মূল: আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা
ভাষান্তর : মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
আল্লাহ্ আয্যা ওয়া জাল্লা যদিও সন্তানের উপর পিতার হক্ব সর্বাধিক বলেছেন, এমনকি স্বীয় হক্বের সমান করে সেটার উল্লেখ করেছেন যে, أَنِ اشْكُرْ لِيْ وَلِوَالِدَيْكَ “হক্ব স্বীকার করো (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো) আমার এবং তোমার মাতাপিতার।” কিন্তু সন্তানের হক্বও পিতার উপর মর্যাদাপূর্ণ ও বড় রেখেছেন। কেননা সন্তান সাধারণভাবে ইসলাম, অতঃপর বিশেষ প্রতিবেশী, তারপর খাস নিকটতম, এরপর পরিবারের বিশেষ সদস্য- এসবের অধিকারসমূহের একত্রকারী হয়ে সর্বাধিক বিশেষত্ব ধারণ করে। আর যতই বিশেষত্ব বাড়তে থাকে তার হক্ব অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাগিদসম্পন্ন হতে থাকে। ওলামা-ই কিরাম নিজ নিজ মহত্বপূর্ণ গ্রন্থাদি যেমন- ইহইয়া-উল উলূম, ‘আইনুল উলূম, মাদ্খাল, কিমিয়ায়ে সা‘আদত, যখীরাতুল মুলূক প্রভৃতিতে সন্তানের হক্বসমূহের ব্যাপারে খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু উল্লেখ করেছেন; তবে আমি শুধু হুযূর পুর নূর সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মারফূ’ হাদীসসমূহের প্রতি মনোনিবেশ করেছি, আল্লাহ্ জাল্লা ওয়া ‘আলার অনুগ্রহে আশা যে, ফক্বীর (আ’লা হযরত)’র এ কিছু আক্ষরিক রচনা এমন উপকারী ও সার্বিক বিষয়কে একত্রকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, যার দৃষ্টান্ত বৃহদাকার গ্রন্থাদিতেও পাওয়া যাবে না। এ বিষয়ে যে পরিমাণ হাদীস শরীফসমূহ (আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসার ওসীলায়) এখন আমার স্মৃতি ও দৃষ্টিতে রয়েছে, সেগুলোকে বিস্তারিতভাবে তথ্যপঞ্জি সহকারে লিখলে, একটি পরিপূর্ণ ‘রিসালাহ্’ (পুস্তিকা) হয়ে যাবে। আর উদ্দেশ্য শুধু আহকামের ফায়েদা হাসিল করা। সুতরাং এখানে শুধু ওই অধিকারসমূহ, যা এ হাদীসসমূহ ইরশাদ করছে, অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে এবং সংক্ষেপে গণনা করছি। আল্লাহরই নিকট সামর্থ্য।
১) সর্বপ্রথম হক্ব সন্তান জন্মেরও আগে। প্রথম হক্ব হচ্ছে, ব্যক্তি কোন নীচু জাতের সম্প্রদায় ও বংশ থেকে বিবাহ করবে না। কেননা মন্দ ধমনী অবশ্যই রং ছড়ায়।
২) দ্বীনদার ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শাদী করবে, যেহেতু সন্তানের উপর নানা ও মামাদের স্বভাব-চরিত্রেরও প্রভাব পড়ে।
৩) কৃষ্ণাঙ্গ হাবশীদের মধ্যে আত্মীয়তা করবে না, যাতে মায়ের কালো রং সন্তানকে বিশ্রী/কুৎসিত করে না দেয়।
৪) সহবাসের সূচনা ‘বিসমিল্লাহ্’ দ্বারা করবে, নতুবা সন্তানের মধ্যে শয়তান শরীক হয়ে যায়।
৫) ওই সময় স্ত্রীর লজ্জাস্থানের প্রতি দৃষ্টি দিবে না, কেননা এতে সন্তান অন্ধ হওয়ার আশংকা রয়েছে।
৬) এ সময়ে বেশি কথাবার্তা বলবে না, কারণ এর দ্বারা সন্তান বোবা অথবা তোতলা হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭) স্বামী-স্ত্রী নিজেদেরকে কাপড় দিয়ে ঢেকে নেবে, জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় উলঙ্গ হবে না। এতে সন্তান বেহায়া তথা লজ্জাহীন হওয়ার শংকা রয়েছে।
৮) যখন সন্তান জন্ম নেয়, তখনই ডান কানে আযান, বাম কানে তাক্ববীর বলবে, যাতে শয়তানের আক্রমণ ও ‘উম্মুস সিব্ইয়ান’ (শিশুরোগ বিশেষ, যে রোগে শিশুর শরীর শুকিয়ে যায়) থেকে রক্ষা পায়।
৯) খেজুর অথবা অন্য কোন মিষ্টি বস্তু চিবিয়ে তার মুখে রাখবে, এটি মিষ্টি চরিত্রের ফাল-এর ক্ষেত্রে উত্তম।
১০) সপ্তম দিবসে, সম্ভব না হলে চতুর্দশ দিবসে নতুবা একবিংশ (২১) দিবসে আক্বীক্বা করবে। কন্যার জন্য একটি, পুত্রের জন্য দুটি (ছাগল); এতে যেন সন্তানের ঋণ পরিশোধ করা হয়।
১১) (ছাগল) একটি রান ধাত্রীকে প্রদান করবে, এটি সন্তানের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
১২) মাথার চুল মু-ন করে দেবে।
১৩) চুলগুচ্ছের সমপরিমাণ রৌপ্য সাদ্ক্বাহ্ করবে।
১৪) মাথার উপর যাফরান লাগাবে।
১৫) নাম রাখবে; এমনকি কচি বাচ্চারও, যে কম বয়সে মারা যায়। অন্যথায় আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে সে অভিযোগকারী হবে।
১৬) মন্দ নাম রাখবে না, কেননা মন্দ ফাল মন্দ হয়।
১৭) আবদুল্লাহ্, আবদুর রহমান, আহমদ, হামিদ ইত্যাদি ইবাদত ও হামদ সম্পর্কিত নাম অথবা আম্বিয়া-ই কিরাম, আউলিয়া-ই কিরাম নিজ নিজ বুযুর্গগণের মধ্যে যেসব নেককার লোক অতিবাহিত হয়েছেন, তাঁদের নামানুসারে নাম রাখবে, যা বরকতের কারণ ও ওসীলাহ্। বিশেষ করে পবিত্র নাম ‘মুহাম্মদ’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, কেননা এ নাম মুবারক-এর অপরিসীম বরকত সন্তানের দুনিয়া ও আখিরাতে কাজে আসে।
১৮) যখন ‘মুহাম্মদ’ নাম রাখবে, তখন তার সম্মান ও মর্যাদা বজায় রাখবে।
১৯) মজলিসে তার জন্য স্থান ছেড়ে দেবে।
২০) তাকে প্রহার করা, মন্দ বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বণ করবে।
২১) সে যা চাইবে, উপযুক্ত হলে প্রদান করবে।
২২) ভালবেসে ছোট অমর্যাদাপূর্ণ উপাধি রাখবে না, কেননা ছড়িয়ে পড়া নাম সহজে বিলোপ করা যায় না।
২৩) মা কিংবা নেককার ধাত্রী, নামাযী, সতীসাধ্বী, সম্প্রদায়ের মধ্যে অভিজাত, ভদ্র রমণী থেকে দু’ বছর দুধ পান করাবে।
২৪) নীচু জাতের অথবা মন্দকর্ম সম্পাদনকারিনী রমণীর দুধ থেকে সুরক্ষিত রাখবে। কারণ দুধ স্বভাব পরিবর্তন করে দেয়।
২৫) সন্তানের ভরণপোষণ, তার প্রয়োজনের সব সামগ্রী প্রস্তুত রাখা স্বয়ং ওয়াজিব, যাতে হিফাযতও অন্তর্ভূক্ত।
২৬) নিজের প্রয়োজনসমূহ ও শর‘ঈ কর্তব্যগুলো পালনের পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, সেখানে প্রিয়জন, নিকটাত্মীয়, অভাবী দরিদ্রসমাজ সবার আগে হক্ব হচ্ছে- পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের। তাদের প্রয়োজন মেটানোর পর যা বাকী থাকে, সেটা অপরজনদের নিকট প্রেরণ করবে।
২৭) সন্তানকে পবিত্র উপার্জন থেকে রুজি রিয্ক্ব দেবে, কারণ নাপাক সম্পদ নাপাক স্বভাবের প্রতি ধাবিত করে।
২৮) সন্তানদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে খাবার গ্রহণ তথা একাকী খাবে না, বরং নিজের কামনা-বাসনাকে তাদের কামনা-বাসনার অনুগত করে নেবে। যে ভাল বস্তু আহার করার তাদের ইচ্ছা জাগে, তাদেরকে দেবে। তাদের ওসীলায় নিজেও খাবে। বেশি না হলেও তাদের খাওয়াবে।
২৯) খোদা তা‘আলার এ আমানতগুলোর সাথে ¯েœহ-ভালবাসার আচরণ করবে। তাদেরকে প্রীতি দেবে, শরীরের সাথে জড়িয়ে শোয়াবে, কাঁধে বহন করবে।
৩০) তাদের সাথে হাসি, মজা, খেলা, মুগ্ধ করার কথাবার্তা বলবে। তাদের মনতুষ্টি, মনের খুশি, প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ সর্বসময়ে, এমনকি নামায ও খোতবার মধ্যেও নজরে রাখবে।
৩১) মৌসুমের নতুন ফলমূল প্রথমে তাদের দেবে; কেননা তারা তাজা ফল। নতুনকে নতুন দেয়া উপযুক্ত।
৩২) কখনো কখনো প্রয়োজন অনুসারে তাদেরকে শিরনী ইত্যাদি খেতে, পরিধেয় বস্ত্র, খেলাধুলার ভাল বস্তু (যা শরী‘আতে বৈধ) দিতে থাকবে।
৩৩) মন ভুলানোর জন্য মিথ্যা ওয়াদা করবে না, বরং সন্তানের সাথেও ওয়াদা সেটাই বৈধ, যা পূরণ করার ইচ্ছাপোষণ করে থাকে।
৩৪) নিজের একাধিক সন্তান হলে, সবাইকে বরাবর ও সমান প্রদান করবে। একজনকে অপরের উপর দ্বীনী ফযীলত ব্যতিরেকে প্রাধান্য দেবে না।
৩৫) সফর থেকে আসলে তাদের জন্য কিছু তোহফা (উপহার) অবশ্যই আনবে।
৩৬) অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাবে।
৩৭) যতদূর সম্ভব কঠিন ও কষ্টদায়ক চিকিৎসা থেকে রক্ষা করবে।
৩৮) মুখের বুলি ফুটতেই আল্লাহু আল্লাহু, অতঃপর সম্পূর্ণ কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হ, তারপর পূর্ণাঙ্গ কলেমা-ই ত্বায়্যিবাহ্ শেখাবে।
৩৯) যখন ভাল-মন্দের পার্থক্য করার বোধ আসবে, তখন আদব শিক্ষা দেবে পানাহার, হাসি, কথা বলা, উঠা-বসা, চলাফেরা, লজ্জাশীলতা, অপরকে নযরে রাখা, বুযুর্গবৃন্দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, মাতাপিতা, ওস্তাদ-এর এবং কন্যাকে স্বামীরও আনুগত্যের ত্বরীক্বা ও আদব শিক্ষা দেবে।
৪০) ক্বোরআন মাজীদ পড়াবে।
৪১) নেককার, সৎ, মুত্তাক্বী, সহীহ আক্বীদাহ সম্পন্ন বয়ষ্ক ওস্তাদের নিকট সোপর্দ করবে এবং কন্যাকে নেককার পবিত্র রমণীর মাধ্যমে পড়াবে।
৪২) ক্বোরআন খতমের পর সর্বদা তিলাওয়াতের তাগিদ দিতে থাকবে।
৪৩) আক্বা-ইদ-ই ইসলাম ও সুন্নাত শিক্ষা দেবে; কেননা সে সাদাসিধা ইসলামী ফিতরাত্ (স্বভাব-চরিত্র) ও সত্য গ্রহণের উপর সৃষ্টি হয়েছে। সেসময়ের বলা কথামালা চিরস্থায়ী হবে।
৪৪) হুযূর-ই আক্বদাস রহমত-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মুহাব্বত ও সম্মান তাদের অন্তরসমূহে ঢেলে দেবে; যা আসল ঈমান এবং প্রকৃত ঈমান।
৪৫) হুযূর পুর নূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র বংশধর, সাহাবীগণ, আউলিয়া ও ওলামা-এর মুহাব্বত ও সম্মান শিক্ষা দেবে; যা আসল সুন্নাত এবং ঈমানের অলংকার, বরং ঈমান টিকে থাকার মাধ্যম।
৪৬) সাত বছর বয়স থেকে মুখে নামাযের তাগিদ শুরু করে দেবে।
৪৭) ইলমে দ্বীন বিশেষভাবে ওযূ, গোসল, নামায, রোযা’র মাসা-ইল, তাওয়াক্কুল (আল্লাহ্র উপর ভরসা), অল্পেতুষ্টি, দুনিয়াবিমুখতা, ইখলাস (নিষ্ঠা), বিনয়, আমানতদারী, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, লজ্জা, অন্তর ও জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সৌন্দর্যসমূহের ফাযা-ইল; লোভ-লালসা, দুনিয়ার প্রেম, আত্মমর্যাদার মোহ, রিয়া (লৌকিকতা), অহমিকা, অহংকার, খিয়ানত, মিথ্যা, যুল্ম (নির্যাতন), অশ্লীলতা, গীবত (পরনিন্দা), হাসদ (হিংসা), বিদ্বেষ ইত্যাদি মন্দসমূহের কুফল সম্পর্কে পড়াবে।
৪৮) পড়ানো ও শেখানোর ক্ষেত্রে ¯েœহ ও ন¤্রতার খেয়াল রাখবে।
৪৯) উপযুক্ত সময়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাবধান, ভীতিপ্রদর্শন করবে কিন্তু অভিশাপ দেবে না। কারণ তাদেরকে অভিশাপ দেয়া তাদের জন্য সংশোধনের উপায় হবে না, বরং আরো বেশি ফ্যাসাদ-এর আশংকা রয়েছে।
৫০) প্রহার করলে, মুখে মারবে না।
৫১) বেশিরভাগ সময়ে ধমক ও ভীতিপ্রদর্শনের উপর যথেষ্ট করবে; বেত্র ও চাবুক তার চোখের সামনে রাখবে, যাতে অন্তরে ভীতি সঞ্চার হয়।
৫২) শিক্ষার্জনের সময়ে একটি সময় খেলাধুলার জন্য প্রদান করবে, যাতে স্বভাবে প্রফুল্লতা বাকী থাকে।
৫৩) কিন্তু খবরদার খবরদার মন্দ সংস্পর্শে বসতে দেবে না। কেননা মন্দ সাথী বিষাক্ত অজগর থেকেও নিকৃষ্ট।
৫৪) কখনো বাহার দানিশ, মীনা বাজার (আনন্দ মেলা), গণীমত প্রভৃতি পাপাচারপূর্ণ অশ্লীল প্রেম-ভালবাসার গ্রন্থাদি দেখতে দেবে না; কেননা নরম লাকড়ী যেদিকে ঝুঁকানো হয়, ঝুঁকে পড়ে। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, মেয়েদেরকে সূরা ইয়ূসূফ শরীফ-এর তরজমা পড়ানো যাবে না। কারণ তাতে নারীদের প্রতারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অতঃপর সন্তানদেরকে কবিতার কুসংস্কারসমূহের মধ্যে ঢেলে দেয়া কীভাবে সমীচীন হতে পারে?
৫৫) যখন দশ বছর বয়সের হবে, প্রহার করে নামায পড়াবে।
৫৬) এ বয়সে নিজের বা কারো সাথে শোয়াবে না; পৃথক বিছানা, পৃথক খাটে নিজের কাছে রাখবে।
৫৭) যখন যুবক হবে, শাদী করিয়ে দেবে। বিবাহ-শাদীতে বংশ, দ্বীন, ‘সীরত’ (জীবন চরিত) ও ‘সূরত’ (অবয়ব-আকৃতি)’র প্রতি লক্ষ্য রাখবে।
৫৮) এখন যদি এমন কাজের কথা বলতে হয়, যাতে অবাধ্যতার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে সেটা নির্দেশ ও হুকুমের শব্দাবলি দ্বারা বলবে না, বরং ¯েœহ, ন¤্রতায় পরামর্শমূলকভাবে বলবে। যাতে সে পিতামাতার অবাধ্যতার বিপদে না পড়ে যায়।
৫৯) তাকে উত্তারাদিকার থেকে বঞ্চিত করবে না। যেমন: কিছু লোক নিজের কোন ওয়ারিসের সাথে সম্পর্ক বজায় না থাকার কারণে সম্পূর্ণ সম্পত্তি অপর ওয়ারিসদের অথবা অপর কোন ব্যক্তির নামে লিখে দেয়।
৬০) নিজের মৃত্যুর পরও তাদের চিন্তা রাখবে। অর্থাৎ কমপক্ষে দু’তৃতীয়াংশ উত্তরাধিকার সম্পদ রেখে যাবে। তৃতীয়াংশের বেশি সাদক্বাহ-খায়রাত করবে না।
এ ৬০ (ষাট) হক্ব তো পুত্র-কন্যা সবারই, বরং শেষোক্ত দু’ হক্বের মধ্যে সকল ওয়ারিস অংশীদার। আর বিশেষ করে পুত্রের হক্বসমূহের মধ্যে এও রয়েছে যে, তাকে (৬১) লিখন, (৬২) সাঁতার কাটা, (৬৩) সৈন্য-সিপাহীর কাজ শিখাবে, (৬৪) সূরা মা-ইদাহ্ শিক্ষা দেবে, (৬৫) ঘোষণা করে তার খতনা করাবে।
আর বিশেষ করে কন্যার হক্বসমূহের মধ্যে রয়েছে, (৬৬) তার জন্ম হওয়ার উপর অখুশী হবে না, বরং আল্লাহ্র নি’মাত জানবে; (৬৭) তাকে সেলাই করা, সূঁচের মধ্যে সুতা গাঁথা, সুতাকাটা, খাবার রান্না করা শেখাবে, (৬৮) সূরা নূর শিক্ষা দিবে। (৬৯) এমন কিছু শেখাবে না। যাতে ফিতনার সম্ভাবনা রয়েছে। (৭০) কন্যাদের অধিক সন্তুষ্ট রাখবে, কারণ তাদের অন্তর খুবই অল্পে (সন্তুষ্ট) হয়ে থাকে। (৭১) কোন কিছু দেয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে এবং পুত্রদেরকে সমান মাপে রাখবে; (৭২) যে বস্তু প্রদান করবে, প্রথমে তাদেরকে দিয়ে পুত্রদেরকে দেবে। (৭৩) নয় (৯) বছর বয়স থেকে না নিজের সাথে শোয়াবে, না ভাই ও অন্য কারো সাথে ঘুমাতে দেবে। (৭৪) এ বয়স থেকে বিশেষ পর্যবেক্ষণ শুরু করবে; (৭৫) বিবাহ-শাদীর অনুষ্ঠানে যেখানে গান-বাজনা হয়, তাকে কখনো যেতে দেবে না, যদিওবা খাস নিজের ভাইয়ের বাড়ীতে হয়; কেননা গান অতীব জটিল জাদু। (৭৬) ওই সুক্ষ্ম সীসা/কাঁচগুলোকে সামান্য আঘাতও বেশি হয়ে যায়, বরং দাঙ্গা-গ-গোলে যাওয়া থেকে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা বিধান করবে; গৃহকে তাদের শ্রীঘর করে দেবে; বালাখানা, প্রাসাদে থাকতে দেবে না; (৭৭) গৃহে পোষাক ও অলংকারে সুসজ্জিত রাখবে, যাতে বিবাহের প্রস্তাব উৎসাহ নিয়ে আসে; (৭৮) যখন ‘কুফূ’ তথা সমতাবিধান হয়, তখন বিবাহে দেরি করবে না; (৭৯) যতদূর সম্ভব ১২ বছর বয়সে বিবাহ দিয়ে দেবে; (৮০) কখনো কোন ফাসিক্ব (পাপাচারী), ‘ফাজির’ (অপকর্মে লিপ্ত) ব্যক্তিকে বিশেষ করে বদ মাযহাবীকে বিবাহ দেবে না।
এ আশি (৮০) টি হক্ব এখন আমার দৃষ্টিতে মারফূ’ হাদীসসমূহের আলোকে স্মরণে এসেছে। তন্মধ্যে বেশিরভাগ তো মুস্তাহাব, যেগুলো ছেড়ে দিলে মূলত: অভিযুক্তকরণ নেই। আর কিছু বিষয়ে আখেরাতে জিজ্ঞাসা রয়েছে, কিন্তু দুনিয়াতে পুত্রের জন্য পিতার উপর গ্রেফতার ও জবরদস্তি নেই। না পুত্রের জন্য বৈধ হবে পিতার সাথে ঝগড়া ও বিবাদে জড়ানো, কিছু হক্ব ব্যতীত, যেগুলোতে হাকেম (বিচারক)’র জবরদস্তি, তদবীর ও আপত্তি অন্তর্ভূক্ত।
প্রথম: ভরণপোষণ, যা পিতার উপর ওয়াজিব এবং তিনি যদি তা না দেন, তাহলে হাকেম (বিচারক) জোর করে নির্ধারণ করবেন। না মানলে কারাবন্দি করা হবে। অথচ শাখা-প্রশাখার অন্য কোন দ্বীনে বন্দি করার আইন নেই।
فى رد المحتار عن الذخيرة لا يحبس والد وان علا فى دين ولده وان سفل الا فى النفقة لان فيه اتلاف الصغير-
“ফাতাওয়া-ই শামীতে যখীরার সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, পিতাকে নিজ পুত্রের ঋণের বিষয়ে বন্দি করা যাবে না, চাই তা বংশধারার উর্ধ্বতন হিসেবে পিতা এবং নি¤œতর হিসেবে পুত্র হয়ে যান। তবে অবশ্যই ভরণপোষণের অনাদায়ীর ক্ষেত্রে পিতাকে বন্দি করা যেতে পারে; কেননা এতে ছোট্ট শিশুর হক্ব নষ্ট করা হয়।”
দ্বিতীয়: স্তন্যপান তথা মায়ের দুধ না হলে, দাঈ (ধাত্রী) রাখা। বিনা মজুরীতে পাওয়া না গেলে, মজুরী দেয়া। আবশ্যিকভাবে না দিলে, জবরদস্তি গ্রহণ করা হবে, কারণ সন্তানের নিজস্ব সম্পদ নেই। অনুরূপ মা তালাকের পর ইদ্দত পালনকালে মজুরী ছাড়া দুধ পান না করালে, তাকেও মজুরী দেয়া হবে। (যেমন- ফাতহ্ ও রদ্দুল মুখতার প্রভৃতি গ্রন্থে রয়েছে।)
তৃতীয়: (শিশুর) লালনপালন, পুত্র সাত বছর, কন্যা নয় বছর বয়স পর্যন্ত যে সকল রমণী যথা: মা, নানী, দাদী রয়েছে, খালা, ফুপীর নিকট রাখা হবে; যদি তাদের মধ্যে কেউ মজুরী ছাড়া না মানে এবং সন্তান ফক্বীর আর পিতা ধনী, তাহলে জোর করে মজুরী নিয়ে প্রদান করা হবে। (যেমন- রদ্দুল মুখতারে সেটি স্পষ্ট করা হয়েছে।)
চতুর্থ: লালনপালনের পর সন্তানকে নিজের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করা পিতার উপর ওয়াজিব। যদি না নেয়, তাহলে হাকেম (বিচারক) জোর করবে। (যেমন: শরহুল মাজমা’ থেকে রদ্দুল মুখতার-এর মধ্যে বর্ণনা করা হয়েছে।)
পঞ্চম: তাদের জন্য উত্তরাধিকার সম্পদ অবশিষ্ট রাখা। উত্তরাধিকার হক্ব-এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার পর অর্থাৎ মৃত্যুশয্যায় উত্তারধিকার রেখে যাওয়া ব্যক্তি এটার উপর বাধ্য হন। এমনকি তৃতীয়াংশের বেশি সম্পদের ক্ষেত্রে তার ওসীয়ত ওয়ারিসগণের অনুমতি ছাড়া বাস্তবায়ন হবে না।
ষষ্ঠ: নিজের বালেগ (প্রাপ্ত বয়ষ্ক) সন্তান পুত্র হোক বা কন্যাকে সমতাবিধান ব্যতীত বিবাহ দেয়া অথবা মহর-ই মিসল (সামঞ্জস্যপূর্ণ মহর)-এর ক্ষেত্রে চরম প্রতারণা সহকারে যেমন: কন্যার মহর-ই মিসল হাজার টাকা, পাঁচশ টাকায় করিয়ে দিয়েছে, অথবা পুত্র বধুর মহর-ই মিসল পাঁচশ, সেক্ষেত্রে হাজার নির্ধারণ করে নেয়া, কিংবা পুত্রের বিবাহ কোন দাসীর সাথে অথবা কন্যাকে কোন এমন ব্যক্তির সাথে, যে মাযহাব বা বংশ, অথবা পেশা বা কর্মে কিংবা অর্থ সম্পদের ক্ষেত্রে ওই লোকসান ধারন করে, যার দরুন তার সাথে বিবাহ লজ্জার কারণ হয়। একবার তো এমন বিবাহ বাপ কর্তৃক হলে বাস্তবায়িত হয়, যখন নেশাগ্রস্ত থাকে; কিন্তু দ্বিতীয়বার নিজের অপর কোন নাবালেগ সন্তানের এমন বিবাহ করালে, তাহলে সেটা প্রকৃতপক্ষে সহীহ হবে না। (যেমনিভাবে বিবাহের আলোচনায় আমি ইতিপূর্বে তা বর্ণনা করেছি।)
সপ্তম: খতনার ক্ষেত্রেও একটি জোর করার পন্থা রয়েছে। যদি কোন শহরের লোক এটি ত্যাগ করে, তাহলে ইসলামী বাদশাহ তাদেরকে বাধ্য করবে। যদি না মানে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। ( যেমন- রদ্দুল মুহতার গ্রন্থে রয়েছে।)
আল্লাহ্ তা‘আলা সর্বাধিক জ্ঞাতা।
নোট: প্রবন্ধটি আ’লা হযরত ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির স্বরচিত রিসালাহ্-
-এর বঙ্গানুবাদ। مشعلة الارشاد فى حقوق الاولاد
লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।