ঐতিহাসিক ‘গদীর -ই খোম’-এর ঘটনা
[শিয়া সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধারণা ও তার খণ্ডন]
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
[আগামী সংখ্যা সমাপ্য]ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব সমাপন করে আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা তৈয়্যবায় পুনরায় তাশরীফ নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে গদীর – ই খোম নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। এখানে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের উদ্দেশ্যে যেসব ঐতিহাসিক বরকতময় নসীহত করেছিলেন তন্মধ্যে আহলে বায়ত, বিশেষ করে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে কৃত বিশেষ নসীহত ছিলো অন্যতম। বস্তুতঃ এ নসীহত ছিলো হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বিশেষ মর্যাদার প্রতি সাহাবা কেরাম তথা বিশ্ববাসীকে সজাগ করা এবং তাঁর প্রতি ভালবাসাকে সর্বদা অটুট রাখার গুরুত্বকে বিশেষভাবে প্রকাশ করা, যেভাবে অন্যান্য স্থানে হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব, হযরত ওমর ফারুক্ব, হযরত ওসমান এবং অন্যান্য সাহাবা কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-এর মর্যাদার কথা এরশাদ ফরমায়েছেন। তাছাড়া, ঐ নসীহতের পেছনে বিশেষ একটা প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ঐ নসীহত নিঃসন্দেহে এ জন্যই ছিলেনা যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সেদিন ইমাম হিসেবে ঘোষণা করবেন। কারণ, যেই প্রেক্ষাপটে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আন্হু -এর প্রতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন এবং যেই বরকতময় শব্দগুলো তিনি এরশাদ ফরমায়েছেন- তার কোনটাই হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু )-কে ‘ইমাম’ বলে ঘোষণা করার অর্থ প্রকাশ পায়না।
কিন্তু এতদ্সত্বেও মনগড়াভাবে, হঠকারিতা করে মহাভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায় সেই ‘গদীর-ই খোম’-এর ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এমন সব ভ্রান্ত আক্বীদা বা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, যেগুলোকে ইসলামের কোন মুহাদ্দিস বা ফক্বীহ্ কিংবা ইমামই গ্রহণ করেননি; বরং প্রত্যাখ্যানই করেছেন। কারণ, শিয়া সম্প্রদায়ের উক্ত অপব্যাখ্যা বস্তুতঃ ইসলামের মূলনীতিতে কুঠারাঘাত করেছে এবং ইসলামের ইস্পাত কঠিন ঐক্যে চির ধরিয়ে নতুন এক ভ্রান্ত (শিয়া) সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে তাদেরকে পথভ্রান্ত ও ঈমানহারা করার প্রয়াস পেয়েছে।
দুঃখের হলেও সত্য যে, বর্তমানে আমাদের দেশেও সেই ভ্রান্ত সম্প্রদায়টি তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে এদেশেও ঐ ভ্রান্ত আক্বীদা প্রচারের প্রয়াস চালাচ্ছে। এদেশের পত্র-পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে ঐসব বাঙ্গালী এজেন্ট শিয়াদের স্টইলে এ ‘গদীর-ই খোম’ দিবস পালন করে আসছে নির্লজ্জভাবে।
একথা নিশ্চিত সত্য যে, তাদের এ নির্লজ্জতা একদিন এদেশে শিয়া মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে, তাদের দুঃসাহসেই পরিণত হবে- যদি এদেশের সুন্নী মুসলমান তাদের ব্যাপারে কোনরূপ ঔদাসীন্য বা দুর্বলতা প্রদর্শন করেন।
সুতরাং আমি এ নিবন্ধে ইতিহাসিক ‘গদীর-ই খোম’-এর সঠিক ঘটনা তুলে ধরে সেটার আসল তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেলাম, যাতে একদিকে সুন্নী মুসলমানগণ আসল ব্যাপার জানতে ও বুঝতে পারেন, আর অন্যদিকে উন্মোচিত হবে শিয়া সম্প্রদায় ও তাদের দোসরদের আসল স্বরূপ।
ঘটনা
হুযূর-ই করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় হজ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন পথিমধ্যে ‘গদীর-ই খোম’ নামক স্থানে এসে যাত্রা বিরতি করলেন। এটা মক্কা ও মদীনা শরীফের মধ্যভাগে জোহ্ফার আশেপাশেই অবস্থিত। এখান থেকে তিন মাইল দূরে এ ‘গদীর’ অবস্থিত।
এখানে এসে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের দিকে মনোনিবেশ করলেন। আর এরশাদ ফরমালেন-
اَلَسْتُمْ تَعْلَمُوْنَ اَنِّىْ اَوْلى بِالْمُؤْمِنِيْنَ؟
(তোমরা কি জাননা যে, আমি মুসলমানদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক নিকটে?) অন্য এক বর্ণনানুসারে, হুযুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু’র হাত উপরের দিকে তুলে ধরে একথাটি তিন বার বলেছিলেন।
তদুত্তরে, সবাই বললেন, ‘‘হ্যা, নিশ্চয় আপনি সমস্ত মুসলমানদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে ও প্রিয়।”
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, “আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি জিনিষ রেখে যাচ্ছি-তন্মধ্যে একটা অপরটা অপেক্ষা মহান। সে দু’টি হচ্ছে- ১. কোরআন করীম এবং ২. আমার আহলে বায়ত (পরিবার-পরিজন)। আমার পর এ দু’টি সম্পর্কে এ মর্মে সতর্ক থাকবে যে, সে দু’টির সাথে কিরূপ আচরণ করছো? সে দু’টির প্রতি তোমাদের কর্তব্য কিভাবে পালন করছো? আমি চলে যাবার পর এ দু’টির একটা অপরটা থেকে পৃথক হবে না; শেষ পর্যন্ত তোমরা ‘হাওয-ই কাওসার’-এর কিনারায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে।’
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, ‘আল্লাহ্ তা‘আলা আমার ‘মওলা’ (مولى) আর আমি হলাম সমস্ত মুসলমানের মাওলা (مولى)।’ অতঃপর এরশাদ ফরমালেন-
اَللّٰهُمَّ مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ
হে আল্লাহ্! আমি যার ‘মাওলা’ আলীও তার ‘মাওলা’।
اللّٰهُمَّ وَاَلِ مَنْ وَلاَهُ
হে আল্লাহ্! তুমিও তাকেই ভালোবাসা, যে আলীকে ভালবাসে।
وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ
এবং তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করো, যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে।
অন্য বর্ণনায় এটাও এরশাদ হয়েছে-
وَانْصُرْ مَنْ نَصَرَهُ وَاخْذُلْ مَنْ خَذَلَه
হে আল্লাহ! তাকে সাহায্য করো, যে তাঁকে (আলীকে) সাহায্য করে। আর তাকে অপমানিত করো, যে আলীকে ছেড়ে দেয়। আর যেদিকে আলী মনোনিবেশ করে সত্যকেও সেদিকে নিশ্চিত করো।’
এ ঘটনার পর সাহাবা কেরামের মধ্যে হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আলী কাররামাহুল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে সাক্ষাত হলে, তাঁকে মোবারকবাদ দিয়ে বললেন-
هُنِيْئًا يا اِبْنَ اَبِىْ طَالِبٍ اَصْبَحْتَ
وَاَمْسَيْتَ مَوْلٰى كُلِّ مُؤْمِنٍ وَمُؤْمِنَةٍ
অর্থাৎ ‘আবূ তালিব তনয়কে ধন্যবাদ! আপনার সকাল ও সন্ধ্যাতো এমতাবস্থায় হচ্ছে যে, আপনি প্রত্যেক মু’মিন নর-নারীর ‘মাওলা’।
এ হাদীসখানা ইমাম আহমদ হযরত বারা ইবনে আযিব এবং হযরত যায়দ ইবনে আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; যেমন- মিশকাত শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। [মাদারিজুন্ন নুবূয়ত ও আসাহ্হুস্ সিয়র ইত্যাদি]
এখন দেখুন, এ হাদীসের প্রেক্ষাপট কি? মুহাদ্দেসীন কেরাম ও নির্ভরযোগ্য ইমামগণ এ হাদীসের মর্মার্থ কি বর্ণনা করেছেন? পক্ষান্তরে, ভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায় কিভাবে এ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তাদের জঘন্য ভ্রান্ত আক্বীদার জন্ম দিয়েছে?
হাদীসের প্রেক্ষাপট
‘গদীর-ই খোম’-এর খোৎবায় হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিশেষ করে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে উক্ত হাদীস শরীফ এরশাদ করার প্রয়োজনীয়তা কি ছিলো? কোন্ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঐ নসীহত করেছেন? এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজর মক্কী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর ‘সাওয়াইক্বে মুহরিক্বাহ্’ নামক কিতাবে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন হাফেয শামসুদ্দিন জাযারী ইবনে ইসহাক্ব থেকে বর্ণনা করেন, যেসব লোক হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে ইয়েমেন গিয়েছিলেন তাঁদের থেকে কেউ কেউ হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
সহীহ্ বোখারী শরীফের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, হযরত বোরায়দাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর কোন সিদ্ধান্তের কারণে তাঁর সাথে বিরোধ করেন। এ বিরোধিতা পরবর্তীতে শত্রুতায় পরিণত হয়েছিলো। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওফাত শরীফের পূর্বে উক্ত খোৎবা বা ভাষণে সেটার খন্ডন করে ঐ শত্রুতার অবসান ঘটিয়েছিলেন। (কারণ, এর মাত্রও দু’ মাস পরই হুযূর আক্রাম এ পৃথিবী থেকে পর্দা করে অন্তরালে তাশরীফ নিয়ে যান।) সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আ-লিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়াসাল্লাম।
ইমাম যাহাবী হাদীসের উক্ত প্রেক্ষাপটই বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য পেশ করেন। কারণ, হযরত বোরায়দাহ্ রসূলে আক্রামের সামনে অভিযোগ করলে হুযূরের চেহারা আন্ওয়ারের রং পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ হুযূর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে খোদ্ হযরত বোরায়দাহ্ বলছেন-হুযূর এরশাদ ফরমান-
يَا بُرَيْدَةُ اَلَسْتُ اَوْلى بِالْمُؤْمِنِيْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ؟ قُلْتُ
بَلى يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ
(হে বোরায়দাহ্! আমি কি মু’মিনদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে নই?’’ আমি আরয করলাম, ‘‘হাঁ, হে আল্লাহর রসূল!’’ এরশাদ ফরমালেন, ‘‘আমি যার ‘মাওলা’ আলীও তার ‘মাওলা’।’’ আবূ দাউদ সাজিস্তানী আবূ হাতিম রাযী প্রমূখ এই বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আপত্তি করলেও ইবনে হাজার মক্কী লিখেছেন যে, ষোলজন সাহাবী এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর এক বর্ণনায়, ত্রিশজন সাহাবী এটা বর্ণনা করেছেন, ‘আমি রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তা এরশাদ করতে শুনেছি।’
মূলতঃ হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর ফযীলতের পক্ষে এ ঘটনাকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ বর্ণনা বিভিন্ন ‘সনদ’ (সূত্র) দ্বারা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কিছু কিছু হচ্ছে ‘সহীহ্’ (বিশুদ্ধ) আর কিছু কিছু ‘হাসান’ (গ্রহণযোগ্য) পর্যায়ের। এ কারণে এ বর্ণনা নিঃসন্দেহে ‘সহীহ’। তবে এ হাদীসখানা- مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ (অর্থাৎ আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা) ‘খবর-ই ওয়াহিদ’- (خبرواحد)-এর উর্ধ্বে নয়। যেহেতু এ হাদীসের বিশুদ্ধতা নিয়ে হাদীসের কোন কোন ইমাম আপত্তিও উত্থাপন করেছেন, তবুও অন্যান্য সনদ সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে বিধায় সেটা বিশুদ্ধ হলেও ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হতে পারেনা। যদিও শিয়ারা এ হাদীসকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে প্রচার করে। বস্তুতঃ তাদের এ প্রচারণা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। সর্বোপরি, এ প্রচারণা হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এর অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে এটাও প্রনিধানযোগ্য যে, ইমাম বোখারী ঐ ঘটনা বর্ণনাই করেননি। ইমাম মুসলিম অবশ্য তা বর্ণনা করেছেন; কিন্তু হুযূরের খোত্বা বা ভাষণের যেই বচনগুলো তাতে এরশাদ হয়েছে- مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ সেগুলো দ্বারা শিয়াদের ঐ উদ্দেশ্য হাসিল হয় না, যা তারা করতে চায়; বরং তা দ্বারা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফযীলতই প্রকাশ পায় মাত্র।
হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ
এ হাদীস শরীফ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর চূড়ান্ত কারামত ও ফযীলতকে প্রকাশ করে। এটা দ্বারা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাথে ভালবাসা রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পক্ষান্তরে, তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষাই তাতে দেয়া হয়েছে। যেমন অন্য একটা বর্ণনায় এসেছে, ‘‘হযরত আলীর সাথে শুধু ঐ ব্যক্তিই ভালবাসা রাখবে যে মু’মিন হবে। আর তাঁর প্রতি শত্রুতা সে-ই পোষণ করতে পারে, যে মুনাফিক্ব’’। তাছাড়া, হাদীসের ঐ প্রেক্ষপটও একথাই সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করে। এটাই হচ্ছে আহলে সুন্নাতের সর্বসম্মত অভিমত।
শিয়া সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধারণা
কিন্তু সুন্নী মতাদর্শ থেকে বহু আগেই সম্পূর্ণরূপে বিচ্যুত ভ্রান্ত শিয়া সম্প্রদায়টি উক্ত হাদীস ও ঘটনাকে এ মর্মে অকাট্য প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করাতে চায় যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুই ‘ইমাম’ এবং হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অব্যবহিত পরেই তিনি খলিফা (ইমাম)। তারা এটা দ্বারা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার খিলাফতকে তথাকথিত অবৈধ বলে অপপ্রচার চালায়। নাঊযুবিল্লাহ্।
উল্লেখ্য, শিয়ারা তাদের পক্ষে নিন্মলিখিত যুক্তিগুলো উপস্থাপন করারও অপপ্রয়াস চালিয়ে থাকেঃ
এক. হাদীসটা নাকি ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের। (কারণ, শিয়াদের মতে, ‘ইমামত’-এর বিষয়টা শুধু ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হতে পারে।)
দুই. তারা হুযূর পাকের এরশাদ- اَلَسْتُ اَوْلَى بِكُمْ (আমি কি তোমাদের ‘আওলা’ নই?)-এর اَولى (আওলা) পদটি এবং مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُ مَوْلَاهُ (আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা)-এর مولى (মাওলা) পদটি থেকে ‘ইমাম হবার অর্থ গ্রহণ করে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকেই একমাত্র ইমাম বা ‘খলীফা’ বলে প্রমাণ করতে চায়।
খন্ডন
প্রথমতঃ শিয়াদের মতে, ‘ইমাম’ সাব্যস্ত করার বিষয়টি ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের ‘রাওয়ায়ত’ (অর্থাৎ এমন বর্ণনা, যার বর্ণনাকারী প্রতিটি যুগে এতবেশী যে, তাঁদের মিথ্যার উপর একমত হওয়া অসম্ভব। যার ফলে বর্ণনাটিও নাকি এতই বিশুদ্ধ যে, তা দ্বারা পবিত্র ক্বোরআনের আয়াতকেও রহিত বলে ধরে নেয়া যায়।) বস্তুতঃ গদীর-ই খোমের ঘটনা বা বর্ণনাটি ঐ পর্যায়ের নয়; যেমনটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর শিয়ারা তাদের দাবীর সমর্থনে উক্ত বর্ণনাটিকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ের বলে যে ঘোষণা দেয় তা নিছক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যেখানে উক্ত বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে কারো কারো আপত্তি রয়েছে, সেখানে সেটা ‘মুতাওয়াতির’ হবে কোত্থেকে? বর্ণনার বিশুদ্ধতা ইমাম বোখারী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির শর্তানুরূপ নয় বিধায় তিনি সেটা বর্ণনাই করেননি। ইমাম মুসলিমের বর্ণিত হাদীসের বচনগুলোর অর্থ তো শিয়াদের গুহীত অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীতই। তবুও হাদীস বিশুদ্ধ হলেও তা শিয়াদের আক্বীদানুসারে ‘ইমাম’ বানানোর পক্ষে দলীল হবার মতো নয়।
দ্বিতীয়তঃ مولى (মাওলা) শব্দটি একাধিক অর্থবোধক। যেমন- ১. مُعْتَقْ (মু’তাক্ব বা আযাদ) , ২. عَتِيْق (আতীক্ব) অর্থাৎ আযাদকৃত, ৩. ناصر (নাসির বা সাহায্যকারী), ৪. مَحْبُوْبْ (মাহবূব বা প্রিয়) এবং ৫. مُتَصَرِّفُ فِى الْاَمْرِ (অর্থাৎ নিজ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতা প্রয়োগকারী বা নির্দেশদাতা বা নির্দেশ দেয়ার উপযোগী)। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কোনটাই ‘ইমাম হওয়া’ কিংবা ‘খলিফা হওয়া’ (যথাক্রমেخِلاَفَتْ ও اِمَامَتْ)-এর অর্থ অনিবার্যরূপে প্রকাশ করেনা।
তৃতীয়তঃ হ্যাঁ, কিছুক্ষণের জন্য যদি ‘ইমামত’ (ইমাম হওয়া) বা ‘আনুগত্যের উপযোগী হওয়া’-এর অর্থ কল্পনাও করা হয়, তবুও তো তার এ অর্থ নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া যায় না যে, তাৎক্ষণিকভাবে, তখনই তিনি (হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মু’মিনদের খলীফা ছিলেন, এমনকি যখনই হুযূর তা এরশাদ ফরমাচ্ছিলেন। কারণ, তখন তো হুযুর আপন প্রকাশ্য হায়াতে মওজুদ ছিলেন। হ্যাঁ, তখন অর্থ এই হতে পারে যে, তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণের পর তিনি ‘ইমামে হক্ব’ (যথার্থ ইমাম) হবেন, যেমনটি তিনি যথাসময়ে হয়েছিলেন। কাজেই, এটাকে ‘শায়খাইন’ (হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব ও হযরত ওমর ফারূক্ব)-এর খিলাফত ও ইমামতের মোকাবেলায় হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পরপরই বিরতি ছাড়াই হযরত আলী খলীফা হবার পক্ষে দলীলরূপে স্থির করা কোন মতেই শুদ্ধ হবে না। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)
চতুর্থতঃ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- শিয়ারা এ বর্ণনাকে এতই জোরেশোরে হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম)-এর ইমামতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করায়; কিন্তু এটা দেখেনা যে, হুযূর আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাত শরীফের পর যখন ‘খেলাফত’ ও ইমামত’-এর বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিলো তখন না হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু নিজেই ঐ বর্ণনাকে দলীল হিসেবে পেশ করেছেন, না হযরত আব্বাস, না বনূ হাশিম গোত্রের কেউ, না কোন একজন সাহাবীও।
বলাবাহুল্য, ‘সক্বীফাহ্-ই বনী সা‘ইদাহ্’ নামক স্থানে খেলাফতের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। শীর্ষস্থানীয় ‘মুহাজেরীন’ ও ‘আনসার’ সাহাবীগণ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। সর্বোপরি, তাতে ঐসব সাহাবীও শরীক হন, যাঁরা খোদ্ ‘গদীর-ই খোম’-এর ‘খোতবা’ বা ভাষণের সময় উপস্থিত ছিলেন। ঐ খোৎবার পর সময়ও অতিবাহিত হয়েছিলো মাত্র দু’ মাস; কিন্তু কেউ এ ঘটনা ও বর্ণনাকে ইমামতের দলীল হিসেবে পেশ করলেন না, বরং তাঁরা সেটাকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফযীলত নির্দেশক বলেই অভিহিত করেন।
পঞ্চমতঃ এ বর্ণনা সত্ত্বেও খোদ্ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বারংবার সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাউকেও ‘ইমাম’ বা ‘খলীফা’ নিয়োগ করেননি। কারো নামও ঐ পদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেননি। খেলাফতের বিষয়টি উপস্থিত সাহাবা কেরামের পরামর্শানুসারেই হয়েছে। এ মর্মে অগণিত বর্ণনাই হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহু থেকে পাওয়া যায়। নিম্নে কয়েকটা উল্লেখ করা গেলোঃ
* ইমাম যাহাবী উল্লেখ করেছেন, বায্যায ‘হাসান’ পর্যায়ের ‘সনদ’ সহকারে, আর ইমাম আহমদ ‘মজবুত’ সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহু-এর নিকট লোকেরা তাঁকে খলীফা বানানোর দাবী জানালেন। তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর রসূল যেভাবে ঐ বিষয়টি তোমাদের মতামতের উপর ছেড়ে দিয়েছেন আমরাও অনুরূপভাবে সেটা তোমাদের মতামতের উপর ছেড়ে দিলাম।’’ যাযযায থেকে এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায়, যার বর্ণনাকারীগণ হলেন বোখারী শরীফেরও বর্ণনাকারী। তাতে বর্ণিত হয় যে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এরশাদ ফরমান, ‘‘আল্লাহর রসূল কাউকেও খলীফা নিয়োগ করেননি।’’
* দারু ক্বুত্নী, ইবনে আসাকির এবং ইমাম যাহাবী প্রমুখ হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বসরা নগরীতে বর্ণনাটি করেছেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ! আল্লাহর রসূল আমাদের জন্য কারো খিলাফতের ব্যাপারে অঙ্গীকার গ্রহণ করেননি। যদি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অঙ্গীকার নিতেন তবে আমরা (তাকে বাদ দিয়ে) আমাদের ভাই বনী তাইয়্যেম ইবনে মুররাহকে এবং ওমর ইবনুল খাত্তাবকে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিম্বর শরীফের উপর প্রতিনিধিত্ব (খিলাফত) করতে দিতাম না এবং (তাঁরা যদি বিরোধিতা করতেন, তবে) আমাদের এ হাতে তাঁদের সাথে মোকাবেলা করতাম।’’
* আবূ নু‘আয়ম বর্ণনা করেন, হযরত হাসান-আল মুসান্নাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىُّ مَوْلاَهُ (আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা) হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইমামতের প্রমাণ কিনা? তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহর শপথ! যদি ‘মাওলা’ শব্দ দ্বারা রসূলূল্লাহর উদ্দেশ্য ‘আমীর’ কিংবা ‘সুলতান’ (খলীফা) বানানোই হতো, তবে তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তদপেক্ষা সুস্পষ্ট অর্থবোধক শব্দই ব্যবহার করতেন। কারণ, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন فَصِيْحُ الْبَيَانِ (অলংকার সমৃদ্ধ সুস্পষ্ট অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগকারী)।
আর যদি ইমামতের জন্য রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুকে নিয়োগ করে দিতেন, আর হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুও ঐ সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও নীরব থাকতেন এবং রসূলুল্লাহর নির্দেশ বর্জিত হতে দেখে তাতে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকতেন, তবে সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ্গার হযরত আলী কাররামাল্লাহুই হতেন; নতুবা তাতে তাঁর কাপুরুষত্বই প্রমাণিত হতো। (নাউযুবিল্লাহ্) এটাতো কোন অবস্থাতেই হতে পারেনা।’’
মোটকথা, উপরোক্ত বর্ণনা (রেওয়ায়ত) থেকে হযরত আলীকে ইমাম নিযুক্ত করার অর্থ গ্রহণ করা এবং সেটাকে এ মর্মে দলীল হিসেবে পেশ করা কোন মতেই বিশুদ্ধ নয়। তা না আভিধানিকভাবে শুদ্ধ, না ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ। যদি এটা শুদ্ধ হতো তবে সেটার পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে দেখে সাহাবা কেরাম অবশ্যই আপত্তি উত্থাপন করতেন এবং তাঁরা ঐ বিশুদ্ধ অর্থই তা থেকে গ্রহণ করতেন ও হযরত আলী নিজেই। আরো করতেন হযরত আব্বাস। কিন্তু কেউ তো তা করেননি। আর তাও এমনই মুহূর্তে করেননি, যা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিলো। (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম)
অতএব, ‘মাওলা’ مولى শব্দের অর্থ এখানে ‘সাহায্যকারী’ ও ‘প্রিয়’। বাস্তবিকপক্ষে, এ অর্থ গ্রহণ করলে কোন প্রকার অসুবিধারই সম্মুখীন হতে হয়না।
[আস্সাইয়েকুল মুহরিক্বাহ্, মাদারিজুন্নবূয়ত ও আসাহ্হুস্ সিয়ার ইত্যাদি]
সুতরাং শিয়া সম্প্রদায় ও তাদের এজেন্টদেরকে এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নাতের এই বিশুদ্ধ অভিমতকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে তাদের চরম ভ্রান্তি থেকে বিরত হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। ‘চরম ভ্রান্তি’ এ জন্য বললাম যে, তারা ‘গদীর-ই খোম’-এর উপরোক্ত ভাষণ থেকে মনগড়া অর্থ গ্রহণ করে কিংবা অপব্যাখ্যা দিয়ে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরপরই যে শুধু ইমাম বলে বিশ্বাস করে না, বরং তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে সেই ‘ইমামত’-কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নবুয়ত ও রিসালত অপেক্ষাও উত্তম বলার মতো কুফরী মতবাদ সৃষ্টি করে নিয়েছে। এমনকি তাদের কোন কোন বই-পুস্তকে তাই হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপরও সেই ‘ইমামত’কে মেনে নেয়া জরুরী ছিলো বলে নির্ভেজাল কুফরী আক্বীদা প্রচার করার ঘৃণ্য প্রসা চালায়। [আগামী সংখ্যা সমাপ্য]
লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।