নবীপ্রেমিক আ’লা হযরত- নূরে জান্নাত নাছরিন

0

নবীপ্রেমিক আ’লা হযরত
নূরে জান্নাত নাছরিন

চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ কলম সম্রাট আ’লা হযরত আহমদ রেযা খাঁন মুহাদ্দিস বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি হচ্ছেন গোটা মুসলিম জাহানের উজ্জ্বল নক্ষত্র। একজন খাঁটি নবীপ্রেমিক, ইসলামী জ্ঞান বিশারদ। তাঁর জন্ম এমনই এক সময় যখন ব্রিটিশরা উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করছিল এবং দীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা ধর্মীয় অঙ্গনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য কিছু ভারতীয় দেওবন্দী ওলামাকে ভাড়া করে তাদের দিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। এরা ক্বোরআন ও সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিচ্ছিলো এবং মুসলমানদের ঈমান আক্বিদা কলুষিত করছিল। বিশেষ করে রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদা খাটো করে এই সব ভাড়াটে মৌলভীরা যখন ফতোয়াবাজি করছিল, ঠিক তখনই বজ্র নিনাদে আ’লা হযরত আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে কলমী যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন। তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে রাসূল প্রেমের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন এবং ঈমান আক্বিদাকে সজীব করেন। বস্তুত তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। ১২৭২ হিজরির ১০ শাওয়াল, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ১০ জুন ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরলভী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আল্লামা নকী আলী খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি। দাদার নাম আল্লামা রেযা আলী খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি। ছোটবেলা থেকে প্রখর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি ১২৯৪ হিজরিতে আলে রাসূল আল্লামা মারহারাভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি-এর হাতে কাদেরিয়া ত্বরিকায় বায়াত গ্রহণ করেন এবং স্বল্প সময়ে খিলাফতের উচ্চ মকামে আসীন হন। মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকে তিনি বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ফতোয়া প্রদান করতে আরম্ভ করেন। ১৩৩০ হিজরিতে ক্বোরআনুল করীমের উর্দু অনুবাদ কান্যুল ঈমান ফি তরজমা-ই ক্বোরআন প্রকাশ করেন। ১৩১৮ হিজরিতে ওলামায়ে হিন্দের পক্ষ থেকে শতাব্দির মুজাদ্দিদ হিসেবে উপাধি লাভ করেন।
আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ৫৫টি শাখা-প্রশাখার উপর প্রায় দেড় হাজার কিতাব রচনা করেন। তিনি রাসূল পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান-মান লিখতেন ডান হাত দিয়ে। আর বাতিল-ফেরকাদের জবাব দিতেন বাম হাতের লেখনির মাধ্যমে। আ’লা হযরতের কবিতা এবং না’তে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিল জ্ঞানের গভীরতা ও নবীপ্রেমের পরিচায়ক। আ’লা হযরত একজন প্রখ্যাত সূফি সাধক ছিলেন। আত্মার উৎকর্ষ সাধন ও মানবিক সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য তিনি ইলমে তাসাউফ চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তিনি তাসাউফ চর্চাকে সকল প্রকার গোঁড়ামী, ভন্ডামী ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে এবং ইলমে তাসাউফ সম্পর্কে সকল প্রকার বিভ্রান্তির অপনোদনে নিয়মিত কলমি জিহাদ চালিয়ে গেছেন। যে সকল তথাকথিত সুফিবাদী ইলমে তাসাউফকে শরিয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন একটা বিষয় বলে মনে করে থাকে এবং শরিয়তের বিধি-বিধান উপেক্ষা করে চলে তিনি তাদেরকে বজ্রকঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন এবং জনগণকে তাদের সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলেছেন। উল্লেখ্য, ইলমে তাসাউফ শরিয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং শরিয়ত হল ইলমে তাসাউফের প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক স্তর। শরিয়ত যথার্থ চর্চা ও অনুশীলন ছাড়া মারেফাত বা খোদা পরিচিতি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। শরিয়ত হলো ইলমে তাফাউফের মূল ভিত্তি। যারা ইলমে তাসাউফের সাথে শরিয়তের কোন সম্পর্ক নেই বলে জাহির করে থাকে তারা নিতান্তই বিপদগামী। ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি বলেন, ‘শরিয়ত হলো মূল, আর ত্বরিকত হল শাখা। শরিয়ত হলো ঝর্ণার উৎস মূল আর ত্বরিকত হলো এ থেকে সৃষ্ট দরিয়া বা সমুদ্র। শরিয়ত থেকে ত্বরিকতকে আলাদা মনে করা অসম্ভব। শরিয়তের উপর ত্বরিকত নির্ভরশীল। শরিয়ত সবকিছুর মূল ও মাপকাঠি। শরিয়ত এমন রাস্তা যা আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। শরিয়ত বাদ দিয়ে মানুষ যে পথ অবলম্বন করে তা আল্লাহ্র পথ থেকে অনেক দূরে। শরিয়ত ভিন্ন এ পথ চলাটা অবৈজ্ঞানিক ও অসম্ভব। আর শরিয়ত অনুসরণ ব্যতীত সকল পথ প্রকৃত অর্থে রহিত ভ্রষ্ট।’ ইল্মে তাসাউফ এর মৌচাক থেকে মধু আহরণের জন্য পীরের নিকট থেকে দীক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃত পীরের সন্ধান পাওয়া বড়ই দুষ্কর। কামালিয়ত হাসিল না করে কিংবা বেলায়াতী শক্তির অধিকারী না হয়েও অনেকেই পূর্ব পুরুষের বুজর্গীর সুবাদে কোন সিলসিলাহ ছাড়া নিজেকে শুধু বংশের ধারায় পীর বলে প্রকাশ করছে এবং ইল্মে তাসাউফ চর্চার সঠিক ধারাকে কলুষিত ও বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি তাই প্রকৃত পীরের যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে প্রধান চারটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের উল্লেখ করেছেন। শর্তগুলো হলো- ক. পীরের সিলসিলাহ্ হযরত রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। সিলসিলাহর ধারায় মাঝখানে কেউ বাদ পড়তে পারবে না।
খ. পীরকে সুন্নিয়তের অনুসারি ও বিশুদ্ধ আক্বিদাধারী হতে হবে।
গ. পীরকে দ্বীনি ইলম, ফিকাহ্ শাস্ত্র, সুন্নি আক্বিদা ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে এবং কুফর, ইসলাম ও গোমরাহীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম হতে হবে।
ঘ. লানতপ্রাপ্ত ফাসেক হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
এভাবে ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সকল প্রকার কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির মূলে কুঠারাঘাত করে ইল্মে তাসাউফের সঠিক স্বরূপ উম্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইল্মে তাসাউফের সঠিক স্বরূপ তুলে তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ১. কাশফে হাকাইক ওয়া আসরার ওয়া দাকাঈক, ২. বাওয়ারিক-ই তুলুহ মিন হাকীকাতির রূহ, ৩. আত্-তালাত্তুর বি জাওয়া-ই মাসায়েল তাসাউফ ও ৪. নূকাউস সুলাফাব ফিল বাইয়াত-ই ওয়াল খুলাফা।
এ সকল পুস্তকাদি পাঠ করলে ইলমে তাসাউফের চর্চাকারীগণ সঠিক পথের সন্ধান পাবে। ১৩৩৪ হিজরিতে সফর মাসে এ মহান মুজাদ্দিদ ও কলম সম্রাট পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। ওফাতের পূর্বে তিনি বলেন, কবরের গর্ত যেন গভীর করে খোঁড়া হয়। কারণ সারা জীবন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়েছি। কবরে গিয়ে কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বসে বসে সালাম দেব। মোটকথা, আ’লা হযরত আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হির পুরা জীবনটাই ছিল নবীপ্রেমে ভরপুর।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •