মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
মহান আল্লাহ ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি ঈমান আনার পর প্রত্যেক মুমিনের দায়িত্ব হলো আমলের বিধি বিধানগুলো যেমন, সালাত, সাওম, হজ, যাকাত ইত্যাদি পালন করা। এ সমস্ত বিধি-বিধান পবিত্র কুরআন ও হাদীসের মধ্যে বিবৃত রয়েছে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের পক্ষে কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি মাসয়ালা বের করা সম্ভবপর নয়। ফলে তাদের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তবে যারা জানে তাদের কাছ থেকে জেনে নাও’। (সূরা নাহল-৪৩)
যারা এর জ্ঞান রাখেন তাদেরকে বলা হয় মুজতাহিদ। অন্যরা হলো মুকাল্লিদ। আর মুজতাহিদের অনুসরণ করাকে বলা হয় তাক্বলীদ।
মাযহাব এর পরিচয়
মাযহাব শব্দের অর্থ হলো চলার পথ, মতামত, বিশ্বাস, মতবাদ, পন্থা ইত্যাদি। (মিসবাহুল লুগাত-২৬২)
ইসলামি পরিভাষায় মাযহাব হলো এমন কিছু মতামত, গভীর দৃষ্টিভঙ্গী ও দর্শনের সমষ্টি যা একটি অপরটির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে একটি সুবিন্যস্ত ও সুশৃংখল মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (আল-মু’জামুল ওয়াসিত)
ইসলামি বিধি-বিধান পালনের জন্য মাযহাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে সর্বজন স্বীকৃত চারটি মাযহাব হলো হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী। প্রিয় নবীর উম্মতের মধ্যে এমন কিছু পুণ্যবান ব্যক্তিবর্গকে মুজতাহিদ বলা হয়, যাঁরা হলেন পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরামদের পরবর্তী বিজ্ঞ লোকদের ঐক্যমত এবং কুরআন সুন্নাহর নীতির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে মাসয়ালা নির্গতকারী একদল গবেষক। এসকল মুজতাহিদগণ পবিত্র কুরআনের একাধিক অর্থবোধক শব্দ থেকে সহজে পালনীয় অর্থটি নির্ধারণ করেছেন এবং কুরআন-সুন্নাহর মধ্যে বাহ্যিকভাবে বিপরীত ভাবাপন্ন অর্থ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ সমাধান বের করেছেন। যে সকল বিষয়ে উম্মতের পূণ্যবান মুজতাহিদ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন এটিকে শরিয়তের তৃতীয় উৎস “ইজমা” বলা হয়। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমার মধ্যে না পাওয়া নতুন নতুন সমস্যাগুলিকে নির্দিষ্ট মূলনীতির আলোকে বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করে যে সমাধান দেওয়া হয় তা হলো ‘ক্বিয়াস’। উপরোক্ত মূলনীতিগুলোর আলোকে গবেষণার ফসল হিসেবে নির্গত মাসআলাকে সাধারণভাবে পালন করে থাকেন। এ পালন করাকেই বলা হয় মাযহাব। আর এই মাযহাবই হলো ইলমে ফিকাহ এর অন্যতম ভিত্তি।
তাকলিদ এর পরিচয়
কোনো অজানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুসরণ করাকে বলা হয় “তাকলিদ”। তাকলিদ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো কোন বস্তুকে গলার চতুর্দিকে পেচিঁয়ে রাখা, যাকে কিলাদাহ বলা হয়। (ড. হামিদ সাদিক, মুজামু লুগাতিল ফুকাহা, পৃ-১৪১)
শরিয়তের পরিভাষায় দলিল প্রমাণের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে সত্য জেনে তার অনুসরণ করাই হলো তাকলিদ। (মুফতি আমীমুল ইহসান, কাওয়াইদুল ফিকহ- পৃ-২৩৪)
আল্লামা জুরজানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, তকলিদ হলো বিনা দলিল-প্রমাণে অন্যের কথা গ্রহণ করা।
(জুরজানী, কিতাবুত তা’রীফাত- পৃ-৬৪)
মাযহাব কোনো নতুন ধর্ম বা মতবাদ নয়, বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব মতবাদের নামও নয় বরং মাযহাব হলো কুরআন, হাদীস, ইজমা ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে প্রদত্ত সমাধান। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বুঝায় কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ থেকে সহজে অনুসরণীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
মুজতাহিদ ও মুকাল্লিদ
ইসলামি শরিয়তে মুজতাহিদ বলা হয় যিনি পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সকল নীতিমালা নাসেখ-মানসুখ, ইলমে হাদীসের সনদ, মতন, জারহ-তাদীল, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্র-নাহু, সরফ, লুগাত, অলংকার শাস্ত্র-বালাগাত, মানতিক, ইলমে উরুজ, ইলমে ফরায়েজ ও মানব সমাজে রীতি-নীতি ও আচার-আচরণ সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সুতরাং মুজতাহিদের যোগ্যতা হলো-
১. পবিত্র কুরআন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান। তথা নাসেখ-মানসুখ, শানে নুযুল, শাব্দিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নখদর্পণে থাকা।
২. আরবি ভাষা সম্পর্কে পারদর্শী হওয়া বিশেষত ইলমে নাহ্ভ, সরফ, বালাগাত-ফাসাহাত সম্পর্কে জানা।
৩. সুন্নাহ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান। হাদীসের সনদ, মতন, আসমাউর রেজাল, রাভীদের ব্যাপারে ইমামগণের মতামত, শানে ওয়ারুদ, নাসেখ-মানসুখ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান।
৪. ফিকহী মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান, তথা উসূল-ফুরু‘আত সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান ও পা-িত্য অর্জন।
৫. ইজমা’ উম্মত সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা।
৬. স্বভাবজাত ফিক্বাহর যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা।
(ফিকহু আহলিল ইরাক ওয়া হাদিসুহুম।)
যে ব্যক্তি ঐ স্তরে পৌছতে পারবেন না এবং উক্ত যোগ্যতার অধিকারী নন তাদেরকে বলা হয় মুকাল্লিদ বা গায়রে মুজতাহিদ। যিনি মুজতাহিদ নন তার জন্য মুজতাহিদের অনুসরণ করা আবশ্যক।
ইসলামি শরিয়তে মাযহাব
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পালনীয় ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত আমল সরাসরি কুরআন হাদীস দেখে এবং পড়ে আমল করা সহজ নয়। তাই কোন্ মাজহাব অনুসরণ করতে হবে বরং যারা মাযহাব মানার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন তারাও তাদের প্রতিটি কাজ কুরআন হাদীসের পাতা খুলে আমল করেন না। তারাও কোননা কোনোভাবে তাদের ইমামের বা শায়খের অনুসরণ করে থাকেন। তারা আবার বলে বেড়ান মাযহাব মানার বিষয়টি সরাসরি কুরআন হাদীসেতো উল্লেখ নেই। অথচ মাযহাব মানার বিয়ষটি কুরআন হাদীসে নেই- এ কথা বলা নিতান্তই হাস্যকর। কেননা সমাজে বিভিন্ন বিষয় প্রচলিত থাকলেও হুবহু শব্দটি পবিত্র কুরআন-হাদীসে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং এর সমার্থবোধক বিষয় কুরআন-হাদীসে রয়েছে। যেমন, মুসলমানদের মধ্যে বহুল প্রচলিত “তাওহিদ” শব্দটি। শব্দটি সরাসরি কুরআন শরিফে নেই। অথচ তাওহিদে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী না হলে কেউ ঈমানদার হতে পারে না। সুতরাং হুবহু শব্দ না থাকা মানে উক্ত বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকা বলা মূর্খতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আল-কুরআনের আলোকে তাকলিদ ও মাযহাব
পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আয়াত দ্বারা মাযহাব অনুসরণ বা অনুকরণের অপরিহার্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেন-
১. হে ঈমানদারগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের, এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে উলিল আমর। (সূরা নিসা-৫৯)।
এখানে “উলিল আমর” বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মুফাসসির গণের মতে দুটি অভিমত পাওয়া যায়। প্রথমত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মতে ‘উলিল আমর’ হলো কুরআন সুন্নাহর জ্ঞানের অধিকারী ফকিহ মুজতাহিদগণ।
(ইবনে কাসির, তাফসীরুল কুরআনুল আজিম, ১/৬৪১)
দ্বিতীয়, অভিমত হলো উলিল আমর বলে মুসলিম শাসকদেরকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আবু বকর জাসসাস রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, নিশ্চয় তারা হলেন, আলিম ও ফকিহগণ। (ইমাম জাসসাস, আহকামুল কুরআন, ৩/১৭৭)।
২. তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলোনা, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যাতে তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবা-১২২)।
উক্ত আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় মুসলমানদের ঈমান ও ইসলামের জরুরী বিষয়গুলোর জ্ঞানার্জন করা ফরজ। যার অবর্তমানে মানুষ ফরজ-ওয়াজিব আদায় করতে পারেনা এবং হারাম থেকে বাঁচতেও পারবেনা। তাছাড়া অন্যান্য বিষয়গুলো যেমন, কুরআন-হাদীসের মাসআলা-মাসায়েল, হুকুম-আহকাম, এবং তার শাখা-প্রশাখা সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করা ফরযে কিফায়া। তাই কিছু লোক যদি এ দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মুসলমানদেরকে আল্লাহর বিধি-বিধান জানাবে অন্যরা তাদেরকে অনুসরণ করবে। শরিয়তের মধ্যে একেই বলা হয় তাকলিদ। ইমাম আবু বকর জাসসাস বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা আলিমগণকে সর্তক করার এবং সর্ব সাধারণকে সে সর্তকবাণী মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন।
৩. আমাদেরকে সরল পথ দেখাও। সে সমস্ত লোকদের পথ যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ। (সূরা ফাতিহা:৫-৬)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা “সিরাতুল মুসতাক্বীম” হিসেবে নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের রাস্তাকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে তাদের সহযোগী হবে। যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, তারা হলেন, নবি, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল সালেহীন। (সূরা আন-নিসা:৬৯)
এককথায় তারা হলেন নবিগণ, সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, আউলিয়ায়ে কামেলীন, মুজতাহেদীন ও ইমামগণের অনুসৃত পথ।
৪. যদি তোমরা না জানো, তাবে যারা জানে তাদের কাছ থেকে জেনে নাও। (সূরা নাহল-৪৩)
খতিব বাগদাদী রহামতুল্লাহি আলায়হি বলেন, কুরআন-সুুন্নাহর যে সকল বিষয়ে সাধারণ লোক সরাসরি শরিয়তের বিধান আহরণে অক্ষম, তাদের জন্য বিজ্ঞ আলেমের তাকলিদ করা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক জায়েয।
আল্লামা মাহমুদ আলুসী রহামতুল্লাহি আলায়হি ও ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহামতুল্লাহি আলায়হি উক্ত আয়াতের তাফসিরে লিখেছেন, উক্ত আয়াতের ভিত্তিতে অনেকেই মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলিদ বৈধ এবং অনভিজ্ঞ সবাইকে বিজ্ঞ মুুুজতাহিদের শরণাপন্ন হওয়া ওয়াজিব বলেছেন।
(রুহুল মা‘আনী, ১৪/১৪৮, তাফসিরে মাযহারী, ৫/৩৪২)।
৬. যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের ইমাম (নেতা) সহ ডাকবো। (সূরা বনি ইসরাঈল-৭১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী ও ইসমাইল হাক্কী রহামতুল্লাহি আলায়হি বলেন, কিয়ামতের দিন প্রত্যেক দলকে দুনিয়ার অনুসৃত ইমামের মাযহাব অনুসারে ডাকা হবে। যেমন বলা হবে হে হানাফী, হে শাফিয়ী, হে মুতাজলী, হে কাদরী। চাই তারা ইমামকে অনুসরণ করুক ভালোকাজে বা মন্দ কাজে ন্যায় বা অন্যায় কাজে।
(আল্লামা কুরতুবী, আল জামি লি-আহকামিল কুরআন,১০/২৯৭, আল্লামা ইসমাইল হাক্কী, রুহুল বয়ান ৫/১৫৭)।
৭. এবং সবার মধ্যে অনুগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
(সূরা তাওবা-১০০)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তিন শ্রেণির বান্দার প্রতি সন্তুষ্টির কথা বলেছেন। তারা হলেন, ১. অগ্রগামী মুহাজির বা সাহাবা, ২. অগ্রগামী আনসার সাহাবা, ৩. ও তাদের অনুসরণকারী মুসলমানগণ। মূলত উনারা তা পেয়েছেন প্রিয় নবিজীর সোহবত ও ইত্তেবার কারণে। একেই বলা হয় তাকলিদে শরয়ী বা শরিয়ত সমর্থিত তাকলিদ।
হাদীসের আলোকে তাকলিদ ও মাযহাব
১. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামকে আমল শিক্ষা দিয়েছেন এবং সেভাবেই অপরকে শিক্ষা দিতে বলেছেন। এক কথায় তিনি কুরআনের বিধি-বিধানগুলোকে বাস্তবায়নের কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত সুলাইমান মালিক ইবনুল হুয়াইরিস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এলাম। আমরা কয়েকজন সমবয়সী যুবক ছিলাম। অতঃপর তিনি ধারণা করলেন আমরা আমাদের পরিবারের প্রতি মমতা অনুভব করছি। তাই তিনি আমাদের পরিবার পরিজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা তাকে আমাদের পরিবার সম্পর্কে অবহিত করলাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়াবান। তিনি আমাদেরকে বলেন “তোমরা তোমাদের পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাও। তাদেরকে শিক্ষা দাও এবং জীবন চলার দিক-নিদের্শনা প্রদান কর। এবং আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই সালাত আদায় কর। আর যখন সালাতের সময় হবে, তখন তোমাদের মধ্যে একজন যেন আযান দেয়, তারপর তোমাদের মধ্যে যে বয়সে বড় সে যেন ইমামতি করে। (সহীহ বুখারী-৫৬৬২, সহীহ মুসলিম-১০৮৬)।
সাহাবায়ে কেরাম নবীজীকে যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই সালাত আদায় করবেন আর পরবর্তীরা সাহাবাদেরকে দেখে দেখে আমল করতেন। ইসলামের মূল শিক্ষাগুলো এভাবেই পরম্পরায় চলতে থাকবে।
২. নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা বান্দাদের হৃদয় থেকে ইলম ছিনিয়ে নিবেননা; বরং আলিমগণকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমের বিলুপ্তি ঘটাবেন। একজন আলিমও যখন থাকবেন না মানুষ তখন মূর্খদেরকে পথ প্রদর্শকের মর্যাদা দিয়ে বসবে। আর তারা বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে অজ্ঞতাপ্রসূত ফতোয়া দিয়ে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।
(সহীহ বুখারী-১০০, তিরমিযী-২৬৫২)।
আলোচ্য হাদীসে ফতোয়া প্রদানকে বিজ্ঞ আলিমদের অন্যতম দায়িত্ব বলা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে সর্ব সাধারণের উপর দায়িত্ব হলো তাদের অনুসরণ করা। আরেকটি বিষয় হলো নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের ভবিষ্যতবাণী করেছেন যখন কোথাও আলেম খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঐ নাজুক মুহূর্তে বিগত যুগের হক্কানী আলেম মুজতাহিদগণের তাকলিদ ও অনুসরণ ছাড়া দ্বীনের উপর অবিচল থাকার আর কোনো উপায় বাকী থাকবে না।
(মাযহাব কি ও কেন, পৃ:৩০)।
৫. হযরত আবু সাঈদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, দু’একজন বিশিষ্ট সাহাবী জামাতের পিছনে এসে শরীক হলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে যথাসময়ে মসজিদে প্রথম কাতারে শরীক হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, তোমরা আমাকে অনুসরণ কর। আর তোমাদের পরবর্তীরা তোমাদেরকে অনুসরণ করবে।
(সহীহ বুখারী, আযান অধ্যায়-৬৮, সহীহ মুসলিম-৯৮২)
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, হাদিসটির মর্ম হলো তোমরা আমার কাছ থেকে শরিয়তের আহকাম শিখে রাখ। কেননা পরবর্তীরা তোমাদের থেকে এবং আরো পরবর্তীরা তাদের কাছ থেকে শিখবে। আর এ ধারা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। (ইবনে হাজার,ফাতহুল বারী ২/২০৫)
সাহাবীগণ অনুসরণ করেছেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে, সাহাবীদেরকে অনুসরণ করেছেন তাবেয়ীগণ, তাবেয়ীগণ অনুসরণ করেছেন তাবঈ-তাবেয়ীগণকে। এভাবে জ্ঞানী তথা মুজতাহিদগণকে অনুসরণের নামই হলো তাকলিদ। যার পরবর্তীতে মাযহাব অনুসরণ করার মাধ্যমেই পরিপূর্ণতা লক্ষ করেছে।
সাহাবীদের যুগে তাকলিদ
১. হযরত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে ইয়ামান পাঠানোর প্রাক্কালে জিজ্ঞাসা করলেন, কীভাবে তুমি উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করবে? তিনি বললেন, আমি কিতাবুল্লাহর আলোকে ফয়সালা করবো। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার প্রশ্ন করলেন, সেখানে না পেলে? হযরত মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাহলে সুন্নাতে রাসূলের আলোকে ফয়সালা করব। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার প্রশ্ন করলেন, সেখানেও না পেলে? হযরত মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি ইজতিহাদ করব এবং (সত্যের স›দ্ধানে) চেষ্টায় ত্রুটি করবো না। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন তার প্রিয় সাহাবীর বুকে হাত দ্বারা মৃদু আঘাত করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের দূতকে রাসূলের সন্তুষ্টি অনুযায়ী কথা বলার তাওফিক দিয়েছেন। (আবু দাউদ-২০৬১,তিরমিযী -১৩২৭)
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুধুমাত্র একজন সাহাবীকে বিচারক ও শিক্ষক হিসেবে ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে কুরআন সুন্নাহর পাশাপাশি ইজতিহাদ করার ক্ষমতাও দান করলেন। অন্যদিকে তিনি ইয়ামেনবাসীকে হযরত মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর অনুসরণ করার নির্দেশও প্রদান করেছেন। এটিই হলো সাহাবাদের ব্যক্তি তকলিদ।
২. হযরত আসওয়াদ ইবনে ইয়াযিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু গভর্নর ও শিক্ষক হিসেবে ইয়ামেনে আগমন করলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, জনৈক ব্যক্তি এক কন্যা ও এক বোন রেখে মারা গেলে (তাদের সম্পত্তি বন্টন কীভাবে হবে?)। তিনি তাদের উভয়ের অংশ অর্ধেক বলে সমাধান দেন। (সহীহ বুখারী-৬৭৩৪)
হযরত মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একজন নির্ধারিত ব্যক্তি হওয়ার পরও ইয়ামেনবাসী তার অনুসরণ করা ওয়াজিব ছিল। এজন্য হযরত মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ফতওয়াকে আসওয়াদ সহ সকলে তাকলিদের ভিত্তিতে প্রমাণ তালাশ না করেই মেনে নিয়েছিল।
৩. হযরত সাহাল বিন মুআজ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক মহিলা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দরবারে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার স্বামী জিহাদে গিয়েছেন। তিনি থাকতে আমরা তাকে সালাত ও অন্যান্য কাজ অনুসরণ করতাম। অতএব তার আসা পর্যন্ত আমাকে এমন আমল বলে দিন যা তার সম úর্যায়ে হবে। (মুসনাদে আহমদ-৪৩৯)
উক্ত হাদীসে মহিলাটি নামাজ সহ সকল কাজে স্বামীর অনুসরণের কথা বলেছেন, অথচ নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোনো রকম অসম্মতি প্রকাশ করেননি।
৪. হযরত হুজায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন। আমি জানিনা আর কতদিন তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকবো। আর আমার পর তোমরা আবু বকর ও উমর কে অনুসরণ করবে। (তিরমিযী-৩৬৬৩)।
ইমাম দারেমী তার সুনানের মধ্যে বর্ণনা করেন হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হওয়ার পর ফরমান জারী করেন যে, যে সমস্ত মাসয়ালা সর্ম্পকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাদীস পাওয়া যাবে না সে ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ফতওয়ার উপর আমল করতে হবে। আর যদি আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর ফতওয়া পাওয়া না যায় তাহলে আলিমদের পরামর্শ দ্বারা যে অভিমত গৃহীত হবে সে রায় কার্যকর করতে হবে। অথচ হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন প্রথম কাতারের ফকিহ সাহাবী। তা সত্ত্বেও তিনি জীবনভর আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুএর অনুসরণ করতেন। সুতরাং বুঝা যায় সাহাবায়ে কেরামগণ ইজতিহাদী মাসআলার ক্ষেত্রে খলিফাদের অনুসরণ করতেন।
৫. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন পৃথিবী থেকে পর্দা করেন তখন প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার মতান্তরে এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবা জীবিত ছিলেন। কিন্তু এতো অধিক সংখ্যক সাহাবার মধ্যে মুজতাহিদ সাহাবা ছিলেন মাত্র দেড়শ জনের মতো বাকী সাহাবীগণ এদেরকেই অনুসরণ করতেন। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবদ্দশায় বিজিত অঞ্চলসমূহে দ্বীনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করতেন। তারা সেখানে ফতোয়া দিতেন। তারা হলেন, ১. হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ২. হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ৩. হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ৪. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৫. হযরত মুআজ ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৬. হযরত উবাই ইবনে কাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৭. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৮. হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। (ইমাম সুয়ুতী, আদাবুল ফতোয়া পৃ: ৬৭-৭১)।
আবার মুজতাহিদ সাহাবীগণের মধ্যে সাতজন বিজ্ঞ সাহাবা ছিল প্রথম স্তরের। যাদের ফতওয়াকে অন্যান্য সাহীবাগণ ও তাবেয়ীগণ অনুসরণ করতেন। তারা হলেন- ১. হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ২. হযরত আলী ইবনু আবি তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৪. উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৫. হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৬. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৭. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। উক্ত সাহাবাদের ফতোয়াগুলো আসারে সাহাবা হিসেবে সংকলিত হয়েছে। যেমন, হযরত ইমাম আবু হানিফার কিতাবুল আসার, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ইত্যাদি। ফলে সাহাবীগণ নিঃসংকোচ ভাবে বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ সাহাবাদের অনুসরণ করতেন। হাদীসের মধ্যে রয়েছে হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জাবিয়া নামক স্থানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, হে লোক সকল! কুরআন সর্ম্পকে কোনো কিছু জানতে চাইলে উবাই ইবনে কাবের নিকট, ফরায়েজ জানতে চাইলে ইবনে সাবিতের কাছে আর ফিকহ সর্ম্পকে জানতে চাইলে হযরত মুআজ ইবনে জাবালের কাছে যাবে। তবে অর্থ সর্ম্পকিত কোন প্রশ্ন থাকলে আমার কাছেই আসবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা আমাকে এর বন্টন ও তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত করছেন। (ইমাম তাবরানি, আল মুজামুল আওসাত)
সুতরাং প্রিয় নবীর সাহাবারা কোনো জটিল বিষয়ে সম্মুখীন হলে তা সমাধানের জন্য মুজতাহিদ সাহাবাদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রিয় শিক্ষক হযরত আলী ইবনুল মাদিনী রহমাতুল্লাহি আলায়হি (১৬১ হিজরী-২৩৪ হিজরী) এ প্রসঙ্গে বলেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন এমন ফকিহ সাহাবা ছিলেন, যাদের অনুসারীগণ তাদের মতামত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন এবং প্রচার-প্রসার করেছেন এবং তাদের মতামতের উপর (মাযহাবের উপর ভিত্তি করে) ফতোয়া প্রচলিত ছিল। তারা হলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।
ইমাম ইবনুল মাদিনী রহমাতুল্লাহি আলায়হি আরো বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সিদ্ধান্তমতে তাবেয়ীগণের মধ্যে যারা ফতোয়া প্রদান করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, হযরত আলকামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত: ৬২ হিজরী), হযরত আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত:৭৫ হিজরী), হযরত মাসরূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত: ৬২ হিজরী), হযরত আবিদাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত: ৭২ হিজরী), হযরত আমর ইবনে শুরাহবিল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত:৬৩ হিজরী), হযরত হারিস ইবনে বাইস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত:৬৩ হজরী)।
হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর অনুসারীগণের মধ্যে যারা তার ফতোয়াগুলো সংরক্ষণ করতেন তারা হলেন, ইবনে শিহাব জুহরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত:১৪৩ হিজরী), হযরত আবু বকর ইবনে হাযেম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত ১২০১ হিজরী), আবু যিনাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত:১৩১ হিজরী)।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর অনুসারী তাবেয়ীগণ হলেন, হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত আলী ইবনে আবি তালহা রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত আবদুল মালিক ইবনে জুরাইজ রহামতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ।
(ইমাম ইবনুল মাদিনী, কিতাবুল ইলাল, পৃ:১০৭-১৩৫)
ইমামদের ইজতিহাদ
চার মাজহাবের ইমামগণ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যে ইজতিহাদ করার যোগ্যতা থাকলে তিনি ছাড়া অন্যদের ইমামের অনুসরণ করা আবশ্যক। মাযহাব বিরোধীরা বলে থাকে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে চার মাযহাবকেই ছেড়ে দিয়ে সহীহ হাদীসের উপর আমল করতে হবে। আহলে ইলম সকলেই জানেন যে, এমন অসংখ্য হাদীস রয়েছে যেখানে একটি অপরটির বিপরীত। যেমন, এক হাদীসে আ-মী-ন শব্দ করে বলার কথা আছে আর কোনো হাদীসে আ-মী-ন চুপে চুপে বলার কথা রয়েছে। অনুরূপ কোনো হাদীসে কুকুর দেখলেই হত্যা করার কথা বলা হয়েছে। আবার অপর হাদিসে জীবকে দয়া করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বিরোধপূর্ণ হাদীস ছেড়ে দেয়ার কথা বলাটা অবান্তর। তদুপরি মুসলিম দুনিয়ার বিখ্যাত ও সর্বজন স্বীকৃত হাদীস সংকলনকারীরা আপন আপন ক্ষেত্রে অতুলনীয় ও পারদর্শী হওয়ার পরও কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসরণ করে চলতেন। যেমন,
১. ইমাম বুখারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (ওফাত -২৫৬ হিজরী) ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
(তাবকাতুশ শাফেয়ী পৃ:২/২)।
২. ইমাম মুসলিম (রহঃ) ওফাত -২৬১ হিজরী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
৩. ইমাম আবু দাউদ (ওফাত ২৭৫ হিজরী) ছিলেন শাফেয়ী আবার কেউ কেউ হাম্বালীও বলেছেন।
৪. ইমাম নাসাঈর (ওফাত ৩০৩ হিজরী) শাফেয়ী মাযহাব মানতেন।
৫. ইমাম তিরমিযী (ওফাত: ২৭৯ হিজরী) হানাফি ও হাম্বলী মাযহাবের প্রতি প্রভাবিত ছিলেন।
৬. ইমাম ইবনে মাজাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (মৃত্যু: ২৭৩ হিজরী ) শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
(ফয়জুলবারী, ১/৫৮)
এখানে উল্লেখ্য যে, সিহাহ সিত্তার সংকলকদের মধ্যে অনেকেই নিজে মুজতাহিদ ছিলেন। এর পরও মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃত চার মাযহাবের কোনো না কোনো মাযহাবের প্রতি তাদের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়।
৭. ইমাম আবু জাফর তাহাভী, (ওফাত: ৩২১ হিজরী), শামসুল আইম্মা সারাখসী ও ইবনে নুজাইম মিসরী হানাফী ছিলেন।
৮. ইমাম বায়হাকী ও ইমাম তাবরানী ছিলেন শাফেয়ী।
৯. বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহামতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন হাম্বলী।
১০. ইমাম ইবনে হাজর ও ইমাম যাহাবী ছিলেন শাফেয়ী।
১১. শারেহে বুখারী ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহামতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন হানাফী।
১২. শারেহে বুখারী ইমাম ক্বাস্তালানী ছিলেন শাফেয়ী।
১৩. ইমাম নাওয়াভী ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী।
১৪. ইমাম ইবনে আবিদল বার ও ইমাম বাত্তাল মালেকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
বর্তমানে কিছু লোক বলে থাকেন আমাদের জন্য কুরআন-হাদীস থাকতে মাযহাব মানতে হবে কেন? আবার কেউ কেউ বলে থাকেন একসময় বাংলায় অনুবাদ সহ কুরআন-হাদীস পাওয়া যেতনা বিধায় আলেমদের কথা মানতে হতো। এখন যেহেতু বাংলাতে অনেকগুলো কোরআন হাদীসের অনেকগুলো অনুবাদ সম্বলিত বই পুস্তক পাওয়া যায় তাই এগুলো পড়ে আমল করলে চলবে। অথচ এটি একটি মারাত্মক ভুল ও পথভ্রষ্টতা। আমরা পার্থিব বিষয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীদের উপর আস্থা রাখি কিন্তু শরিয়তের বিষয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীদের মতামত মানতে নারাজ। যেমন, অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যায়। মামলা মোকাদ্দমার জন্য আইনজ্ঞদের কাছে যায়। বর্তমানে ডাক্তারি বিষয়ে অনেক বই বাজারে পাওয়া যায়। ক্ষেত্র বিশেষে ফুটপাতেও বেচা-কেনা হতে দেখা যায়। এখন কেউ একজন বাজার থেকে ডাক্তারি বই কিনে পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট নীতিমালা না মেনে, প্রশিক্ষণ বিহীনভাবে নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে থাকে, তাহলে কেমন হবে? নিশ্চিত তিনি প্রতারক হবেন এবং গ্রেফতার হবেন। অনুরূপ আইনের কোর্স না পড়ে, প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করে এবং নীতিমালা অনুসরণ না করে কেউ যদি আইনজীবী পরিচয় দেয় তাহলে তিনিও প্রতারক হিসেবে গণ্য হবেন। অত্যন্ত বিস্ময়কার বিষয় হলো আমাদেরও কিছুলোক কুরআন হাদীসের গভীরে না গিয়ে কয়েকটি বাংলা অনুবাদ পড়ে বা ভিডিও শুনে-দেখে ফিকহী মাসয়ালা বের করতে যান, কথায় কথায় তারা মুখস্ত করা কুরআন ও হাদীসের দলিল দেন। অথচ আরবী ভাষার মত জটিল বিষয়ে সকলের পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। ইসলামি শরিয়তের এখনো অনেক দলিল প্রমাণাদী অনুবাদই হয়নি। তাই শত শত বৎসর ধরে বিশ^ব্যাপী আলিম-উলামাগণের কাছে সমাদৃত হলো নিজের আমলি জিন্দেগীতে কোন একটি মাযহাব অনুসরণ করে চলা। পূর্ব যুগের বিজ্ঞ আলিমরা নিজেরা ইজতিহাদ করার যোগ্যতা রাখলেও তারা তা না করে এ চার মাযহাব থেকেই একটিকে বেছে নিয়েছিলেন।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম।