ড. মুহাম্মদ খলিলুর রহমান
১. উপস্থাপনা:
অনিন্দ্য সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যের আধিকারী আশরাফুল মাখলুকাত নামে খ্যাত আমরা মানবজাতি। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে রয়েছে ইসলাম প্রদত্ত সুন্দর, শাশ্বত ও কল্যাণময় পথ ও নির্দেশনা। যেগুলো একদিকে যেমন মানবকল্যাণধর্মী, অন্যদিকে তা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও চাহিদার অনুকূলে। এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনিভাবে তা তার আধ্যাত্মিক জীবনকেও পরিশুদ্ধ করে তোলে। এ অমোঘ বিধান তার জীবনকে যাবতীয় অশুচি, অসুন্দর ও অশালীন কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে পরিচ্ছন্ন, শালীন ও নির্মল করে তোলে।
ইসলাম মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান। এর বিধানাবলী যেমন- সহজ-সাবলীল, তেমনি তা সুষ্ঠু রুচি সম্পন্নও বটে। এ ব্যবস্থা মানবজাতির দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশ সাধনে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। যারই প্রেক্ষিতে মানুষের জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষত: শিক্ষা-দীক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উন্নতি-অগ্রগতিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ও উপকরণ ব্যবহারে একটি সীমারেখা ও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বর্তমান সমাজ শীর্ষক বিষয়টির প্রারম্ভেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মূল্যবোধ ইত্যাদির যৎকিঞ্চিত পরিচিতি প্রদান সমীচীন মনে করছি। কেন না এটা অনস্বীকার্য সত্য যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (Science and Technology) পরস্পর অবিচ্ছেদ্যাংশ (Isperable part))।
২. বিজ্ঞান (Science) পরিচিতি:
মূলত বিজ্ঞান (Science) শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Scio থেকে উৎপন্ন যার আভিধানিক অর্থ to know anyting বা জানা, বুঝা, অনুধাবন করা কিংবা পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি। অভিধানে বিজ্ঞানের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে বিশেষ জ্ঞান ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোনো বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞান, পরীক্ষা, প্রমাণ, প্রভৃতি দ্বারা নিরূপিত ও শৃঙ্খলালব্ধ জ্ঞান , তত্ত্বজ্ঞান ইত্যাদি।
সূর্যোদয়ের থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তথা ঘুম-ভাঙা কাক ডাকা ভোর থেকে শুরু করে ঘুম না আসা রাতের ঘোর মুহূর্ত পর্যন্ত জীবন ও জগতের অনিবার্য প্রয়োজন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সৌন্দর্য যার মাধ্যমে অনায়াসে আমাদের আয়ত্তে আসে, তাই মূলত: বিজ্ঞান।
মানব জীবন আর বিজ্ঞান একই সূত্রে গ্রথিত। যাতায়াত, কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প, জনসংখ্যা সমাধান, মহাশূন্যের রহস্য উদ্ঘাটন, শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তার, আবহাওয়া প্রকৌশল সহ জীবনের হাজারো ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিশাল ভূমিকা। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক Hallden-র কথায়ও বিষয়টি প্রতীয়মান। তিনি বলেন : We need science more than over before
বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ আজ নানাবিধ যন্ত্র আবিষ্কার করে কাজে লাগিয়ে জয় করেছে নিত্যদিনের সুখ-সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনন্য অধিকার। গতানুগতিক অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন অলস ও বিশৃঙ্খল মনোবৃত্তির বদলে বিজ্ঞান আজ তাকে করে তুলেছে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী শক্তিতে তীক্ষ্মতর, কর্মকুশলী, নিয়মনিষ্ঠ, নিরলস ও সুশৃঙ্খল। তার গতি আজ অক্লান্ত ও অবাধ, দুর্জয়-দুর্বার। তার দৃষ্টি আজ সর্বোতভাবে যুক্তি তথ্যসমৃদ্ধ, প্রমাণ নির্ভর, সংস্কারমুক্ত, স্বচ্ছ ও সুন্দর। সুদূরপ্রসারী তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণী দৃষ্টির অনন্য আলোয় সে আজ আবিষ্কারে সংক্ষম হয়েছে অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে অসীম ও অনন্য-মহাশক্তি। সেশক্তিই আজ তাকে দিয়েছে নতুনতর স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার সবচেয়ে সুন্দর ও ম্বার্থক সুযোগ।
৩. প্রযুক্তির সংজ্ঞা:
প্রযুক্তি মূলত বিজ্ঞানের জ্ঞানকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর উপকরণের মাধ্যমে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে বুঝায়। এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রয়োগ , প্রকৃষ্ট যুক্তি , শিল্প প্রভৃতিতে প্রয়োগ করার কৌশল ।
প্রযুক্তির ইংরেজি পরিভাষা হলো Technology or Technologies . এ ব্যাপারে অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে আছে : Scientific Knowledge used in practical ways in industry, for example in design new machines, Science and technology, recent advanced in medical technology to make us of the most modern technologies .
৪. মূল্যবোধের সংজ্ঞা ও পরিচিতি:
ইংরেজি `Morals’ শব্দটি ল্যাটিন `Moralis ও Mores শব্দ থেকে উদ্গত। এর অর্থ আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি বা প্রথা (Customs) । এ `Morals শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ নৈতিকতা বা মূল্যবোধ (Values)। `Ethics’ ইংরেজি শব্দটির প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। মূল্যবোধ একটি বহুমাত্রিক ও আপেক্ষিক প্রত্যয় এবং এটি দর্শন সম্পর্কিত একটি ধারণা।
মূল্যবোধ সমাজবদ্ধ মানুষের আচরণ সম্পর্কীয় আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বা `Normative Science’। সুশৃঙ্খল, যথার্থ ও সুআচরণই এর লক্ষ্য।
৪:১. দার্শনিক আবুল ফজলের মতে, “মনুষ্যত্ব আর মনুষ্যত্ব বিকাশে যা সহায়ক তা-ই মূল্যবোধ।
ন্যায়, সুনীতি, সৌন্দর্য্য ও কল্যাণ কামনা প্রভৃতি সদগুণের সমষ্টিই মূল্যবোধ, যা মানব জীবনের ঐশ্বর্যরূপ। এ গুণগুলো অর্জন ও অনুশীলনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের স্বকীয়তা ও মনুষ্যত্ব। এক কথায় যা কিছু সুন্দর, মানবিক ও কল্যাণকর এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ধর্মীয় ভাবাধারায় অনুসৃত ও অনুকরণীয় বিষয়াবলীর নামই ধর্মীয় মূল্যবোধ।
৫. ইসলাম ও মূল্যবোধ :
এটা সুস্পষ্ট যে, মূল্যবোধ এমন এক নৈতিক ভাবধারা যা মানুষকে সর্বদা কল্যাণকর ও মহৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। আর এর মূলে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে ধর্ম। ধর্ম আল্লাহ প্রদত্ত হওয়ায় এটি সর্বদা মানুষকে শান্তি ও কল্যাণের পথ নির্দেশ করে। বস্তুত নৈতিকতার মূল উৎসই হলো ধর্ম।
বরং মানুষের কর্মমুখর বিশাল ও বর্ণাঢ্য জীবনের সকল অঙ্গনের জন্যই রয়েছে এর সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। ইসলাম মানুষকে তার স্রষ্টার সাথে এবং অপরাপর সৃষ্টির সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থ, বাণিজ্য, ইহ ও পরকাল অর্থাৎ মানবজীবনের এমন কোন দিক ও বিভাগ নেই যা ইসলামে নির্দেশ করা হয়নি। এক কথায়, ইসলামী মূল্যবোধ গোটা মানবজীবন ব্যষ্টিত, এর ব্যাপ্তি ও পরিধি মানবজীবনের মতই ব্যাপক, বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী।
ইসলাম এমন এক শ্রেষ্ঠ আদর্শ ও সর্বোত্তম মূল্যবোধের প্রবক্তা ও ধারক-বাহক যা মানুষকে তার প্রকৃত মনুষ্যত্বের আসনে সমাসীন করে। জীবন বিধান হিসাবে ইসলাম যেমন নির্ভুল, সর্বজনীন, শাশ্বত ও চিরন্তন, তেমনি এটি মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সহধর্মী, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী, সহজ-সরল ও ব্যবহারিক (Practicalism)। কেননা এটি মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ প্রদত্ত সর্বোৎকৃষ্ট মূল্যবোধ (The best values) এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ।
৬. ইসলামে মূল্যবোধের গুরুত্ব :
মানব প্রকৃতি ও স্বভাবের মধ্যেই মানুষের (Humanity) এবং পশুত্ব (Animanity) সমান্তরালভাবে বিরাজমান। মানুষ স্বভাবতই সৎপ্রবণ। তাই সে পশুত্বকে দমন করে আর মনুষ্যত্বকে লালন করে এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়াসী হয়। এ কারণে মানুষ কেবল শ্রেষ্ঠ নয়, মহৎও বটে। মহান আল্লাহ মানুষের মনুষ্যত্ব বা বিবেককে পবিত্র ও জাগ্রত করতে এবং পশুত্ব বা সীমা লংঘন প্রবণতাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। মূলতঃ পশুত্বকে দমন করে মনুষ্যত্বকে লালন ও বিকশিত করার প্রচেষ্টাই নৈতিক মূল্যবোধ (Moral Values) বা ইসলামী মূল্যবোধ। ইসলামে নৈতিক মূল্যবোধের মর্যাদা সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক। এটি এমন এক মানসিক চেতনা যা মানুষকে জীবন পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। ধর্ম,বিশেষতঃ ইসলামই সর্ব যুগে সর্ব কালে মানব জীবনকে নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ ও উজ্জীবিত করেছে। মূল্যবোধের অধিকারী মানুষ আত্মপ্রত্যয়ী ও ন্যায় নিষ্ঠ হয়ে থাকে। সৎ সাহস ও দৃঢ় মনোবল তার মূল পুঁজি। এটি একদিকে যেমন তাকে মানসিক প্রশান্তি দান করে অপরদিকে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যা সত্যিকারের মনুষ্যত্ব্যের পরিচায়ক। এ মানুষ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন’র ঘোষণা হচ্ছে, “নিশ্চয় আমি আদম বংশকে সম্মানিত করেছি এবং জলে ও স্থলে তাদেরকে বিচরণ ক্ষমতা দান করেছি। আর রিযিক হিসেবে তাদেরকে দিয়েছি পবিত্র সব দ্রব্যাদি, সর্বোপরি সৃষ্টির অনেক কিছুর উপর তাদেরকে দান করেছি বিশেষ মর্যাদা”।
শুধু তাই নয়, মানুষের সেবা করার জন্য মহান আল্লাহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ভৃত্যের ভূমিকায় নিয়োজিত রেখেছেন। “তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে তৎসমূদয়কে?”
মানব মর্যাদা এখানেই শেষ নয়। উপরন্তু মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। কী সৌভাগ্যবান মানুষ! মানুষের জন্য এর চাইতে পরম পাওয়া, বড় মর্যাদার বিষয় আর কি হতে পারে? মহান আল্লাহ এ বিশ্বজগৎ যেভাবে পরিচালনা করতে চান, মানুষ তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই নিজের জীবন ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালন করবে এবং এক্ষেত্রে সে যথার্থ মনুষ্যত্বের পরিচয় দিবে। এ মূল্যবোধের অধিকারী হওয়ার কারণেই মানুষের এত সম্মান ও মর্যাদা এবং মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। পক্ষান্তরে যখনি মানবজীবন থেকে ধর্মের মৌলিকত্ব বাদ পড়েছে, নবী-রাসূল, আহলে বা’ইআতে রাসুলুল্লাহ (দ.) এবং অজ্রস অগণিত আউলিয়া কামেলীন কতৃক অনুসৃত ও প্রদর্শিত সত্যিকার জীবনাদর্শ صراط المستقيم থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তদস্থলে নাস্তিকতা, বস্তুবাদ বা ভোগবাদ স্থান করে নিয়েছে, তখনি মানুষ ধীরে ধীরে নীতিবোধ ও মূল্যবোধহীন হয়ে পড়েছে। এরই ফলে মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন আজ যুগপৎভাবে হতাশাগ্রস্থ ও অস্থির। পশুশক্তি বা পশুভাব দ্বারা সমাজ আক্রান্ত। মূল্যবোধহীন অশুভ ও অপশক্তির প্রতিনিধিরাই আজ বিশ্বব্যাপী সমাজের হর্তাকর্তা ও ভাগ্যবিধাতা। এরাই মানব মর্যাদাকে ভূলণ্ঠিত করেছে এবং মানবতাকে করে চলেছে অপমানিত ও লাঞ্চিত। এদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, “এরা পশুতুল্য, বরং পশুর চাইতেও অধম”। সুতরাং মানব মর্যাদা ও মনুষ্যত্ব রক্ষা এবং জাতীয় জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা ও রূপায়ণ অপরিহার্য।
৭. আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার : ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আজকের সমাজ ব্যবস্থা
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন আসমান-যমীন, আগুন-পানি, মাটি, বাতাস ইত্যাদি ছাড়াও লাখ লাখ মাখলূক। দুনিয়াতে যা কিছু আমরা মানুষের আবিষ্কার বলে মনে করি সেগুলিও মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্টি। কারণ তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। তিনি ছাড়া আর কোন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনিই কালের স্রষ্টা, কালের সব নবাবিষ্কারও তাঁরই সৃষ্টির সহায়তায় সৃষ্ট। আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا ‘তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবকিছু’ । সুতরাং বর্তমান বিশ্বে যত সব আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সবই মহান আল্লাহর সৃষ্টিকে কেন্দ্র করেই সৃষ্ট।
উপরোক্ত আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন যে, মানুষ জগতের যা কিছু দ্বারা উপকার লাভ করে তা সবই আল্লাহ তা‘আলার দান। এর প্রত্যেকটি জিনিস আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের নিদর্শন। এতদসত্ত্বেও তার সঙ্গে কুফরী কর্মপন্থা অবলম্বন করা কত বড়ই না অকৃতজ্ঞতা! আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
“নিশ্চয়ই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজনে ও রাত-দিনের পালাক্রমে আগমন ও প্রস্থানে বহু নিদর্শন আছে ঐসব বুদ্ধিমানের জন্য যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং তা লক্ষ্য করে বলে ওঠে) হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি অনর্থক কাজ থেকে পবিত্র” ।
এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্বই এখন একটি গ্রামে (Global Village) পরিণত হয়েছে। মুহূর্তের মাঝে এক দেশের খবর চলে আসে অন্য দেশে। হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত মানুষের সাথে কথা বলা যায় অনায়াসে। পৃথিবীর এই তাবৎ আবিষ্কার, প্রযুক্তির এই সব উন্নয়ন সবই ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নে‘মত। যার শুকরিয়া আদায় করা প্রতিটি বান্দার জন্য আবশ্যক। কেননা আল্লাহ বলেন, لَئِنْ شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরো অধিক নিয়ামাত দান করব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহ’লে (মনে রেখ) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর ।
শুকরিয়ার সর্বনিম্ন স্তর হল, আল্লাহর নি‘মাতকে সঠিক স্থানে ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং আল্লাহর নাফরমানিতে ব্যবহার করা থেকে সাধ্যাতীত বিরত থাকা।
এমন কোন প্রযুক্তি পণ্য বা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নেই, যেটা ইসলামের খেদমতে ব্যবহারযোগ্য নয়। তবে স্মর্তব্য যে, প্রতিটি জিনিসকে ভাল কিংবা মন্দ কাজেও ব্যবহার করা যায়। দোষ কিন্তু জিনিসের বা প্রযুক্তির নয়। বরং এখানে ব্যবহারকারী মূলতঃ দায়ী। যেমন টেলিভিশনের মাধ্যমে মন্দ ছবিও দেখ যায়, আবার সারাদিন ইসলামিক অনুষ্ঠানও দেখা যায়। লক্ষণীয় যে, প্রযুক্তিকে আমরা কোন কাজে ব্যবহার করছি সেটাই বিবেচ্য বিষয়। আমরা যদি প্রযুক্তিকে ইসলাম প্রচারের কাজে লাগাই তাহ’লে সব ধরনের প্রযুক্তিই কল্যাণের মাধ্যম হবে। আর যদি এই কথা বলে পিছিয়ে থাকি যে, এগুলো ব্যবহার করা হারাম তাহ’লে এগুলোর সুফল থেকে জাতি বঞ্চিত হবে। সব নবী-রাসূলই তাদের যামানায় তৎকালীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দেয়া বিধান ধর্মের প্রচার-প্রসার করেছেন। তাঁরা প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করেছেন। আমরাও যদি প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করি তাহ’লে তা হবে ইসলাম ও মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর।
৮. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি :
ইসলামের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিদ্যমান। যেমন আল্লাহ বলেন,
هُوَ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ يُخْرِجُكُمْ طِفْلًا ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ ثُمَّ لِتَكُونُوا شُيُوخًا وَمِنْكُمْ مَنْ يُتَوَفَّى مِنْ قَبْلُ وَلِتَبْلُغُوا أَجَلًا مُسَمًّى وَلَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ-
‘তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। অতঃপর শুক্রবিন্দু হতে, অতঃপর জমাট রক্ত হতে, অতঃপর তোমাদেরকে বের করে দেন শিশুরূপে। অতঃপর তোমরা পৌঁছে যাও যৌবনে। অতঃপর বার্ধক্যে। তোমাদের কারো কারো এর পূর্বেই মৃত্যু ঘটে এবং কেউ কেউ নির্ধারিত আয়ুষ্কাল পর্যন্ত পৌঁছে যাও। যাতে তোমরা অনুধাবন কর।’
এই আয়াতটির মধ্যে যে বিপুল পরিমাণের বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং চিন্তার খোরাক আছে তা যদি বাদও দেই, শুধু আয়াতের সমাপ্তিটি ‘যাতে তোমরা অনুধাবন কর’ এটুকু লক্ষ্য করি, তাহ’লে দেখতে পাব যে, কিভাবে মানুষ মাত্র একফোঁটা তরল পানি থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশু হয়ে বের হয়ে একসময় বড় হয়ে শক্ত-সমর্থ মানুষে পরিণত হয়, তারপর একদিন বৃদ্ধ হয়ে মারা যায়। ঠিক একইভাবে বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করাটাও মানুষ হবার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ।
এই আয়াতের মর্মার্থ উপলব্ধি করে, যুগে যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ জ্ঞানের চর্চা করেন এবং সেই মধ্যযুগে জ্ঞানের আলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে ইউরোপ ছিল অজপাড়াগাঁ। আর মুসলিম স্পেন ছিল প্রযুক্তির ব্যবহারে শীর্ষে। মুসলিম বিজ্ঞানীগণ ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভাবক। যেমন রসায়ন, চিকিৎসা, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতির উদ্ভাবক ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীগণই। রসায়ন বিজ্ঞানের জনক জাবির বিন হাইয়ান, চিকিৎসা বিজ্ঞানে আল-রাযী ও ইবনে সীনা, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে আল-ফারগানী, সমাজবিজ্ঞানে ইবনে খালদূন প্রমূখের নাম জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছে।
৯. প্রযুক্তির অপব্যবহার :
মানবতার কল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে মানুষের জীবনযাপনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। ইসলামের সাথে বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই। তবে বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল, ইসলাম চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে সঠিক ব্যবহার ও এর সুফল আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে। এর কবল থেকে পরিত্রাণের আশাও অকল্পনীয় বৈ কি। প্রযুক্তির এই নে‘মতগুলো আজ আযাবে পরিণত হচ্ছে।
১০. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব :
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার সর্বত্র। এর অবদানকে যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি এটার অপব্যবহারের কথা বলে এটাকে পরিত্যাগ করারও কোন উপায় নেই। বরং আমাদেরকে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বস্তুত : প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারই আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারে।
সব নবী-রাসূলই তাঁদের যুগে তৎকালীন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলার বিধান প্রচার-প্রসার করেছেন। উম্মতকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শিখিয়েছেন। মহান আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর সময় জাদুর প্রভাব ছিল অধিক। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম সে যুগের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ প্রদত্ত মু‘জিযা ব্যবহার করে ফিরাউন/ফির‘আউন ও তার সম্প্রদায়ের নিকট দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। ফলে অসংখ্য জাদুকর আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর সময়ে চিকিৎসাবিদ্যার প্রচলন ছিল বেশী। তিনি তাই আল্লাহ প্রদত্ত চিকিৎসাবিদ্যার ব্যবহারের মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন। মৃতকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করে দেখানোর মাধ্যমে দাওয়াতী কাজ করেছেন ।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ সারা জাহানের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এ ধরণীতে এসে মুশরিক, ইয়াহুদী সহ সবাইকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াত দানে তিনি তৎকালীন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। ছাফা পাহাড়ে উঠে তিনি মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন। সে যুগে সাহিত্যের প্রভাব ছিল বেশী। তিনি উচ্চাঙ্গের আরবী সাহিত্যের ব্যবহার করেও মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।
একটি দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার প্রধান চালিকাশক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কারে ও ব্যবহারে অগ্রসরতা। যে জাতি শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী। যে জাতি যত বেশী প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছে সে জাতি তত বেশী উন্নত । প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রযুক্তি শিক্ষালাভ করা যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়ার শক্তি পঙ্গু করে পরজাতির মুখাপেক্ষী থাকা গ্রহণযোগ্য নয়। উন্নয়নের একমাত্র সোপান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হওয়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আবশ্যক।
১১. প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারের উপায় ও মাধ্যম:
বিজ্ঞানের উন্নতির এই যুগে দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প সময়ে, অল্প কষ্টে অসংখ্য মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া যায়। আধুনিক মাধ্যমগুলোতে ইসলামের ছহীহ আক্বীদার মানুষ কম আসায় এক্ষেত্রে সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন ভ্রান্ত দল ও গোষ্ঠী। তাদের থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে আধুনিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে সঠিক ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমকে কিভাবে সঠিক পথে পরিচালনা করা যায় এবং কিভাবে ইসলাম প্রচারে ব্যবহার করে ধর্মীয় মূল্যবোধকে বেগবান করা যায়। এ ব্যাপারে, গবেষক, চিন্তাবিদ ও ইসলামী স্কলারগণ গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
১. টেলিভিশন মিডিয়া :
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার একক হল পরিবার। সেই পরিবারের অন্যতম বিনোদন মাধ্যম হল টেলিভিশন। এ মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের গুরুত্ব অপরিসীম। এই মাধ্যমের অপব্যবহারগুলো সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি একে ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে সত্যিকার নবী-রাসূল প্রেমিক, গবেষক, চিন্তাবিদ ও নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। ইসলামী বিভিন্ন অনুষ্ঠান তথা হারামাইনিশ শারীফাইনের বিশুদ্ধ ইসলামি প্রোগ্রাম, কুরআন তিলাওয়াত, পবিত্র হজ্বের কার্যাদি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলত সম্পর্কীয় স্থান সমূহ বিশেষ করে মসজিদুল হারাম, মসজিদি নববী, মসজিদুল আকসাসহ তামাম পৃথিবীর আউলিয়া-ই-কামিলীনের মাজারাত ও তৎকেন্দ্র সমূহে উদযাপিত বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচারে বেসরকারী টিভি চ্যানেলসমূহ অনবদ্য কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারে।
২. রেডিও :
হাতের কাছে সর্বক্ষণ সহজলভ্য মোবাইলের কল্যাণে অধুনা এই মাধ্যমের ব্যাপ্তি বেড়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটি এমন একটি মাধ্যম যেটাতে ইসলামী কোন চ্যানেল নেই। অথচ অন্যান্য মিডিয়ার তুলনায় এটার খরচ কম হলেও এর ব্যাপ্তি বা প্রভাব অনেক বেশী। অত্যন্ত কম খরচে অল্প সীমানায় (range) সম্প্রচার করতে চাইলে কমিউনিটি রেডিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ব্যাপারে মুসলিমদের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক উদ্যোগই পারে এ মাধ্যম ব্যবহার করে ইসলাম সারা বিশে^ প্রচার করতে।
৩. প্রিন্ট মিডিয়া :
সমাজের পরিবর্তনে ও সমাজে ভালো কিছু প্রচলনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা স্থায়ী ভূমিকা রাখতে পারে প্রিন্ট মিডিয়া। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে এবং ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক প্রকাশনা নেই বললেই চলে। এই সুযোগে দেশের অসংখ্য বাতিল সম্প্রদায়ের ভ্রষ্ট আকিদা ও ঈমান বিধ্বংসী মতবাদ মানুষের মন-মগজে সহজেই প্রবেশ করছে। আমাদের মুসলিম শিশুদের মাঝেও এ চিন্তা-ভাবনা প্রবেশ করেছে। এর ফলে আমরা শঙ্কিত যে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সত্যিকার মুসলিম থাকবে কি-না! তাই মিডিয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে ইসলামের কাজে লাগাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ। বিত্তবান মুসলিমদের এগিয়ে আসার পাশাপাশি মেধাবীদেরও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে ইসলামের কাজে লাগাতে হবে। সেই সাথে শিশুদের ইসলামমুখী করতে শিশুতোষ পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে এবং তা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।
৪. কম্পিউটার :
বর্তমান বিশ্বে কম্পিউটার এমন এক প্রযুক্তির নাম পৃথিবীর সবকিছুতেই যার ছোঁয়া অপরিহার্য। এর অবদান অনস্বীকার্য। পৃথিবীর সব যন্ত্রই বর্তমানে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত তথা কম্পিউটারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্যে পরিচালিত। লেখাপড়া, সাহিত্যচর্চা, সাহিত্য-কলা সবকিছুতেই কম্পিউটার প্রসারিত করেছে তার সাহায্যের হাত। উন্নত বিশ্বে কৃষি, বাণিজ্য, চাকরি থেকে নিয়ে হেন কোন পেশা নেই যাতে কম্পিউটারের সাহায্য নেয়া হয় না। এই মাধ্যমকে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনেক সহজে ও সফলতার সাহায্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে আজ কুর’আন, হাদীস, বিভিন্ন ইসলামী রেফারেন্স গ্রন্থ পড়া ও সংরক্ষণ করা, ভিডিও দেখা, অডিও শোনা প্রভৃতি অনেক সহজতর হয়েছে। আগে কুর’আনের আয়াত বা হাদীসের ‘ইবারত সংগ্রহ করা অনেক কঠিন ছিল। আজ তা অনেক সহজতর হয়েছে। কুর’আন-হাদীস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সফটওয়্যার রয়েছে। এগুলোতে সহজেই একটি সূরা থেকে অন্য সূরাতে গমন করা যায়। বিভিন্ন আয়াত বের করা যায় বিভিন্ন শব্দ দিয়েও আয়াত বের করা যায়। হাদীসের ক্ষেত্রেও এরকম সফটওয়্যার বিদ্যমান। বাংলা ভাষায়ও কুরআন-হাদীসের অনেক ওয়েব, সফটওয়্যার, অ্যাপ বিদ্যমান। এগুলোর যথাযথ প্রচার ও সহযোগিতায় এগিয়ে আসা আমাদের কর্তব্য।
কুরআন, হাদীস ও ইসলামী রেফারেন্স-এর ক্ষেত্রে ‘মাকতাবা শামেলা’ সফটওয়্যার অসাধারণ। এতে বিভিন্ন বিষয়ের হাযার হাযার গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা মওজুদ রয়েছে। আধুনিক যুগে ইসলামী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এর ব্যবহার জানা আবশ্যক।
৫. ওয়েব মিডিয়া :
ওয়েব মিডিয়ায় মুসলমানদের অবস্থান খুব দুর্বল। বিশেষ করে নৈতিকতাও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা এখানে খুবই নগণ্য। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, অমুসলিম ও ইয়াহুদীদের সাইট মুসলমানদের সাইটের তুলনায় ১২০০ গুণ বেশী। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সয়লাব এতই বেশি যে অল্প কিছু মুসলিম সাইটের অবস্থান সে তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। বাংলা ভাষায়ও ইসলামের উপর ওয়েবসাইটের সংখ্যা অতি নগণ্য। যেগুলো রয়েছে তার মানও অনেক কম। অনেক ওয়েবসাইট নিয়মিত আপডেট হয় না। ওয়েব মিডিয়ার অন্যতম উপাদান অনলাইন নিউজ-এর ক্ষেত্রে ইসলামী ভাবধারাসম্পন্ন পোর্টাল এর অত্যধিক অভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েবসাইট প্রভৃতিরও সংখ্যা অনেক কম। এগুলোর প্রচার-প্রসারে আরো অনেক ওয়েবসাইট, ব্লগ গঠনে এগিয়ে আসার পাশাপাশি নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
অনলাইন মিডিয়ায় বিভিন্ন বইয়ের পিডিএফ, মোবি, ইপাব প্রভৃতি প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত বাড়ছে। যেহেতু অনৈসলামী শক্তি বিভিন্ন সময়ে ওয়েবে ইসলাম প্রচারকারী সাইটকে বন্ধ করে দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়, সেক্ষেত্রে সবসময় এগুলোর ব্যাকআপ রেখে কাজ করা আবশ্যক। ওয়েবে শুধু আর্টিকেল প্রকাশই নয়, ইসলামী নীতিমালার বিষয়গুলোর উপর অডিও, ভিডিও, প্রেজেন্টেশন প্রভৃতি প্রকাশ ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাআতে আদর্শ ও তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক ফলপ্রসূ প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ের উপর উইকিপিডিয়া একটি মুক্ত গ্রন্থাগার। ইসলামী বিষয়ের উপর আর্টিকেলগুলো এই সাইটে সবচেয়ে অবহেলিত। তরুণ সমাজের উচিত এটিকে সমৃদ্ধকরণে এগিয়ে আসা।
৬. ই-মেইল :
ই-মেইলের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের কাছে ইসলামের বাণী মুহূর্তেই পৌঁছানো যায়। যত বড় লেখাই হোক না কেন তা লিখে মানুষকে সত্যিকারে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া যায়। ই-মেইল এ গ্রুপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে গ্রুপ মেসেজ আদান-প্রদান করা যায়। জিমেইলের ফাইল হোস্টিং সার্ভিস গুগল ড্রাইভের মাধ্যমে ফাইল সংরক্ষণ করা যায়। এমনকি বিভিন্ন ডকুমেন্টকে Ocr করে word ফরম্যাটে রূপ দেয়া যায়।
৭. ফেসবুক সহ অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়া :
স্যোশাল মিডিয়াগুলো যদিও ওয়েব মিডিয়ার অন্তর্ভুক্ত, তবুও এর গুরুত্ব ও পরিব্যাপ্তি অনেক হওয়ায় তার আলাদা আলোচনা গুরুত্বের দাবী রাখে। বর্তমানে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত এ মিডিয়া আসক্ত। এ মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলাম প্রচার অনেক সহজ এবং অনেক দ্রুত গতিতে তা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারের উদাহরণ অপব্যবহারের তুলনায় অনেক কম। ফেসবুকে লেখা, ছবি, ভিডিও, নোট (বড় লেখা) প্রকাশ করে দ্বীনে হকের দাওয়াতের কাজ করা যায়। এক্ষেত্রে দাওয়াতের পাশাপাশি অনৈসলামী মতবাদকে খন্ডনও করা যায়। তবে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সৌজন্য, শালীনতা, মাধুর্যতা বজায় রাখা আবশ্যক। সবসময় বিরোধিতামূলক বা খন্ডনমূলক প্রচার নয়, বরং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দাওয়াত দেওয়া অনেক বেশী কার্যকর। দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইসলামী মূলনীতি অনুসরণ করে সঠিক তথ্য-প্রমাণসহ আলোচনা দাওয়াতকে বেগবান করবে বলে আশা করা যায়। এছাড়াও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া যেমন টুইটার, বেশতো, উম্মাহল্যান্ড, লিংকডইন, গুগল প্লাস, ইন্সট্রাগ্রামেও ইসলাম বিষয় লেখা, ছবি পোস্ট করা সময়ের দাবী।
৮. ইউটিউব :
মানব মনে দাগ কাটারও রেখাপাত করার ক্ষেত্রে দেখা ও শোনার প্রভাব অত্যাধিক বেশী। এজন্যই মাল্টিমিডিয়ার প্রয়োগ অনেক বেশী প্রয়োজন। ভিডিও প্রকাশ করে তা প্রচার করলে দাওয়াতের প্রসার অনেক বৃদ্ধি পায়। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, তাফসীর, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, ইসলামী হামদ, না‘ত প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এসব রেকর্ড করে ইউটিউব, ডেইলীমোশন, ভিডিও প্রভৃতি সাইটে আপলোড করে প্রচার করা যেতে পারে। বড় বড় ভিডিওর তুলনায় ছোট ছোট প্রশ্নোত্তর বা ভিডিওর প্রভাব অনেক বেশী। শিশুদের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য অনুমোদনযোগ্য কার্টুনও প্রকাশ করা যেতে পারে। এছাড়া শিশুদের জন্য ছড়া, বিভিন্ন ইসলামী গল্প তথা কুরআন, সুন্নাহ, ভিত্তিক তাযকিরাতুল আম্বিয়া, তাযকিরাতুল আউলিয়া, নীতি গল্পসমূহ বিদগ্ধ ইসলামি পণ্ডিত ও গবেষকের মাধ্যমে ভিডিও করে প্রকাশ করলে তা শিশুদের মনোজগতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
৯. মোবাইল :
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক নব আবিষ্কার হল মোবাইল ফোন। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর সকলের হাতেই এখন মোবাইল। মোবাইল ফোন যেন আজকাল জীবনের একটি আবশ্যিক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এটা মানুষের জীবনকে করেছে গতিময়। আগের যামানায় যে কাজে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হত, বর্তমানে তা মুহূর্তের মধ্যেই পরিসম্পন্ন হয়। এদিকে লক্ষ্য করলে মোবাইল অত্যন্ত জরুরী বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বিশেষ। কিন্তু এর অপব্যবহারও কম নয়! মোবাইল এখন শুধু দূর-আলাপনী যন্ত্রই নয়, এটি এখন মিনি কম্পিউটারের রূপ ধারণ করেছে। ফলে এর বহুমুখী ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মোবাইল সঠিকভাবে ব্যবহার করে এটিকে দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা যায়। বিশেষ করে স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইসলামের অনেক বিষয় জানা, মেনে চলা সুবিধাজনক।
বর্তমানে অনেক সহজেই কুরআন-হাদীসের বাণীগুলো পড়া ও সার্চ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কুরআন ও হাদীসের এই সংকলনগুলো বাংলায় সহজলভ্য। এখন সহজেই ছালাতের সময়সূচী, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত প্রভৃতি জানা যায়। স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইসলামী লেকচার, গজল, টিউটোরিয়াল-এর অডিও-ভিডিও শোনা ও দেখা যায়। একটি মাত্র ছোট্ট মেমোরীতে অসংখ্য বক্তব্য ধারণ করা যায়। সেই সাথে অতি সহজেই তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে প্রচার করা যায়। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের অ্যাপগুলোর মাধ্যমে ইসলাম চর্চা অনেক সহজ হয়েছে। ইসলাম বিষয়ক অ্যাপগুলোতে কুরআনের বিভিন্ন অনুবাদ, হাদীসের গ্রন্থ, ফাতাওয়ার কিতাব, ছালাতের সময়সূচী, দৈনন্দিন জীবনের দু’আ, তাফসীর, বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থসমূহ নবী-রাসূল ও আউলিয়া-ই-কামিলীনের জীবনী, মাসআলা-মাসায়েল প্রভৃতি বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষায় হিসনুল মুসলিম অ্যাপ, হাদীসবিডি অ্যাপ, আই হাদীস, বাংলা কুরআন প্রো প্রভৃতি অন্যতম। এসবের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানার্জন করা সহজ হয়েছে। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে, ভ্রমণে ও অবসর সময়ে এক ক্লিকেই এসব পড়া যায়। শুধু পড়াই নয়, অডিও ডাউনলোডের মাধ্যমে বিখ্যাত ক্বারীদের তেলাওয়াত শুনা এখন অনেক সহজ হয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে পিডিএফ, ইপাব, মোবি প্রভৃতি বিভিন্ন ফরম্যাটের পিডিএফ পড়া যায়। ইসলামের অসংখ্য বিষয়ে বর্তমানে পিডিএফ বিদ্যমান। হাতের কাছেই এসব রয়েছে, অথচ এসব উপকারী বিষয়কে পরিত্যাগ করে আমরা শয়তানী ওয়াসওয়াসায় পড়ে অনৈসলামিক বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছি। ইসলামী বিষয়গুলো অন্যের মাঝে প্রচলনের জন্যে আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এসব ধর্মীয় বই, অডিও, ভিডিও লেকচারগুলো অন্যের মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমে (shareit, bluetooth, anyshare) প্রচার করা যায়। এসব সিডি বা ডিভিডিতে কপি করেও প্রচার করা যায়।
নিজেরাও বিভিন্ন দুর্লভ বইগুলো cam scanner অ্যাপ দিয়ে মোবাইলের ক্যামেরাকে কাজে লাগিয়ে স্ক্যান করে পিডিএফ আকারে সংরক্ষণ করতে পারি। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের প্রচলন অনেক বেশী। উন্নত বিশ্বে বা আমাদের দেশের বিত্তবানরা আইফোন বা আইপ্যাড ব্যবহার করেন। কিন্তু এই অপারেটিং সিস্টেমে ইসলামিক অ্যাপ-এর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। প্রযুক্তিবিদদের এই মাধ্যমে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করা প্রয়োজন। বাংলা ভাষায় ইসলামিক অ্যাপগুলোর অধিকাংশই তৈরী হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এসব বিষয় সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হ’লে এর গতিময়তা বৃদ্ধি পাবে। আলিম সমাজের এসব ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করার পাশাপাশি সামষ্টিকভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিত্তবানদেরও এসব উদ্যোক্তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা নিজের ঈমানী দায়িত্ব মনে করা উচিত। আইফোনে বই পড়ার অন্যতম ফরম্যাট ইপাব (Epub)। এই ফরম্যাটে কোন বাংলা ইসলামী বই নেই। যা দুঃখজনক। এই ফরম্যাট নিয়ে কাজ করার জন্য তরুণ সমাজের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
১০. প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের দিকনিদর্শনায় আলিম সমাজের ভূমিকা :
তথ্য ও প্রযুক্তি মানুষের জীবন ও তার উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মানুষের জীবন প্রবাহকে বেগবান করেছে। আর ইসলাম মানুষের জন্য যে কোন কল্যাণকর জিনিসের সঠিক ব্যবহার অনুমোদন করে। তাই তথ্য ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে ইসলামের কোন আপত্তি নেই। তথ্য ও প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার হচ্ছে। কোন জিনিসের ভুল ব্যবহার হলে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায় না। বরং ভুল ব্যবহার বন্ধ করতে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের আলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের দায়িত্ব মানুষকে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি অর্থাৎ ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইসলাম তাসাউফের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার জবাব আলিমদের পক্ষ থেকেই আসা উচিত। ইসলামের নামে অসংখ্য নতুন নতুন ফিৎনা, বিভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদ ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রচার করার দায়িত্ব আলিম সমাজের উপরই বর্তায়। সাপ্তাহিক জুম‘আর খুৎবায় প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে কি করণীয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা জরুরী। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তি যতটা তৎপর, শক্তিশালী ঈমানের অধিকারী আলিম সমাজ তথা সূফী সাধকগণ তার চেয়ে বেশী তৎপর হবেন এটা আমাদের একান্ত কামনা।
প্রযুক্তির সহজ ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে ইসলাম বিরোধীরা যেমনি অনলাইনে নির্জলা মিথ্যা ছড়িয়ে দিচ্ছে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নগ্নতাকে উসকে দিচ্ছে। নাস্তিকতার প্রচার ও ধর্মে অযথা অবিশ্বাস তৈরি করছে তেমিন অন্যদিকে ইসলামের ছদ্মাবরণে তথাকথিত ইসলামি চিন্তাবিদ داعى الى الله দাবীকারী বর্তমানে দ্বীন ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বিনষ্টকারী আহলে হাদীস, মাযহাব বিরোধি সহ অসংখ্য বাতিল ও পথভ্রষ্ট নবী-অলী আহলে বায়’আত রাসূলুল্লাহ বিদ্বেষীরা সরলমনা মুসলিম মিল্লাতকে صراط المستقيم থেকে পদচ্যুত করে চলেছে।
আধুনিক জাহেলিয়াতের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ইসলামের প্রকৃত বার্তা মানুষের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব আলিম সমাজ তথা বিদগ্ধ পন্ডিত, সূফীসাধকগণ ও তাঁদের বর্তমান উত্তরসূরীদের উপর বর্তায়। মানবজীবনের জন্য অতীব জরুরী আমলগুলো উপর্যুক্ত প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন ভাষায় তথ্যসূত্রসহ তুলে ধরার মাধ্যমে ইসলামের বাস্তব অনুশীলনের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে আমাদের আলিম তথা সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও ফেসবুককে দাওয়াতের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে ইসলামের প্রচার-প্রসারে ভূমিকা পালন করতে পারেন। কুরআনের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলো যে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা প্রচারে আলিমদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের আলিম সমাজেরই দায়িত্ব প্রযুক্তির এই দিকহারা জাহাজের পাল টেনে ধরার। সেই সাথে মানুষকে তার সঠিক ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া। ইসলামের খেদমতে প্রযুক্তিকে কিভাবে আরও শক্তিশালী করা যায় তা নিয়ে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী। কারণ এখন মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর। অফিস-আদালত, বই-পুস্তক, দোকান-পাঠ সবই এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতা যেন আমাদের ধ্বংসের কারণ না হয়। আল্লাহর এই অমূল্য নে‘মতগুলো যাতে তাঁর নাফরমানীতে ব্যবহার না হয়, সে ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এই প্রযুক্তিকে আল্লাহর নির্দেশ মত ব্যবহারের উপযোগী করা আলিমদেরই দায়িত্ব।
আল্লাহ বলেন, إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِيْنَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً- ‘আমি পৃথিবীর সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি, যাতে লোকদের পরীক্ষা করি যে, তাদের মধ্যে কে ভালো কাজ করে’ । এরই প্রেক্ষিতে বলা যায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে ধর্ম কোন ক্রমেই সাংঘর্ষিক নয়। প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, দক্ষতা, চিন্তা-চেতনা, মানবিক দৃঢ়তা প্রভৃতি ধর্মীয় মূল্যবোধকে অধিকতর শাণিত ও সমৃদ্ধ করে তুলতে প্রকৃত পক্ষে সক্ষম ও সফল মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। তাই বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন বলেন : Science without religion is blind, religion without science is lame
১১. উপসংহার :
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক ইসলামী দাওয়াত, মারিফাতের রুহানী মিশন, ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচার-প্রসার পদ্ধতি এক দিকে যেমনি যুগোপযোগী ও উন্নতমানের হওয়া দরকার, অন্য দিকে তেমনি সমকালীন সকল বাতিল শক্তি ও আকিদা প্রতিরোধ করার মত যোগ্যতা, দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগের সক্ষমতাও থাকা প্রয়োজন। সর্বসাধারণের কাছে ইসলামের মূলদ্বারা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের দাওয়াত ও মারিফাতের অমীয় বাণী-অমৃত সুধা পৌঁছে দিতে উপরোক্ত প্রযুক্তি নির্ভর মাধ্যমগুলোর সর্বোচ্চ ইতিবাচক ব্যবহার ও সতর্কতার সাথে প্রয়োগ একান্ত বাঞ্চনীয়।
তাই তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে সত্যিকার ইসলামি গবেষক, চিন্তাবিদ, দার্শনিকদের তাওহীদ-রিসালাত-বেলায়াত তথা আধ্যাত্মিকতার সুমহান সৌকর্য, সৌন্দর্য, বাণী, নীতিমালা জীবনবিধান ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রচার-প্রসারে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রত্যেককে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, আহ্লে রায়’আতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম), খুলাফায়ে রাশিদীন, লক্ষ লক্ষ সাহাবাÑই কিরাম ও আধ্যাতিœক বাগানের অগণিত আউলিয়া-ই-কামেলীন এর ফায়ূজাত অর্জনে তাওফিক ইনায়েত করুন।
উপরন্তু প্রযুক্তির আলোচনা মাত্রই বিজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করার নামান্তর। কেন না বর্তমানের আমরা তথ্য প্রযুক্তির মহাসড়ক তথা Information Technology super Highway’র উপর অবস্থান করছি।
তথা আল্লাহর পথে আহবানকারীদের জন্য তাওহীদের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার অপার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে হবে। ইসলামের অপার সৌন্দর্য সর্বসাধারণের কাছে তুলে ধরতে হবে। জাহেলিয়াতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সর্বত্র পৌঁছে দিতে হবে কুরআনের আলো। আর সে প্রচেষ্টায় সবারই অংশগ্রহণ প্রয়োজন। ইসলামের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন! বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।
লেখক: অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ফয়জুল বারী ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা কর্ণফুলী, চট্টগ্রাম।