় ইমাম আহমদ রেযা খাঁন নামে এ মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভার ঘটে। তাঁর কর্মময় জীবনের পরিধি ও অবদান ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আদর্শ ও শিক্ষা প্রচার প্রসারে ক্বোরআন সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, ইসলাম নামধারী ভ্রান্ত মতবাদীদের স্বরূপ উম্মোচন, ইসলামের নামে মুসলিম সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারের বিলুপ্তি করণসহ ইসলামের বহুমুখী খিদমত আঞ্জাম দানে তাঁর অবদান ও ভুমিকা অনস্বীকার্য। তিনি আ‘লা হযরত কলম সম্রাট, মুসলিম জাহানের ইনসাইক্লোপিডিয়া ইমামে আহলে সুন্নাত হিজরি চতুদর্শ শতাব্দীর মুজাদ্দি, দ্বীনের মুজতাহিদ ও মুসলিহ ইত্যাদি বহুমাত্রিক অভিধায় ভূষিত। আরব আজম তথা মুসলিম বিশ্বের উলামা মাশায়েখসহ বুদ্ধিজীবি ও সুধী মহলে তাঁর ভূমিকা স্বীকৃত ও প্রশংসিত। আ‘লা হযরত নিজেই ক্বোরআন মজীদের নিুোক্ত আয়াত থেকে তাঁর হিজরি জন্মসাল বের করেছেন-
اُولَئِكَ كَتَبَ فِىْ قُلُوبِهِمُ الْاِيْمَانَ وَاَيَّدَهُمْ بِرُوحِ مِنْهُ- (المجاداهة: ২২)
অর্থ: ‘তারা হচ্ছেন সেই সব ব্যক্তি যাদের অন্তরে আল্লাহ্ তা‘আলা ঈমানের চিত্র অংকন করছেন এবং নিজ পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য করেছেন।’
আবযাদ হিসাব অনুযায়ী আয়াতে ব্যবহৃত অক্ষর সমূহের মানের সংখ্যার সমষ্টি হল ১২৭২ যা তাঁর জন্মের হিজরি সাল।
মুজাদ্দিদ: আ‘লা হযরত
মুজাদ্দিদের আগমন প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الله عزوجل يبعث لهذه الامة على رأس كل مائة سنة من يجددلها دينها- (رواه ابو داؤد والحاكم و الطبرانى)
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এমন ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিনি এ দ্বীনকে নতুনভাবে সংস্কার সাধন করেন।’
মুজাদ্দিদের মর্মার্থ: মুজাদ্দিদ অর্থ সংস্কারক, তাজদীদুন ক্রিয়ামূলের অর্থ নতুন সৃষ্টি করা। শরয়ী পরিভাষায় দ্বীন বিষয়ে পুনরুজ্জীবন, পূনর্গঠন ও সংস্কার সাধান করা যে সংস্কার কর্মে দ্বীনি কল্যাণ নিহিত রয়েছে। দ্বীনি সংস্কার কর্ম যিনি সম্পাদনকারী ইসলামী পরিভাষায় তিনি মুজাদ্দিদ উপাধিতে ভূষিত।
চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ: আ‘লা হযরত মাওলানা শাহ্ আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরলভী জন্ম ১২৭২ হিজরি। ওফাত ১৩৪০ হিজরি। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ২৮ বছর ২ মাস ২০ দিন পেয়েছেন। মুজাদ্দিদের মহান গুণাবলী ও শর্তাবলী তাঁর সত্তায় পূর্ণমাত্রায় সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর তাজদীদে দ্বীনের খিদমতসমূহ আরব অনারবসহ বিশ্বের খ্যাতিমান শীর্ষ উলামা মাশায়েখ কর্তৃক স্বীকৃত। তিনি আজীবন ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অবিকৃত রূপরেখার আলোকে মুসলিম মিল্লাতকে সঠিক পথের দিশা দেন। পক্ষান্তরে ইসলাম নামধারী ওহাবী-নজদী-খারেজী-রাফেজী-দেওবন্দী-শিয়া ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের কুফরি আকিদা সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক করেন।
আরব দেশের বিখ্যাত আলিম শায়খুল আরব ওয়াল আযম আল্লামা সৈয়্যদ ইসমাঈল ইবনে খলীল মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আ‘লা হযরত প্রণীত ‘হুসামুল হারামাইন’ গ্রন্থের উপর আলোচনা সভায় ১৩২৪ হিজরিতে প্রদত্ত এক অভিমতে নিুোক্ত মন্তব্য করেন-
بل اقول لو فى حقه انه مجدد فى هذا القرن لكان حقا وصدقا-
অর্থ: ‘বরং আমি বলছি তাঁর ব্যাপারে (ইমাম আহমদ রেযা) যদি বলা হয়, তিনি এ যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক তা অবশ্যই বাস্তব ও সত্য।’
আ‘লা হযরত (রাহ.)-এর সংস্কার কর্ম
একজন মুজাদ্দিদ হিসেবে আ‘লা হযরতের সংস্কার কর্মের পরিধি ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। মুসলিম সমাজে বিরাজমান বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটনে আ‘লা হযরতের ভূমিকা ছিল অনন্য। ধর্মীয় চিন্তা চেতনায় তাঁর সংস্কার ও সংশোধনমূলক কার্যাদি তাঁকে একজন সফল সংস্কারকের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। ধর্মীয় সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে তাঁর বৈপ্লবিক সংস্কার তাঁর জীবন দর্শনে প্রত্যক্ষ করি। নিুে তাঁর কতিপয় সংস্কারধর্মী কার্যক্রম আলোকপাত করছি।
১. ফরয পালনে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ: মুসলিম সমাজের এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ইত্যাদি অবশ্যই পালনীয় বিষয়গুলোকে পরিহার করে মুস্তাহাব ও মুবাহ্ নিয়ে ব্যস্ত এবং তারা এতে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। আ‘লা হযরতের দৃষ্টিতে এ আচরণ শরিয়তের সাথে উপহাসের নামান্তর। এতদবিষয়ে তিনি হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রণীত ফতহুল গায়ব গ্রন্থের উদ্ধৃতি বর্ণনা করেন- ‘মুমিনদের প্রথম কর্তব্য হলো ফরয পালন করা। ফরয আদায় হলে, সুন্নাত আদায় করা। অতঃপর নফল ও অপরাপর ফযিলতময় কাজসমূহ পালন করা। ফরয পালন না করে, সুন্নাত নিয়ে ব্যস্ত হওয়া বোকামির শামিল।
২. শরিয়ত ও তরীকতের সমন্বয়ে দ্বীনের পূর্ণতা: কতিপয় লোক শরিয়ত ও তরীকতের মাঝে বিভাজনে লিপ্ত। ইসলামী শরিয়তের মৌলিক নীতিমালাকে উপেক্ষা করে তরীকত অবলম্বনকে যথেষ্ট মনে করে। এ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদনে আ‘লা হযরত কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মতে শরীয়ত ও তরীকত একটি অপরটির পরিপূরক। একটির বর্জন, অপরটির পালন বিভাজনের নামান্তর। বরং শরিয়তের সাথে তরীকতের সমন্বয়ে দ্বীনের পূর্ণতা। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ রেযা ইলমে তাসাউফ ও তরীকত দর্শনের আলোকে সঠিক রূপরেখা উপস্থাপনে নিু লিখিত গ্রন্থসমূহ রচনা করেন।
১. কাশফু হাকায়িক ওয়া আসরারু দাকায়িক।
২. বাওয়ারিক তালুহু মিন হাকীকাতির রূহ।
৩. আত্ তালাততুফ বি জাওয়াবি মাসায়িলিত তাসাউফ।
৪. আকালু উরাফা বি ইজাজি শরয়ী ওয়া উলামা।
৫. নাফাউস সুলাহা ফি আহকামিল বাইয়াতি ওয়াল খিলাফাহ।
৬. আল্ ইয়াকুতাতুল ওয়াসিতাহ্ ফি কালবি আকদীর রাবিতা।
৩. আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে সাজদা করা হারাম: আ‘লা হযরত ক্বোরআন সুন্নাহ্ভিত্তিক শরিয়তের অকাট্য প্রমাণাদির আলোকে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা হারাম সম্পর্কিত ‘আয যুবদাতুয যাকিয়া লি তাহরীমে সাজাদাতিত তাহিয়া’ নামক একটি প্রামাণ্য কিতাব রচনা করেন।
৪. প্রচলিত ওরস ফাতেহা প্রসঙ্গ: শরিয়তের নিয়ম নীতি অনুসরণপূর্বক ইসালে সাওয়াব ওরস ফাতেহা কুলখানি চেহলাম ও ইত্যাদির বৈধতা ইসলামী শরিয়তে অনুমুদিত। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, সমাজে এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আড়ালে বর্তমানে অনেক শরিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটেছে। যেমন ওরসের আয়োজনে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ। নাচ-গান, হাওজি মেলার আসর। আ‘লা হযরত এসবের কঠোর সমালোচনা করেন। এ বিষয়ে ওরস ফাতেহার শরিয়ত বিধান সংক্রান্ত ‘আল্ হুজ্জাতুল ফায়েহা লিতিবীত তায়ীন ফাতেহা’ নামক একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব রচনা করেন।
৫. মাযারে মহিলাদের যাতায়ত: ইসলামে হিজাব তথা পর্দা প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। মোহরিম নয় এমন ব্যক্তির সামনে মহিলাদের আসা যাওয়া, যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মহিলাদের মাযারে যাতায়ত, কবরস্থানে গমন করা নিষেধ। মাযারে মহিলা গমনাগমনের ভয়াবহতা ও করুণ পরিণতির কত বৈচিত্রময় সংবাদ, পত্র পত্রিকায় ও মিডিয়ার সুবাদে আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যা আমাদেরকে মর্মাহত করছে। এতে করে যেমন শরিয়তের বিধান লংঘন হয়, সাথে সাথে আউলিয়া কেরামের প্রতি অমর্যাদা ও অসম্মান প্রদর্শিত হয়। অপর দিকে অলী বিদ্বেষী তরীকত বিরোধী বাতিল পন্থিদের সমালোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে মাযার কর্তৃপক্ষ ও আলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। যিয়ারতের উদ্দেশ্যে নারীদের মাযারে গমনের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত আ‘লা হযরত ‘জামালুন নূর ফি নাহয়িন নিসায়ি আন যিয়ারাতিল কুবুর’ নামক একটি কিতাব রচনা করেন। মদীনা মনোয়ারার রওজা শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যিয়ারত এ নিষেধাজ্ঞার বহির্ভূত। এ ক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য শরিয়তের সীমা রেখায় অবস্থান করে রাওজা মোবারক যিয়ারত করার বৈধতা অসংখ্য হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত।
৬. পর্দাবিহীন পীরের কাছে গমন প্রসঙ্গে: পর্দা বিহীন পীরের দরবারে মহিলাদের গমনাগমন শরিয়ত অনুমোদন করে করে না। আ‘লা হযরতের মতে পীর থেকেও মহিলা মুরিদের পর্দা করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে আ‘লা হযরত ‘মারুজুন নাজাহ্ লি খুরিজিন নিসা’ নামে একটি কিতাব রচনা করেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন দরবারে মহিলাদের গমনাগমন দেখা যায়। দরবারের ঐতিহ্য সুরক্ষায় শরিয়তের নিয়মনীতি অনুসরণ অপরিহার্য। এ ব্যাপারে সুন্নী মতাদর্শী শ্রদ্ধেয় আলিম সমাজকে সঠিক নির্দেশনা প্রচার করতে হবে।
৭. ধর্মীয় পবিত্র দিবসসমূহে আতশবাজি প্রসঙ্গ: মুসলিম সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে বিবাহ্ শাদী, পবিত্র ধর্মীয় দিবসসমূহ প্রসঙ্গত শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা ও মুহররম দিবসে এক শ্রেণীর লোক পটকাবাজি, তাজিয়া মিছিল ইত্যাদি অন্যায় অপকর্মের মাধ্যমে ধর্মীয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ও পবিত্রতা ক্ষুন্ন করে। অপর দিকে আনন্দ উল্লাসের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করে। আ‘লা হযরত এসব নাজায়েয অপকর্ম থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। সামর্থবানদের প্রতি এসব অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধে কর্যকর ভূমিকা পালন করার নির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য কিতাব রচনা করেন ‘হাদীয়ুন নাস ফি রুছূমিল আরাছ।’ এভাবে ধর্মীয় আবরণে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারমূলক অবৈধ কার্য কলাপের বিরুদ্ধে আ‘লা হযরত আজীবন বিভিন্ন মুখী সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর অনুসৃত আদর্শ ইসলামী আদর্শের বাস্তব মডেল ক্বোরআন সুন্নাহভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাঁর অনুসৃত শিক্ষা ও দর্শন মুক্তিকামী সত্যান্বেষী মুসলিম সমাজকে সঠিক পথের দিশা দেয়।
বাতিল পন্থিদের নানামুখী চক্রান্ত প্রতিরোধ
বাতিল পন্থিরা ইসলামের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও ঈমান আকীদা বিরোধী বহুমুখী চক্রান্তে লিপ্ত। যেমন- আল্লাহর একত্ববাদের উপর ধৃষ্টতা, নবীর সমুন্নত মর্যাদায় আঘাত হানা, পুতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারী সত্যের মাপকাঠি সাহাবায়ে কেরামের চরিত্রে কালিমা লেপন করার অপচেষ্টা; অলী, গাউস, আবদাল, উলামা মাশায়েখদের প্রতি অশ্রদ্ধা, মাযহাবের সম্মানিত ইমামদের প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও উদ্যত্ত প্রদর্শন। এহেন নাজুক সন্ধিক্ষণে তাজদারে বেরলভী আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আবির্ভূত হন।
ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম বিকৃতকারীদের সরূপ উম্মোচন করে জাতির সামনে ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের পয়গাম তুলে ধরেন। সত্যকে সত্য- মিথ্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করেন। ইসলামের দাবীদার ছদ্মবেশী মুনাফিকদেরকে তাওবা করার আহ্বান জানান। তারা যখন তাঁর এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করল, কুফরি হতে ফিরে আসা বিদূরিত হলো, তাদের মুসিলম মিল্লাতের ঈমান আকিদা রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়ে তাদের বিরুদ্ধে কুফরি ফাতওয়া প্রকাশ করলেন। শিয়া, খারেজী, রাফেজী, কাদিয়ানী ও দেওবন্দীসহ সকল ভ্রান্ত মতবাদীদের কুফরি প্রমাণে অসংখ্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী রচনা করেন।
আ‘লা হযরতের ব্যক্তিত্বে তিনটি বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ
যখন আমরা পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বশেষ যুগের অবস্থা ও পরিস্থিতির আলোকে আ‘লা হযরত মাওলানা শাহ্ আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর দ্বীনি খেদমতের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তখন তাঁর বহু মাত্রিক ব্যক্তিত্ব ও বহুমুখী খেদমতের ভূমিকা আমাদের বিস্মিত করে তোলে। তাঁর ব্যক্তিত্বে একাধারে বহুবিদ জ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছে। মুজাদ্দিদ, মুজতাহিদ ও মুসলেহ এ তিনটি যোগ্যতা সম্পন্ন গুণ তাঁর জীবন কর্মে সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর ইলমে আকাইদের খেদমত লক্ষ্য করলে তাঁকে একজন সার্থক মুজাদ্দেদ, ইলমে ফিকহ শাস্ত্রে খেদমতের পরিপ্রেক্ষিতে একজন সফল মুজতাহিদ এবং তাসাউফ ও তরীকতের খেদমত পর্যালোচনায় তিনি একজন যথার্থ মুসলেহ্ হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর ব্যক্তিত্ব সর্বদিক দিয়ে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ তরীকতের ছদ্মাবরণে যখন নষ্টামী ও ভণ্ডামি ও শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ তরীকতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছিল এবং সর্বত্র শরিয়ত বর্জনের প্রবণতা প্রবলভাবে প্রাধান্য লাভ করেছিল; তরীকত থেকে শরিয়তকে সুকৌশলে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চলছিল; হিন্দু প্রভাবিত সমাজ ব্যবস্থার এক ক্রান্তিকালে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তা অতুলনীয়।
এভাবে আকাইদের ক্ষেত্রে যখন বিধ্বংসী বক্তব্য পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আড়ালে রেসালতের প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন; শিরক প্রতিরোধের নামে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সমুন্নত মর্যাদার অবমাননা ও পুতঃপবিত্র চরিত্রের কুৎসা রচনা চলছিল, সর্বোপরি মুসলিম মিল্লাতের ঈমানী চেতনাকে ধ্বংস করার প্রয়াসে নানাবিধ চক্রান্ত কাজ করছিল, এমনি এক নাজুক সন্ধিক্ষণে মুসলিম মিল্লাতের অন্তরাত্মাকে নবী প্রেমের প্রেমানলে সিক্ত করেছেন আ‘লা হযরত। ভ্রান্ত মতবাদিদের সকল প্রকার চক্রান্ত প্রতিহত করে মুসলমানদের অমূল্য সম্পদ ঈমান আকিদার সংরক্ষণে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলমি যুদ্ধের অবতীর্ণ হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় দেড় সহস্রাধিক গ্রন্থাবলী রচনা করেন। তাঁর ক্ষুরধার লিখনিতে নবীদ্রোহী, ওহাবী, নজদী, শিয়া, কাদিয়ানী, দেওবন্দীদের স্বরূপ উম্মোচিত হয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর সাহসী পদক্ষেপ ও সমুদয় কর্মকাণ্ডের নিরিখে তিনি মুজাদ্দিদ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর তাজদীদি কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আরব-আজমের উলামা সমাজ কর্তৃক তিনি চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ অভিধায় ভূষিত হন। ইসলামী ফিকহ শাস্ত্র তথা আইন তত্ত্ব বিষয়ে তাঁর সুবিশাল খেদমত তাঁর জ্ঞান ও চিন্তার গবেষণার স্তরকে এত উঁচু মর্যাদায় সমুন্নত করেছে যে, তাঁর যুগের সমগ্র জ্ঞানী বিশেষজ্ঞদেরকে তাঁর তুলনায় নগণ্য ও দুর্বল মনে হয়। ইসলামী ফিকহ্ শাস্ত্রে অনবদ্য কৃর্তি ফতোয়ায়ে রেজভীয়া যা বর্তমানে ত্রিশ খণ্ডে বিন্যস্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। ফিকহে হানাফীর এনসাইক্লোপিডিয়া তথা বিশ্বকোষ বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর ফতোয়া প্রণয়ন ও ফিকহী চিন্তাধারা অনন্য উচ্চতায় স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভে সক্ষম হয়েছে।
উপমহাদেশের হানাফী ফিকহ শাস্ত্রের উপর দুইটি বিশাল গ্রন্থ রচিত হয়েছে। একটি ফতোয়ায়ে আলমগীরি যেটি মূলত চল্লিশজন বিজ্ঞ উলামা-ই দ্বীনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। দ্বিতীয়টি ফতোয়ায়ে রেজভীয়া যা আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর একক প্রচেষ্টা ও জ্ঞান সাধনার ফসল। এ কারণে আল্লামা ইকবলাল তাঁকে যুগের ‘আবূ হানীফা’ বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিশাল গ্রন্থ অধ্যয়নের পর তাঁকে যুগের আবূ হানীফা হিসেবে অকপটে স্বীকার করছি।’ আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাউফিক নসীব করুন। আ-মী-ন।