হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ ﴿١٦﴾ اعْلَمُوا أَنَّ اللهَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ۚ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ ﴿١٧﴾ إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ ﴿١٨﴾ وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ أُولٰئِكَ هُمُ الصِّدِّيقُونَ ۖ وَالشُّهَدَاءُ عِندَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ ﴿١٩﴾
তরজমাঃ মুমিনগণের জন্য কি এখনো ওই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হয়ে পড়বে আল্লাহর স্মরণ ও ওই সত্যের জন্য, যা অবতীর্ণ হয়েছে? এবং তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছে, অতঃপর তাদের উপর সময়সীমা দীর্ঘায়িত হয়েছে। সুতরাং তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। এবং তাদের অধিকাংশই ফাসিক-পাপাচার। তোমরা জেনে রেখো, আল্লাহই ভূ-মন্ডল কে তার মৃত্যুর পর পুণরুজ্জীবিত করেন। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য বিবৃত করেছি যেন তোমরা হৃদয়ঙ্গম করো। নিশ্চয় সাদকাহদাতা পুরুষ ও সাদকাহদাত্রী নারীগণ এবং তারাই যারা আল্লাহকে উত্তম ঋন দান করেছে, তাদের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে এবং তাদের জন্য সম্মানজনক প্রতিদান রয়েছে। এবং তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর সকল রাসূলের উপর ঈমান গ্রহণ করেছে তারাই হচ্ছে পূর্ণ সত্যবাদী “সিদ্দিক” এবং (অন্যদের উপর) সাক্ষী তাদের প্রতিপালকের নিকট। তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার এবং তাদের জ্যোতি। আর যারা কাফির এবং আমার আয়াত সমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। (১৬-১৯ নং আয়াত সূরা আল হাদীদ)
আনুষঙ্গিক আলোচনা
শানে নুযুল: উদ্ধৃত প্রথম আয়াতের অর্থাৎ ১৬ নম্বর আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- একদা রাসূলে আকরম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন হুজরা মুবারক থেকে বাইরে তাশরিফ এনে লক্ষ্য করলেন যে, কিছু সংখ্যক মুসলমান পরষ্পর হাসাহাসি করছে। আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন-“ তোমরা হাসাহাসি করছো? অথচ এখনো পর্যন্ত তোমাদের নিকট নাজাতের নিশ্চয়তা আসেনি।” তখনই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। সাহাবায়েকেরাম আরয করলেন-ওহে আল্লাহর রাসূল! এ হাসাহাসির কাফফারা কি? এরশাদ করলেন-ততটুকু কান্নাকাটি করো। বেশি হাসাহাসি করলে অন্তর মরে যায়। আর আল্লাহর ভয়ে ও রাসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমে কান্নাকাটি করলে ক্বলব জিন্দা হয়ে যায়। (খাযায়েনুল ইরফান ও রুহুল বায়ান)
সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, মহান আল্লাহ কোন কোন মুমিনের অন্তরে আমলের প্রতি অলসতা ও অনাসক্তি আঁচ করে এ আয়াত নাযিল করেন। এটা মুমিনদের জন্য হুশিয়ারি (তাফসিরে ইবনে কাসির)
সাইয়্যেদুনা ইমাম আমশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন পবিত্র মদীনায় পৌছার পর কিছু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হওয়ায় কোন কোন সাহাবীর কর্মোদ্দীপনায় কিছুটা শৈথিল্য দেখা দেয়। এরই প্রেক্ষিতে এ আয়াতখানা অবতীর্ণ হয়। (রুহুল মায়ানী শরিফ)
সাইয়্যেদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর উপরোক্ত রেওয়ায়েতে আরো বলা হয়েছে যে, এই হুশিয়ারি সংকেত কুরআন নাযিল হওয়ার তের বছর পর নাযিল হয়। সহীহ মুসলিম শরিফে সাইয়েদুনা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-আমাদের ইসলাম গ্রহণ করার চার বছর পর এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে হুশিয়ারি করা হয়। সারমর্ম হলো-এই হুশিয়ারির মাধ্যমে মুসলমানদেরকে পুরোপুরি ন¤্রতা ও সৎ কর্মের জন্য তৎপর থাকার শিক্ষা দেয়া এবং এ কথা ব্যক্ত করা যে, আন্তরিক ন¤্রতাই সৎকর্মের ভিত্তি। সাইয়্যেদুনা হযরত শাদ্দাদ ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর রেওয়ায়াতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন মানুষের অন্তর থেকে সর্বপ্রথম নম্্রতা উঠিয়ে নেয়া হবে। (তাফসীরে ইবনে কাসির)
خشوع القلب
মুফাসসেরীনে কেরাম বলেছেন خشوع القلب মানে অন্তর ন¤্র হওয়া। উপদেশ কবুল করা ও আনুগত্য করা। (ইবনে কাসির) পবিত্র কুরআনে করীমের প্রতি অন্তর বিগলিত হওয়ার অর্থ এর বিধান তথা আদেশ নিষেধ পুরোপুরি পালন করার জন্য প্রস্তুত হওয়া এবং এ ব্যাপারে কোন অলসতা বা দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দেয়া।
(তাফসিরে রুহুল মায়ানী)
وَالَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-আরবি পরিভাষায় “সাদিক” তথা সত্যবাদি তিনিই যার রসনা সত্যবাদী হয়। আর সিদ্দীক তথা অত্যধিক সত্যবাদী তিনিই , যার ধ্যান-ধারণা, রসনা ও কান সবই সত্যবাদী হয়। “সাদিক” হচ্ছেন তিনিই যিনি মিথ্যা বলেননা আর সিদ্দিক হচ্ছেন তিনিই যিনি মিথ্যা বলতেই পারেননা। সাদিক হচ্ছেন তিনি, যিনি সৃষ্টির সাথে সত্য কথা বলেন, আর সিদ্দিক হলেন তিনিই যিনি তার আমিত্ব থেকে পবিত্র হন। সাদিক হলেন তিনি যিনি ঘটনার অনুরূপ কথা বলেন, আর সিদ্দিক হলেন তিনিই ঘটনা যার কথায় অনুরূপ হয়। অর্থাৎ তিনি যা বলেন, মহান প্রতিপালক তাই করে দেন। (তাফসিরে নুরুল ইরফান)
উদ্ধৃত আয়াতের আলোকে সাইয়্যেদুনা ইমাম ক্বতাদাহ ও হযরত আমর ইবনে মায়মুন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ঈমান গ্রহণ করে। সেই সিদ্দিক ও শহীদ। সাইয়্যেদুনা বারা ইবনে আযেব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর রেওয়ায়াতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- مومنوا امتي شهداঅর্থাৎ আমার উম্মতের সব মুমিন শহিদ। এর স্বপক্ষে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করেন। (তাফসিরে ইবনে কাছীর।)
একদা সাইয়্যেদুনা হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট কতিপয় সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেনكلكم صديق وشهيد অর্থাৎ আপনারা প্রত্যেকেই সিদ্দিক ও শহীদ। সবাই বিস্মিত হয়ে বললেন-আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু! আপনি একি বলছেন? তিনি প্রমাণ স্বরুপ আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করলেন।
তাফসীরে রুহুল মায়ানী শরীফে উল্লেখিত আছে যে, আলোচ্য আয়াতে কামিল ও খালিস ইবাদতকারী মুমিন অর্থ গ্রহণ করা সঙ্গত। নতুবা যেসব মুমিন অসাবধান ও খেয়াল খুশিতে মগ্ন তাদেরকে সিদ্দিক ও শহীদ বলা যায়না। যেমন হাদিসে নববী শরীফে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যারা মানুষের প্রতি অভিসম্পাত করে তারা শহীদগণের অন্তর্ভুক্ত হবেনা।
সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একবার উপস্থিত জনতাকে লক্ষ্য করে বললেন তোমাদের কি হল যে, তোমরা কাউকে অপরের ইযযতের উপর হামলা করবে-এ ভয়ে আমরা কিছু বলিনা। হযরত ওমর ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন-যারা এমন শিথিল তারা সেই শহীদের অন্তর্ভুক্ত হবেনা যারা পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের উম্মতদের মোকাবেলায় স্বাক্ষ্য দিবে। (রুহুল মায়ানী শরিফ)
তাফসিরে মাযহারি শরীফে উল্লেখিত আছে যে, আলোচ্য আয়াতে রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর যুগে যারা মুমিন হয়েছে এবং রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বরকতময় সঙ্গ লাভে ধন্য হয়েছে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে। আয়াতে هم الصديقون থেকে বুঝা যায় যে, একমাত্র সাহাবায়ে কেরামই সিদ্দিক অন্য কোন মুমিন নয়। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন-সাহাবায়ে কেরাম সকলেই পয়গম্বর সুলভ গুণগরিমার বাহক ছিলেন। যে ব্যক্তি একবার মুমিন অবস্থায় একবার রাসূলে খোদাকে দেখেছে তিনিই পয়গম্বর সুলভ গুণগরিমায় আপ্লুত হয়েছে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।