পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করা পুণ্যময় ইবাদত
ড. মোহাম্মদ আবদুল হালিম ক্বাদেরী
সৃষ্টি জগতের প্রাণ স্পন্দন তথা মূল হলেন, আমাদের আক্বা-মুনিব, রহমতের ঝর্ণাধারা, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী গুনাহগার উম্মতের সুপারিশকারী, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যাঁকে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ‘নূর’ মোবারক থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর তুলনা বিরল, তিনি আমাদের মত সাধারণ মানুষ নন। তিনি মানবীয় দূর্বলতা থেকে মুক্ত, তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যে বিমুগ্ধ ধরণীতল, তাঁর চরিত্রকে আল্লাহ তা‘আলা “খুলুক্বিন আযীম” তথা মহান চরিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পৃথিবীর মানুষকে সর্বোত্তম গুণে গুণান্বিত করার জন্য, একচ্ছত্র আল্লাহর প্রভুত্ব, একত্ববাদ ও রিসালতের সুশীতল ছায়ায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি মানব জাতিকে সরল সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন, দোযখী মানুষকে বেহেশতী বানিয়েছেন। পৃথিবীবাসীকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। একটি সভ্য জাতির গোড়াপত্তন করেছেন। অতীতের সমন্ত ধর্মকে রহিত করে আল্লাহর একমাত্র মনোনিত ধর্ম “ইসলাম”কে বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিরক ও কুফরের অমানিশা থেকে মানব জাতিকে মুক্ত করেছেন। যাঁর উসিলায় আল্লাহ তা‘আলা এ কুলকায়েনাত সৃজন করেছেন। এমন নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম বা শুভাগমনে স্বভাবত খুশীতে আত্মহারা হবে ধরণীতল। তাঁর এ শুভাগমনকে মুসলিম জাতি পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিসেবে মহাধুম-ধামে, ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভাব-গাম্ভির্য, বড় মুহাব্বত, আন্তরিকতা, খুলুসিয়াত ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে আসছেন। এ ঈদ পালন করার বৈধতা, ফযীলত ও করণীয় সম্পর্কে আমাদের ক্ষুদ্র-প্রয়াস নিম্নে উপস্থাপন করা হল।
ঈদ শব্দের অর্থ :
عيد শব্দটি আরবি, যার অর্থ হল- খুশী, আনন্দ, উৎসব, পর্ব, মৌসুম। মুনজিদ গ্রন্থকার বলেন,
عيد- اعياد : كل يوم يحتفل فيه بذكرى كريمة او حبيبة
ঈদ একবচন, বহুবচনে ‘আইয়াদ : অর্থাৎ এমন অনুষ্ঠান যা প্রিয়তমের স্মরণে আয়োজন করা হয়।
বিখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবন মনযুর বলেন, العيد كل يوم فيه جمع ‘সমবেত হওয়ার প্রত্যেক দিনকে ঈদ বলা হয়’।
মুফতি আমীমুল ইহসান রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, العيد كل يوم فيه جمع او تذكار لذى فضل ‘কোন মর্যাদাবান ব্যক্তিকে স্মরণের দিন বা সমবেত হওয়ার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়’।
আর جشن শব্দটি ফার্সী, যা উর্দু ভাষায় ব্যবহৃত হয় অর্থ, উৎসব, আনন্দ, খুশীর নিমিত্তে উৎসব পালন করা। এর মধ্যে বলা হয়েছে, جشن শব্দের অর্থ অর্থাৎ আনন্দ প্রকাশের নিমিত্তে যে মাহফিল বা সভা।
মাওলভী ফিরোজ উদ্দীন বলেন, جشن শব্দের অর্থ
অর্থাৎ আনন্দ প্রকাশের জন্য সভা, বৈঠক অথবা আহ্বান করা ইত্যাদি।
অর্থাৎ খুশীর দিন-ঈদের দিন। (আনন্দ-উৎসবের দিন)
ميلاد মীলাদ অর্থ জন্ম, জন্মকাল, জন্ম তারিখ ইত্যাদি।
বিখ্যাত অভিধানবেত্তা আল্লামা ইবন মনযুর রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
وميلاد الرجل : اسم الوقت الذى ولد فيه ‘এবং মানুষের মীলাদ ঐ সময়ের নাম যে সময় সে জন্মগ্রহণ করেছে’।
সুতরাং জশনে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অর্থ দাঁড়াবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভ জন্ম বা শুভাগমন উপলক্ষে খুশী উদযাপন করা।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছেন সব নবীর শেষে কিন্তু তাঁর সৃষ্টি সকল সৃষ্টির পূর্বে। এ বিষয়ে হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য।
عن جابر رضى الله تعالى عنه قال : سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن اول شئ خلقه الله تعالى ؟ فقال : هو نور نبيك يا جابر خلقه الله ، ثم خلق فيه كل خير، وخلق بعده كل شئ ـ
“হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে প্রশ্ন করলাম, অতঃপর উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমার নবীর নূরই সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন। তারপর এতে প্রত্যেক কল্যাণ ও মঙ্গল সৃষ্টি করেছেন, তাঁর পরেই প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছেন।”
হাদীসটি বিখ্যাত মুহাদ্দিস, ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর দাদা উস্তাদ ইমাম আবদুর রায্যাক্ব রহমাতুল্লাহি আলায়হি মা‘মার হতে, তিনি মুহাম্মদ ইবন মুনকাদির হতে, তিনি হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে আল-মুসান্নাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, বৈরুত থেকে প্রকাশিত আল-মুসান্নাফ গ্রন্থে এগারটি হাদীস অসাবধানতাবশত মুদ্রণ থেকে বাদ পড়ে গেছে। বাদ পড়ে যাওয়া ঐ এগারটি হাদীস দুবাই ইমাম মালিক শরীয়্যা ওয়াল কানুন ডিপার্টমেন্টের সাবেক ডীন এবং দুবাই দাইরাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ূনিল ইসলামীয়্যার সাবেক চেয়ারম্যান ড. ঈসা ইবন আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন মানি‘ আল হিময়ারী সাহেব সংগ্রহ করে ১৪২৫/২০০৫খৃ. সালে الجزء المفقود من الجزء الاول من المصنف ـ (আল-জুযউল মাফকূদ মিনাল জুযয়িল আওয়াল মিনাল মুসান্নাফ) নামে প্রকাশ করেছেন।
তাছাড়াও বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও হাদীস সমালোচক ইমাম বায়হাক্বী রহমাতুল্লাহি আলায়হি দালাইলুন নবুয়্যত গ্রন্থে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আহমদ ইবন মুহাম্মদ ক্বাস্তলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাওয়াহিবুল লাদুন্নীয়া গ্রন্থে, ইমাম ইবন হাজর মক্কী রহমাতুল্লাহি আলায়হি আফদ্বালুল কুরা গ্রন্থে, আল্লামা ফাসী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাত্বালিউল মুসিররাত গ্রন্থে, আল্লামা সারক্বাসী শারহুল মাওয়াহিব গ্রন্থে, আল্লামা সিয়ারে বিকরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি আসীম গ্রন্থে শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাদারিজুন নবুয়্যত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। অসংখ্য মুহাদ্দিস মুফাস্সির ইসলামী চিন্তাবিদ হাদীসটি সনাদান ও মতনান গ্রহণ করেছেন। ফলে হাদীসটি تلقى الامة بالقبول তথা সর্বজন গৃহীত হাদীস এর মর্যাদায় উপনীত হয়ে ‘হাসান’ স্তরে উপনীত হয়েছে। আর এ স্তরে উন্নীত হাদীসের সনদ বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে না। এমতাবস্থায় সনদ দূর্বল হলেও বিশ্বাস ও আমল করতে কোন সমস্যা নেই।
সুতরাং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নূরের তৈরী মহা মানব তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তাঁর সে মহান ‘নূর’ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে এরশাদ করেছেন, قد جاءكم من الله نور وكتاب مبين ـ
“নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ‘নূর’ এসেছে এবং সুস্পষ্ট কিতাব।”
উক্ত আয়াতের তাফসীরে মুফাসসিরকুল শিরোমণি হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এখানে ‘নূর’ দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। আর ‘কিতাব’ দ্বারা আল-কুরআনকে বুঝানো হয়েছে।
তাছাড়াও ইমাম ত্বাবারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর বিখ্যাত তাফসীর জামিউল বয়ান আত-তা‘বীলী আয়িল কুরআন গ্রন্থে, ইমাম মহিউস সুন্নাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর মা‘আলিমুত তানযীল গ্রন্থে, ইবন জাওযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর গ্রন্থে, ইমাম খাযিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর মুখতাসারু তাফসীরীল খাযিন গ্রন্থে, ইমাম জুমাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘আল-ফুতুহাতুল ইলাহিয়্যাতি গ্রন্থে, ইমাম ফখর উদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘তাফসীরে কবীর’ গ্রন্থে, সৈয়্যদ মুহামূদ আলূসী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর রূহুল মা‘আনী গ্রন্থে উক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘নূর’ দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই উদ্দেশ্য বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর সে মহান ‘নূর মোবারক’ থেকে আল্লাহ তা‘আলা অপরাপর সব সৃষ্টি সৃজন করেছেন।
সে নূর মোবারক মানবীয় আকৃতিতে ১২ই রবিউল আওয়াল ৫৭০খৃ. সালে পবিত্র মক্কা নগরীতে সোমবার সুবহে সাদেকের সময় কামলে ওয়ালা নবী এ পৃথিবীতে তাশরীফ নিয়ে এসেছেন। তাঁর শুভাগমনে কুলকায়েনাত মহা খুশীতে আত্মহারা কিন্তু এক কমবখত শুধু দুঃখে শোকে ক্রন্দন করেছে। সে হল মালাউন ইবলিস শয়তান।
সুতরাং যে মহান সুবহে সাদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে তাশরীফ নিয়ে এসেছেন সে রাতটি শবে কদরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ বিষয়ে ইমাম কাস্তুলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
اذا قلنا بانه عليه الصلاة والسلام ولد ليلا فايما أفضل ليلة القدر او ليلة مولده عليه الصلاة والسلام ، قلت : أجيب بان ليلة مولده عليه الصلاة والسلام افضل من ليلة القدر من وجوه ثلاثة ـ
أحدها ان ليلة المولد ليلة ظهوره صلى الله عليه وسلم وليلة القدر معطاة له وما شرف لظهور ذات المشرف من اجله اشرف مما شرف بسبب انه اعطيه ولا نزاع فى ذلك ، فكانت ليلة المولد افضل من ليلة القدر ـ
الثانى ان ليلة القدر شرفت بنزول الملائكة فيها وليلة المولد شرفت بظهوره صلى الله عليه وسلم فيها وما شرفت به ليلة ليلة المولد افضل مما شرفت به ليلة القدر على الاصح المرتضى أى عند جمهور اهل السنة فتكون ليلة مولد افضل ـ
الثالث ليلة القدر وقع تفضل بها على امة محمد صلى الله عليه وسلم وليلة المولد الشريف وقع التفضل بها على سائر الموجودات فهو صلى الله عليه وسلم الذى بعثه الله تعالى رحمة للعالمين فعمت به النعمة جميع الخلائق فكانت ليلة المولد اعم نفعا فكانت افضل من ليلة القدر بهذا الاعتبار ـ
যখন আমরা বললাম, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের শেষাংশে দুনিয়াতে তশরীফ নিয়ে এসেছেন, এখন প্রশ্ন হল-সে মহান রাত শ্রেষ্ঠ নাকি লাইলাতুল কদর শ্রেষ্ঠ ? এর উত্তরে আমি বলব তিনটি কারণে মীলাদুন্নবীর রাত শ্রেষ্ঠ।
১. মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাত ঐ রাত যাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আত্ম প্রকাশ ঘটেছিল। আর লাইলাতুল কদর ঐ রাত যা হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করা হয়েছে। সুতরাং যে রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আত্ম প্রকাশের শরাফত লাভ হয়েছে সে রাত ঐ রাত থেকে শ্রেষ্ঠ যে রাত তাঁর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কারণে মুসলিমগণ প্রাপ্ত হয়েছে। এতে কোন দ্বন্ধ নেই,সুতরাং নিঃসন্দেহে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাত লাইলাতুল কদর থেকে উত্তম।
২. যদিও বা লাইলাতুল কদরে ফিরিস্তা অবতীর্ণ হওয়ার কারণে ফযীলত মন্ডিত। অনুরূপভাবে মীলাদুন্নবীর রাতেও ফিরিস্তা অবতীর্ণ হয়েছিল। সেহেতু সে রাতে আল্লাহর মাহবুব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জলওয়া আফরোজ হয়েছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অধিকাংশ আলেমের মতে সে কারণে ঐ রাত ফযীলত মন্ডিত ঠিক একই কারণে মীলাদুন্নবীর রাতের ফযীলত মন্ডিত।
৩. লাইলাতুল কদরের কারণে উম্মতে মুহাম্মদীয়াকে সম্মান-মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। অপরদিকে মীলাদুন্নবীর কারণে সমগ্র সৃষ্টি ফযীলত লাভ করেছে। একমাত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র সৃষ্টির জন্য করুণার আধার রহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তো ঐ নিয়ামতকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং মীলাদুন্নবীর রাত অধিক উপকার প্রদান করেছে বিধায় তা লাইলাতুল কদর থেকে শ্রেষ্ঠ।
ইমাম ত্বাহাভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি কিছু আলেম থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
ان اقفل الليالى ليلة مولده صلى الله عليه وسلم ثم ليلة القدر ثم ليلة الاسراء والمعراج ثم ليلة العرفة ثم ليلة الجمعة ثم ليلة النصف من شعبان ثم ليلة العيد ـ
“সর্ব শ্রেষ্ঠ রাত হল মীলাদুন্নবীর রাত, তারপর শবে কদর, তারপর শবে মি‘রাজ, তারপর জুমার রাত, আরাফার রাত, তারপর শবে বরাত তারপর ঈদের রাত ফযীলত মন্ডিত।”
ইমাম ইউসুফ নাবহানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় বিখ্যাত কিতাব আল-আনোয়ারুল মুহাম্মদীয়া গ্রন্থে বলেন,
و ليلة مولده صلى الله عليه وسلم افضل من ليلة القدر ـ
“মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাত লাইলাতুল কদরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ” লাইলাতুল কদরের রাতে ফিরিস্তা অবতীর্ণ হওয়ার কারণে এবং হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার কারণে ফযীলত মন্ডিত। আর জাতে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফযীলত হল সত্তর হাজার ফিরিস্তা সকাল বেলা এবং সত্তর হাজার ফিরিস্তা বিকাল বেলায় অবতরণ করে রাওদ্বা আক্বদাস প্রদক্ষিণ-তাওয়াফ করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আলীশান দরবারে ফরিয়াদ করে চলে যায়। এ ধারাবাহিকতা কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। এক লক্ষ চল্লিশ হাজার ফিরিস্তা যারাই একবার আসবেন তারা আর কিয়ামত পর্যন্ত সুযোগ পাবেন না। আর ফিরিস্তারা হলেন দরবারে রিসালতের খাদেম। ফিরিস্তা অবতীর্ণ হলে সে রাত হাজার মাস থেকে উত্তম হয়ে যায়। আর যে সময় সমগ্র সৃষ্টি জগতের প্রাণ স্পন্দন আগমন করেছেন তাঁর ফযীলত কি নেহায়েত কম হবে ? তাঁর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুভাগমনের রাত তাঁর শুভাগমনের মাস হাজারো রাতের চেয়ে, হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
গূঢ় রহস্য হল, শবে কদরের ফযীলত শুধু ঈমানদারের জন্য নির্দিষ্ট যাতে মানবতা বঞ্চিত, কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের কারণে ফদ্বল ও রহমত শুধু ঈমানদারের জন্য নয় বরং সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য প্রযোজ্য। তাঁর শুভাগমন সমগ্র সৃষ্টিকুলের জন্য আল্লাহর রহমত ও ফদ্বল। তাঁর শুভাগমনে খুশী উদযাপন করলে সাওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে। তবে একথা বলে আমরা লাইলাতুল কদরের মাহাত্ম ছোট করে দেখছি না বরং আমরা এটাই বলতে চাচ্ছি লাইলাতুল কদর মরতবা ওয়ালা হয়েছে প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কারণে। অতএব বুঝা গেল মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাত-ই সর্বশ্রেষ্ঠ ফযীলত মন্ডিত।
তাই বাস্তব কথা হল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার কারণে, ফিরিস্তা অবতীর্ণের কারণে লাইলাতুল কদর মহিমান্বিত অনুরূপভাবে কুরআনের মালিক নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের কারণে মীলাদুন্নবীর রাতের হাজার গুণ বেশি মহিমান্বিত।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার সর্বশ্রেষ্ঠ নি‘আমত হলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
“এবং নিজেদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো-যখন তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ছিলো, তিনি তোমাদের অন্তরগুলোকে সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। সুতরাং তাঁর অনুগ্রহক্রমে তোমরা পরস্পর ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছো।”
আল্লাহ তা‘আলার বড় নি‘আমত হল ভেঁঙ্গে যাওয়া অন্তরযুগলকে আবার জোড়া দিয়েছেন, একে অপরের রক্ত পিপাসু থেকে আপন ভাইয়ের মত করে দিয়েছেন, ঘৃণা-বিদ্বেষকে ভালবাসা ও মুহাব্বতে পরিণত করে দিয়েছেন। এটাও বুঝতে হবে এ নি‘আমত নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান আনয়নের কারণে স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
আর আল্লাহ তা‘আলা এ নি‘আমতের খোঁটা দিয়েছেন মু’মিনদের উদ্দেশ্যে। যেমনটি তিনি এরশাদ করেছেন,
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُواْ عَلَيْهِمْ ا يَاتِه وَيُزَكِّيْهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“নিশ্চয় আল্লাহ মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের উপর যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের উপর তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন।”
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, উম্মতে মুসলিমার উপর আমার বড় ইহসান, পুরস্কার ও বখশিশ হল আপন মাহবুব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাদের জান থেকে তোমাদের জন্য পয়দা করেছেন, এর ফলে মানব জাতিকে আল্লাহ তা‘আলা বড় সম্মানিত, বড় মহিমান্বিত করেছেন। যাঁর সৃষ্টির কারণে কুলকায়েনাত অস্তিত্বে এসেছেন। যিনি না হলে আল্লাহ তা‘আলা কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তাঁর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মর্যাদা, ফযীলত মরতবা সবার উর্ধ্বে, যাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তাঁর মত করে কাউকে সৃষ্টি করা হয়নি। সুতরাং তাঁর শুভাগমনে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা মানে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করা।
আর শুকরিয়া আদায় করার জন্য মহান রববুল আলামনীন কুরআন মাজীদে তাগাদা দিয়েছেন। যেমনটি তিনি বলেছেন,
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে আমি তোমাদেরকে আরো অধিক দেবো এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি কঠোর।”
অর্থাৎ নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা নি‘আমত আরো বাড়িয়ে দেন। আর নি‘আমতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আল্লাহ তা‘আলা কঠোর শাস্তি প্রদান করেন।
নি‘আমতের স্মরণ করে শুকরিয়া আদায় করা শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরয নয় বরং পূর্ববর্তী নবীর উম্মতের উপরও ফরয ছিল। যেমন বণী ইসরাইলকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
“হে ইয়া‘কুবের বংশধরগণ! স্মরণ করো, আমার সেই অনুগ্রহকে যা আমি তোমাদের উপর করেছি। আর একথাও যে, আমি এ সমগ্র যুগের উপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।”
আর নি‘আমত প্রাপ্তিতে খুশী উদযাপন করা আম্বিয়াগণের (আ.) সুন্নাত। যেমন হযরত ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর দরবারে যখন উম্মতের জন্য খাবার চেয়েছিলেন তখন এভাবে আরয করেছেন।
“হে আল্লাহ, হে প্রতিপালক! আমাদের উপর আকাশ থেকে একটা ‘খাদ্য-খাঞ্চা’ অবতরণ করুন, যা আমাদের জন্য ঈদ (আনন্দ-উৎসব) হবে-আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য এবং আপনারই নিকট থেকে নিদর্শন।”
এ আয়াতে করীমায় মহান আল্লাহ একজন নবীর মাধ্যমে এ পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন যে, যেদিন আল্লাহর নি‘আমত প্রাপ্ত হবে সেদিন ঈদ-খুশী উদযাপন কর।
আয়াতের মধ্যে اولنا এবং اخرنا শব্দদ্বয়ের মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যারাই আগমন করবেন আল্লাহর নি‘আমত প্রাপ্তিতে শুকরিয়া আদায় করবেন।
এ নি‘আমতের শুকরিয়ার কিছু পদ্ধতি আছে। যেমন-
১. নি‘আমতের স্মরণ করা ২. নি‘আমতের খুব চর্চা করা বা প্রকাশ করা ৩. ঈদ পালন করা ৪. ইবাদত-বন্দেগী করা ৫. খুশী উদযাপন করা।
এখানে খুশী উদযাপনের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
“আপনি বলুন! ‘আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।”
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা قل (কুল) শব্দ যোগে আয়াত আরম্ভ করেছেন, যা নির্দেশ সূচক। কুরআনে যেখানেই قل শব্দ বলা হয়েছে সেখানের বিষয়বস্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূলভিত্তি। যেমন- আল্লাহর একত্ববাদ প্রকাশের জন্য আল্লাহ তা‘আলা قل শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন, “قل هو الله احد মাহবূব বলেদিন আল্লাহ এক।”
আল্লাহর মুহাব্বত অর্জনের পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ এরশাদ করেছেন,
“হে মাহবুব! আপনি বলে দিন, ‘হে মানবকুল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাকো তবে আমার অনুগত হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন।”
সুতরাং ‘ قل ’ শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ তা‘আলা ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করার কথা বলছেন। আর সেটি সমস্ত ইবাদত থেকে শ্রেষ্ঠ। উক্ত আয়াতে فضل الله ও برحمته শব্দ দু’টির দিকে মনোনিবেশ করলে একথাই বুঝা যাবে যে, আল্লাহর ফদ্বল (فضل الله) দ্বারা ইলম উদ্দেশ্য আর রহমত (برحمته) দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দশ্য। বিখ্যাত মুফাসসির সৈয়্যদ মাহমূদ আলূসী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
واخرج ابو الشيخ عن ابن عباس رضى الله تعالى ان الفضل العلم والرحمة محمد صلى الله عليه وسلم واخرج الخطيب وابن عساكر عنه تفسير الفضل بالنبى عليه السلام
“আবু শায়খ রহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করছেন, আয়াতে বর্ণিত ‘ফদ্বল’ দ্বারা ইলম এবং ‘রহমত’ দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য। খত্বীব বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও ইবন আসাকির রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘ফদ্বল’ দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য করেছেন।”
ইমাম জালালুদ্দী সুয়ূত্বী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,
واخرج ابو الشيخ عن ابن عباس رضى الله عنه فى الاية قال : فضل الله العلم ورحمته محمد صلى الله عليه وسلم قال تعالى (وما ارسلنك الا رحمة للعالمين) الانبياء ـ ১০৭
“আবু শায়খ রহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করছেন, উক্ত আয়াতের মধ্যে ‘ফদ্বলুল্লাহ’ বলতে ইলম ‘ওয়া রাহমাতুহু’ বলতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সুরা আম্বিয়া (আয়াত নং ১০৭) এর মধ্যে বলেন, হাবীব আপনাকে জগত সমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।
ইমাম আবু হাইয়্যান আন্দুলুসী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ইমাম দ্বাহহাক রহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করছেন,
قال ابن عباس فيما روى الضحاك عنه الفضل العلم و الرحمة محمد صلى الله عليه وسلم ـ
“হযরত ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘ফদ্বল’ অর্থ ইলম এবং ‘রহমত’ অর্থ মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।”
ইমাম ইবন জাওযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও ঐ একই কথা নকল করে বলেন,
ان فضل الله العلم ورحمته محمد صلى الله عليه وسلم رواه الضحاك عن ابن عباس ـ
“নিশ্চয় ‘ফদ্বলুল্লাহ’ বলতে ইলম এবং ‘আল্লাহর রহমত’ বলতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য।”
ইমাম আবু জাফর বাকের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ فضل الله ” দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা‘আলা অপর আয়াতে সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেমন
“এবং যদি তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ এবং দয়া না হতো, তবে অবশ্যই তোমরা শয়তানের অনুসরণ আরম্ভ করতে। কিন্তু অল্প সংখ্যক লোক।”
আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত সাহাবী ও আম মূ’মিনদের উদ্দেশ্য করে এ কথা বলেছেন, তিনি আপন হাবিব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনকে নিজের ফদ্বল-দয়া আখ্যায়িত করে বলেন, আমার হাবিব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাদের নিকট তশরীফ না নিতেন তাহলে তোমাদের মধ্যে অধিকাংশ গোমরা হয়ে যেত। আমার হাবিব তোমাদের প্রতি প্রেরিত হওয়া আমার ফদ্বল তথা বড় দয়া। নচেৎ তোমরা শিরক ও কুফুরীর মধ্যে নিমজ্জিত থাকতে। আমার হাবিবের উসীলায় হেদায়ত নসীব হয়েছে। আর ‘রহমত’ বলতেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দেশ্য। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন। [আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং ১০৭, পৃ. ৬০৪।]
“এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি কিন্তু রহমত করে সমগ্র বিশ্ব-জগতের জন্য।”
আর ‘রহমত’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম নাম। যা আল্লামা আলূসী রূহুল মা‘আনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আর এ রহমত সমস্ত বস্তু থেকে প্রশস্থ। যেমন-আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন।
[আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা আরাফ, আয়াত নং ১৫৬, পৃ. ৩১১]
“আমার দয়া প্রতিটি বস্তুকে ঘিরে রয়েছে।” মোদ্দা কথা হল- قل بفضل الله আয়াত দ্বারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ই উদ্দেশ্য। সুতরাং তাঁর শুভাগমনে খুশী উদযাপন করার জন্য আল্লাহর বিশেষ নিদের্শনা রয়েছে।
মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন এটা নতুন কোন নিয়ম নয়। যুগ যুগ ধরে এটা উদযাপিত হয়ে এসেছে। যেমন এ বিষয়ে ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী রহমাতুল্লাহি আলায়হি একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন, যার নাম حسن المقصد فى عمل المولد “হুসনুল মাকসাদ ফী আমলিল মাওলিদ”। এ কিতাবে তিনি মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বৈধতার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
ان اهل عمل المولد الذى هو اجتماع الناس وقراءة ما تيسر من القران، ورواية الاخبار الواردة فى مبدأ (أمر) النبى صلى الله عليه وسلم، وما وقع فى مولده من الايات، ثم يمد لهم سماطا يأكلونه، وينصرفون من غير زيادة على على ذلك من البدع (الحسنة) التى يثاب عليها صاحبها لما فيه من تعظيم قدر النبى صلى الله عليه وسلم ، وافلهار الفرح والاستبشار بمولده صلى الله عليه وسلم الشريف ـ
মূলতঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের দিন আনন্দ ও খুশী উদযাপনের এমন এক সুযোগ যাতে মানুষ একত্রিত হয়ে কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত করে, ঐ সব হাদীস শরীফ বর্ণনা করা হয় যা তাঁর (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে, এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুভ জন্ম মোবারকের উপর প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনাবলী বর্ণনা হয় অতঃপর পছন্দনীয় খানা-পিনার মাধ্যমে যিয়াফত করা হয়। এটা এমন একটি বিদ‘আতে হাসানা যা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানার্থে তাঁরই শুভাগমনে আনন্দ ও খুশী প্রকাশের কারণে পুণ্যময় ও সাওয়াব পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে হাফিয ইবন হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হিও মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দিয়েছেন। হাফিয শামসুদ্দীন জাযরী রহমাতুল্লাহি আলায়হিও মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়ে عرف التعريف بالمولد الشريف নামক গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেছেন।
মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ বিষয়ে অপর একটি কিতাব রচনা করেছেন, যার নাম الورد الروى فى مولد النبى صلى الله عليه وسلم ـ। তাছাড়াও আরো অনেক ইসলামী চিন্তাবিদ মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেছেন। সুতরাং মীলাদুন্নবী উদযাপনে আমাদের কি করণীয় সেটা হল ১২ই রবিউল আওয়াল তারিখে শানদার ভাবে, ভাব-গাম্বির্য, ভক্তি-শ্রদ্ধা, আন্তরিক মুহাব্বতের সাথে ঝাকজমক পূর্ণ ,আনন্দঘন পরিবেশে কুরআন তেলোয়াত, না‘তে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম , হামদে বারি তা‘আলা, গজল, ইসলামি সংগীত, মীলাদ মাহফিল, সালাতু সালাম , ওয়াজ-নছিহত, সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সেম্পোজিয়ম, কনপারেন্স, জুলুশ বা আনন্দ র্যালী, খানা-মেজবানি, তাবারুকাত, দান-খায়রাত করা, শুভেচ্ছা বিনিময় করা, বাড়ি-ঘর, মসজিদ-মাদ্রাসা, খানাকা, দরগাহ-মাজার ইত্যাদি আলোকসজ্জা করা অতীব পুণ্যময় আমল। আল্লাহ তাআলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইশক্ব ও মুহাব্বত নিয়ে নেক আমলগুলোর করার তাওফিক দান করুন । আমিন ।
টিকা:
. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান : আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান, পৃ. ৭১৯।
. আল-মুনজিদ,(আরবি) পৃ. ১০৩৮।
. ইবন মনযুর : লিসানুল আরব, খ. ৩, পৃ. ৩১৫।
. মুফতি আমীমুল ইহসান : কাওয়ায়িদুল ফিক্হ, পৃ. ৩৯৫।
. মাওলভী সৈয়্যদ তাসাদ্দুক্ব হোসাইন : লুগাতে কিশওয়ারী, পৃ. ১৯৩।
. মাওলভী ফিরোজ উদ্দীন : ফিরোজুল লুগাত, পৃ. ৪৬১।
. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান : প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৪৪।
. ইবন মনযুর : লিসানুল আরব, খ. ৩, পৃ. ৪৬৮; রাযী : মুখতাসারুস সিহাহ, পৃ. ৪২২; যুবাইদি: তাজুল উরুস মিন জাওয়াহিরিল কামুস, খ. ৫, পৃ. ৩২৭; জাওহারি : আসসিহাহ ফিল লুগা ওয়াল উলুম, খ. ২, পৃ. ৭১৩।
. ড. ‘ঈসা ইবন ‘আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ ইবন মানি‘ আল হিমাইরী : الجزء المفقود من الجزء الاول من المصنف ـ
. ড. মোহাম্মদ আবদুল হালিম : নূর তত্ত্ব, পৃ. ৮৬।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান খাযাইনুল ইরফান (বঙ্গানুবাদ : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান) সূরা মায়িদা আয়াত নং ১৫, পৃ. ২১১।
. তানভীরুল মিক্ববাস মিন তাফসীরে ইবন ‘আব্বাস, পৃ. ১১৯।
. ইমাম ত্বাবারী : জামিউল বয়ান, খ.৮ পৃ. ২৬৪।
. ইমাম মহিউস সুন্নাহ : মা‘আলিমুত তাযীল, খ. ৩, পৃ. ৩৩।
. ইবন জাওযী : যাদুল মাসীর, খ. ২, পৃ. ৩১৬।
. ইমাম খাযিন : তাফসীরে খাযিন, লবাবুত তাবীল, খ. ১, পৃ. ৪২৯।
. ইমাম জুমাল : আল-ফুতুহাতুল ইলাহিয়্যতি, খ. ১, পৃ. ৪৭৪।
. ইমাম রাযী : তাফসীরে কবীর, খ. ৬, পৃ. ১৯৩-১৯৪।
. সৈয়্যদ মাহমূদ আলূসী : রূহুল মা‘আনী, খ. ৪, পৃ. ৯৭। (সূরা মায়িদার ১৫নং আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
. ১. ইমাম কাস্তুলানী : আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নীয়া, খ. ১, পৃ. ১৪৫।
২. ইমাম যারক্বানী : শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নীয়া, খ. ১, পৃ. ২৫৫।
৩. ইউসুফ নাবহানী : জাওয়াহিরিল বিহার ফী ফাদ্বায়িলিন নবীয়্যিল মুখতার, খ. ৩, পৃ. ৪২৪।
. ইউসুফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার, খ. ৩, পৃ. ৪২৬।
. ইউসুফ নাবহানী : আল আনোয়ারুল মুহাম্মদীয়া, পৃ. ২৮।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১০৩, পৃ. ১৩২।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৬৪, পৃ. ১৪৫।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা ইবরাহীম, আয়াত নং ০৭, পৃ. ৪৬৬।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা বাক্বারা, আয়াত নং ৪৭, পৃ. ২২।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা মায়েদা, আয়াত নং ১১৪, পৃ. ২৪০।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা ইউসুফ, আয়াত নং ৫৮, পৃ. ৩৯৫।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা ইখলাস, আয়াত নং ১, পৃ. ১১০২।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৩১, পৃ. ১১৪।
. সৈয়্যদ মাহমূদ আলূসী : রূহুল মা‘আনী, খ. ১০, পৃ. ১৪১।
. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী : আদ-দুররুল মানসূর ফীত তাফসীরে বিল মাসূর, খ. ৪, পৃ. ৩৩০।
. আবু হাইয়্যান আন্দুলূসী : আল-বাহরুল মুহীত্ব, খ. ৫, পৃ. ১৭১।
. ইবন জাওযী : যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর, খ. ৪, পৃ. ৪০।
. ইমাম তাবারী : মাজমাউল বয়ান, খ. ৫, পৃ. ১৭৭; ড. তাহেরুল কাদেরী : মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, পৃ. ৩২৯।
. আ‘লা হযরত : কানযুল ঈমান, প্রাগুক্ত, সূরা নিসা, আয়াত নং ৮৩, পৃ. ১৭৯।
লেখক: বিশিষ্ট গ্রন্থ প্রণেতা, উপাধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া নুরুল উলুম কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।