নামাযে বিনয়ী ও একাগ্রতায় মু‘মিনের সফলতা

0

মাওলানা মুহাম্মদ আখতার হোসাইন

নামায ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। আল্লাহ্’র সান্নিধ্য ও নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম, অন্যায়-অপরাধ বর্জনের উপায়, উৎকর্ষ জীবন গড়নের হাতিয়ার, সর্বোপরি মু’মিনদের ইহ-পরকালে মঙ্গল ও সফলতার উপকরণ। তবে সে নামায আদায় হতে হবে বিনীত, নম্্র, একাগ্র ও খোদাভীরু হয়ে। রুহ ছাড়া শরীর যেমন গুরুত্বহীন, বিনয় ও একাগ্রতা ছাড়া নামাযও অনুরূপ। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে বিনীতভাবে নামায আদায়ের সফলতা স¤পর্কে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। সূরা মু’মিনূন এর শুরুতে আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন-
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ
“অবশ্য সফলকাম হয়েছে মু’মিনগণ, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র”। বর্ণিত আয়াতে خَاشِعُونَ – خشوع থেকে গৃহীত। মূল বর্ণ خشع; পবিত্র কুরআনে এটার তের বার উল্লেখ হয়েছে। خشوع এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বিনীত, নম্র, একাগ্র, বিনয়, নম্রতা, বিনম্রতা ও একাগ্রতা। خشوع এর আভিধানিক অর্থ বর্ণনায় ইবনু রজব বলেন, لين القلب ‘কোমল হৃদয়’। ইবনু কাইয়্যুম এর মতে, রবের সামনে বিনয়ের সাথে হৃদয়ের স্থিরতা। ইমাম কুরতুবী’র মতে, বিনয়ী, স্থির ও অবনত। যখন হৃদয় বিনয়ী হয়, এর প্রভাবে প্রতিটি অঙ্গ বিনীত হয়। কোন কোন মুফাস্সির এর মতে, অবনত হাওয়া। যেমন সূরা ক্বলমের ৩৩ নং আয়াত এবং সূরা আল মা’আরিজ এর ৪৪ নং আয়াতে বর্ণনা এসেছে, خَاشِعَةً أَبْصَارُهُمْ “তাদের দৃষ্টি অবনত”।

নামাযে বিনয় ও একাগ্রতার পরিচয়
আল্লামা ইবনে কাসীর বলেন, নামাযে বিনয় ( خشوع ) হচ্ছে, হৃদয় (قلب) অন্য সব থেকে বিমুখ হয়ে নামাযে মনোযোগী হওয়া। আর এর প্রভাব পড়বে শরীরের বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। তখন নামাযে অন্তর প্রশান্ত ও শীতল হয়। আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী বলেন, خشوع (বিনয় ) হচ্ছে নামাযে বাহ্যিক অঙ্গ স্থির থাকা এবং হৃদয়ে খোদাভীতি থাকা। আল্লামা যামাখশারী বলেন, নামাযে خشوع (বিনয়) হচ্ছে নামাযের শিষ্টাচারিতা। অর্থাৎ নামাযে দাম্ভিকতা, কাপড়ে ঝালর লাগানো, হাই তোলা, চোখ বন্ধ রাখা, মুখ ঢেকে রাখা, কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া, আঙ্গুল মটকানো, আঙ্গুল পাকানো এবং নুড়ি-কংকর সরানো ইত্যাদি বর্জন করাই নামাযে বিনয়।
তাফসীরে খাযেন এ সূরা ম‘ুমিনুন এ বর্ণিত خَاشِعُونَ এর ব্যাখ্যায় দশটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে, এক. অনুগত বিনয়ী হওয়া, দুই. ভীত হওয়া, তিন. ন¤্রতা প্রদর্শন করা, চার. ভয়-ভীতির ন্যায় আত্মক্রিয়ার শঙ্কা প্রকাশ করা, পাঁচ. শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্ম, যেমন- স্থিরতা ভ্রƒক্ষেপ পরিহার ও দৃষ্টি অবনত রাখা, ছয়. হৃদয় ও বাহ্যিক অঙ্গের ক্রিয়া সমষ্টি, সাত. ডানে-বামে অবস্থানকারী সম্পর্কে অবগত না হওয়া, আট. আকাশের দিকে না তাকানো, নয়. শরীরের কোন অংশ নিয়ে খেলায় মগ্ন না থাকা, দশ. আল্লাহ্ ছাড়া সবকিছু থেকে বিমূখ হয়ে তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ করা, মুখে উচ্চারিত তেলাওয়াত ও যিকিরে গভীর ধ্যান থাকা।

হাদীসের আলোকে নামাযে বিনয়
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য বাণী ও সাহাবায়ে কেরামের অগণিত বর্ণনায় নামাযে বিনয়-একাগ্রতার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; যাতে একাগ্রতার পরিচয়-মর্মার্থ স্পষ্ট হয়। তম্মধ্যে কতেক বর্ণনা নি¤েœ তুলে ধরা হলো-

এক. নামাযে ভ্রক্ষেপ পরিহার করা
নামাযরত অবস্থায় মুখ ও চোখের দৃষ্টি ডানে-বামে-উপরের দিকে না থাকা বরং দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি থাকবে সাজদার স্থানে, রুকু অবস্থায় দৃষ্টি থাকবে পায়ের দিকে আর বসা অবস্থায় দৃষ্টি থাকবে কোলের দিকে, শরীরের অঙ্গ থাকবে আপন স্থানে স্থির; যেহেতু নামাযরত অবস্থায় আল্লাহ্’র অনুগ্রহ-রহমত বান্দার মুখোমুখি থাকে। নামাযী ব্যক্তি আপন স্থান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ্’র রহমত সরে পড়ে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إذَا قَامَ الرَّجُلُ يُصَلِّي فَإِنَّ الرَّحْمَةَ تُوَاجِهُهُ فَإِذَا الْتَفَتَ انْصَرَفَتْ عَنْهُ
“বান্দা যখন নামায পড়ে অবশ্য রহমত তারই মুখোমুখি থাকে। আর যখন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন রহমত তার থেকে দূরে চলে যায়”।
* হাদীস শরীফে বর্ণনা রয়েছে, “বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায়, সে যেন দয়াময় আল্লাহ্’র সামনে দন্ডায়মান হয়েছে। সে যখন অন্য দিকে তাকায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যার দিকে তাকাচ্ছো সে কি আমার থেকে উত্তম? হে বনী আদম! আমার দিকে এসো, তুমি যার দিকে তাকিয়েছো তার চেয়ে আমি উত্তম”। (তাফসীরে রুহুল বয়ান)
* হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে নামাযে অন্য দিকে ভ্রƒক্ষেপ স¤পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
هُوَ اخْتِلاَسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلاَةِ العَبْدِ
“তা হচ্ছে বান্দার নামাযে শয়তানের আত্মসাৎ করা কিংবা ছোঁমারা”। (সহীহ বুখারী)
* নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা ইয়াহইয়া ইবনে জাকারিয়া ও তার সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিলেন যে, যখন তোমরা নামাযে দাঁড়াও ভ্রƒক্ষেপ করো না, যেহেতু বান্দা নামাযে যতক্ষণ না ভ্রƒক্ষেপ করে, ততক্ষণ তার চেহারার প্রতি আল্লাহ্’র দৃষ্টি থাকে”। (সুনানু তিরমিযি)
* হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
إِذا صليت فَإِن رَبك أمامك وَأَنت مناجيه فَلَا تلْتَفت
“যখন নামাযে দাঁড়াও তখন যেন তোমার রব তোমার সামনে আর তুমি তাঁর সাথে নিভৃত আলাপরত, সুতরাং অন্যদিকে ভ্রƒক্ষেপ করো না”। (আদ্দুররুল মানসূর)

দুই. নামাযে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আপন স্থানে স্থির থাকা
নামাযরত অবস্থায় মুসল্লির মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাহ্যিক প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আপন স্থানে স্থির, নীরব ও অবিচল থাকা। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের খেলা, অহেতুক নাড়াচাড়া এবং হেলাফেলা থেকে বিরত থাকা; যাতে নামাযের একাগ্রতা-বিনয় বিনষ্ট না হয়। এর প্রতি ইঙ্গিত করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
اُسْكُنُوا فِي الصَّلَاةِ وَكُفُّوا أَيْدِيَكُمْ فِي الصَّلَاةِ
“তোমরা নামাযে স্থির থেকো এবং হাত দু’টিকে অহেতুক নাড়াচাড়া থেকে বিরত রেখো”।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বিবিজান হযরত উম্মে রুমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “একদা সিদ্দিকে আকবর আমাকে নামাযে ঝুঁকে পড়তে দেখে এমন ধমক দিলেন যে, শেষ পর্যন্ত আমি নামায ছেড়ে দিই। অত:পর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তোমাদের কেহ নামাযে যখন দাঁড়ায় যেন তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ/ আশপাশ স্থির থাকে ইয়াহুদীর মত ঝুঁকে না পড়ে, যেহেতু নামাযে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থির ও নীরব থাকাই নামাযের পরিপূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ”। (তাফসীরে রুহুল মা‘আনী)

তিন. নামাযে দৃষ্টি অবনত রাখা
নামাযরত অবস্থায় মুসল্লির দৃষ্টি অবনত রাখা। আকাশের দিকে কিংবা উপরের দিকে না উঠানো। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নামাযে আকাশের দিকে দৃষ্টি উঠাতেন, আল্লাহ্ তা’আলা সূরা মু’মিনুন এর প্রথম আয়াতদু’টি অবতীর্ণ করে বলেন, “নিশ্চয়ই সেসব মু’মিন সফল, যারা নিজেদের নামাযে বিনম্র হয়”। তখন থেকে সাহাবীগণ নামাযে তাদের দৃষ্টি সাজদার স্থানের দিকে অবনত রাখেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

চার. নামাযে হাত-পায়ের অহেতুক নাড়াচাড়া বর্জন করা
নামাযরত অবস্থায় মুসল্লি নিজ হাত-পা আপন অবস্থায় স্বাভাবিক রাখা। হাত-পা দিয়ে অহেতুক নাড়াচাড়া, খেলা করা, অঙ্গ চুলকানো, অঙ্গ ঘষামাজা করা, টুপি-পাগড়ি ও কাপড় ভাঁজ করা ইত্যাদি অনর্থক হাত-পায়ের কর্ম, যা মুসল্লিকে অমনোযোগী করে। হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে দেখলেন নামাযে দাঁড়ি নিয়ে খেলা খেলতে, তিনি বললেন, لو خشع قلب هذا خشعت جوارحه “যদি এর হৃদয় বিনীত ও ভীত হতো, তাহলে তার বাহ্যিক অঙ্গসমূহও নম্র ও একাগ্রতা হতো”। (তাফসীরে বগভী)

পাঁচ. নামাযে চোখ-কান বিনয়ী হওয়া
নামাযে একাগ্রতা থাকলে চক্ষু শীতল হয়। আর পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে কান মনোযোগী-ধ্যানী হয় এবং অশ্রুসিক্ত হয়। তাইতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
وَجُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلَاةِ
“নামাযে আমার চোখ প্রশান্তি জুড়ায়”। (সুনানু নাসায়ী)
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামাযে দোয়া পড়তেন,
اَللّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ،
خَشَعَ لَكَ سَمْعِي، وَبَصَرِي،
“হে আল্লাহ্ আপনার জন্য রুকু’ করেছি, আপনার উপর ঈমান এনেছি, আপনার নিকট আত্মসমর্পণ করেছি, আমার চোখ-কান আপনার প্রতি বিনয়ী”। (সুনানু আবূ দাউদ)

ছয়. নামাযে নুড়ি-কংকর পরিষ্কার করা থেকে বিরত থাকা
নামাযের স্থান থেকে নুড়িপাথর কণা-কংকর দূরীভূত করা, পরিষ্কার ও মোছা থেকে বিরত থাকা; যেহেতু এতে একাগ্রতা বিনষ্ট হয়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
اذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلاَةِ فَلاَ يَمْسَحِ
الحَصَى، فَإِنَّ الرَّحْمَةَ تُوَاجِهُهُ
“তোমাদের কেহ যখন নামাযে দাঁড়ায়, নুড়িপাথর যেন পরিষ্কার না করে; যেহেতু আল্লাহ্’র রহমত তখন তার মুখোমুখি হয়”। (সুনানু তিরমিযি)
আবু সালেহ বলেন,“সাজদার সময় যেন কণা পরিস্কার না করে; যেহেতু প্রতিটি কণা সেটার উপর সাজদা করা পছন্দ করে”। (তুহফাতুল আহওয়াযী শরহে জামে‘ তিরমিযি)

সাত. নামাযে হৃদয় একাগ্র-ভীত হওয়া
নামাযে বিনয়ের প্রধান উৎস ক্বলব। ক্বলবে আল্লাহ্ ভীতি ও বিনয়ের প্রতিক্রিয়া বাহ্যিক অঙ্গে প্রভাব পড়ে। তাই নামাযে একাগ্রতা, মনোযোগ, গভীর ধ্যান ও বিনয়-নম্রতার উৎস স্থল হৃদয়-অন্তর-রুহ-নফস-ক্বলব। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিনীত হৃদয়ের প্রার্থনা করে বলতেন,“হে আল্লাহ্ আপনার নিকট এমন জ্ঞান (ইলম) থেকে আশ্রয় চাই যা উপকার করে না, এমন ক্বলব থেকে যা বিনীত নয়, এমন চোখ থেকে যা সিক্ত নয়, এমন ফরিয়াদ থেকে যা কবুল হয় না”। (সহীহ মুসলিম)

আট. রুকু-সাজদা ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা
নামাযে একাগ্র হওয়ার অন্যতম দর্শন হচ্ছে নামাযের প্রতিটি আরকান ধীর স্থিরভাবে প্রশান্তি নিয়ে আদায় করা। বিশেষত রুকু’ সাজদা স্থিরচিত্তে আদায় করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ أَسْوَأَ النَّاسِ سَرِقَةً الَّذِي يَسْرِقُ صَلَاتَهُ، قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَكَيْفَ يَسْرِقُهَا قَالَ لَا يُتِمُّ رُكُوعَهَا وَلَا سُجُودَهَا
“নিশ্চয় মানুষের সবচেয়ে নিকৃষ্ট চুরি হচ্ছে যে নামাযে চুরি (প্রতারণা) করে, সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে নামাযে চুরি করে? তিনি বললেন, যে নামাযের রুকু-সিজদা পরিপূর্ণ আদায় করে না”।
(সুনানু দারমী)
নামাযে বিনয়-একাগ্রতার পন্থা
নামাযে একাগ্রতার পন্থা দুইটিঃ এক. বাতিনী/অভ্যন্তরীণ, দুই. জাহেরী/বাহ্যিক। উক্ত দু’টির বর্ণনায় তাফসীরে রুহুল বয়ানে আল্লামা ইসমাঈল হক্কী উল্লেখ করেন,মুসল্লির মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিনয়-একাগ্রতা রয়েছে। মাথার বিনয় হচ্ছে মস্তক অবনত রাখা, চোখের একাগ্রতা হচ্ছে ভ্রƒক্ষেপ হতে দৃষ্টি নিচু রাখা, কানের একাগ্রতা হচ্ছে মনোযোগ সহকারে শ্রবনে বশীভূত হওয়া, মুখের বিনয় হচ্ছে ধীর স্থিরভাবে তেলাওয়াত, হাতের বিনয় হচ্ছে তা‘যীমের সাথে বাম হাতের উপর ডান হাত রাখা, পিঠের বিনয় হচ্ছে রুকুতে সমানভাবে পিঠ ঝুঁকে রাখা, লজ্জাস্থানের একাগ্রতা হচ্ছে, মন্দ চিন্তা-ধারণা থেকে বিরত থাকা, পায়ের একাগ্রতা হচ্ছে নাড়াচাড়া থেকে স্থির হয়ে আপন স্থানে অবিচল থাকা। আর বাতিনী/অভ্যন্তরীণ একাগ্রতার বর্ণনায় তিনি বলেন, নফসের একাগ্রতা হচ্ছে চিন্তা-দুশ্চিন্তা হতে স্থির থাকা। ক্বলবের একাগ্রতা হচ্ছে সর্বদা অন্তরের উপস্থিতি ও সার্বক্ষণিক যিকিরে থাকা। আর রুহের একাগ্রতা হচ্ছে সিফাতে জামাল ও জালালের দীপ্তিতে মহব্বতের সমুদ্রে নিমগ্ন থাকা।

নামাযে বিনয় একাগ্রতার উপকরণ
নামাযে বিনীত-নম্রতার উপকরণ হচ্ছে নামাযের প্রতি উদ্যোগী হওয়া এবং নামাযের প্রস্তুতি নেওয়া। উপকরণগুলোর অন্যতম হচ্ছে- উত্তমরুপে অজু করা, আযান-ইকামতের মাঝে দোয়া করা, মিসওয়াক করা, কাতার সমান করা, নামাযের অপেক্ষায় থাকা, নামাযে প্রশান্তি থাকা, প্রতিটি আয়াত তারতিল সহকারে পড়া; যেন গভীর ধ্যান ও বিনয়ে সহায়ক হয়, তেলাওয়াতে আল্লাহ্’র সাড়ার অনুভূতি হওয়া, নামাযের অবসরে সৎ বান্দাদের নামাযের প্রতিক্রিয়ার অধ্যয়ন গবেষণা করা। উপরোক্ত গুণ প্রয়োগ হতো হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর নামাযে। বর্ণনা রয়েছে,নামাযের সময়ে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর চেহারার রং এবং অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যেত, এ স¤পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে বলেন, যেহেতু তা আমানতের সময়”।

নামাযে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক
নামাযে একাগ্রতার প্রতিবন্ধক অনেক বিষয় রয়েছে, যা পরিহার করা মুসল্লির জন্য অত্যাবশ্যক। যথা- এক. নামায সংক্ষিপ্ত করা অর্থাৎ সংক্ষেপে পড়া এবং প্রতিটি রুকন যথাযথ আদায় না করে তাড়াহুড়া করে আদায় করা। দুই. হাত অধিক নাড়াচাড়া করা, যা মনোযোগে বিঘœ ঘটায়। তিন. আঙ্গুল মটকানো। চার. পায়ের মধ্যখানে চার আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁকা না রেখে অপরজনের পায়ের সাথে লাগানো; যা নামাযে একাগ্রতার অন্তরায়।

নামাযে বিনয়ের গুরুত্ব ও সফলতা
নামাযে বিনয়ী মু’মিনগণ সফলকাম। ইহ-পরকালে তারা সৌভাগ্যবান। সূরা ম’ুমিনূন এর প্রথম আয়াতে এদের স¤পর্কে বলা হয়েছে,
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ
; সফলতার দু’ অর্থ। এক. বড় কোনো কামনা প্রাপ্তি , দুই. সর্বদা শান্তিতে থাকা। এ দু’ অর্থের প্রয়োগ সফল ম’ুমিনে রয়েছে। যেহেতু একজন মু’মিন এর সবচেয়ে বড় কামনা জান্নাত। আর জান্নাত অনন্ত চির শান্তির স্থান। এর প্রতধ্বনি হয় আযান ও ইকামতে, حي على الصلاة- حي على الفلاح “এসো নামাযের দিকে, এসো কল্যাণ-সফলতার দিকে”। বিনয়যুক্ত নামাযই সফলতা বয়ে আনে। নিশ্চিত করে জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকার। আর সফলকাম মু’মিন একাগ্র নামাযে অশ্রুশীতল ও আত্ম প্রশান্তি লাভ করে, দূরীভূত হয় সকল দুশ্চিন্তা-অনিষ্ট, বৃদ্ধি করে আত্মসম্মান, সমৃদ্ধ হয় আর্থিক অবস্থা, বয়ে আনে সর্ব ক্ষেত্রে মঙ্গল এবং উৎকর্ষ সাধিত হয় জীবন। বিনয়ী সম্পন্ন নামাযের গুরুত্ব ও সফলতা স¤পর্কে কুরআন-সুন্নাহ্’র কতক উদ্ধৃতি নিম্মে তুলে ধরা হলো-

এক. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি
মহান আল্লাহ্ সফলকাম মু’মিনগণের জন্য জান্নাতুল ফিরদাউসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন,
أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“তারাই হবে অধিকারী,অধিকারী হবে ফিরদাউসের,যাতে ওরা স্থায়ী হবে”। (সূরা আল-ম’ুমিনুন: ১০,১১)

দুই. জাহান্নাম থেকে মুক্তি
বিনয়ী মুসল্লি নামাযে কুরআন এর মর্মার্থ অনুধাবন করে খোদাভীরুতায় অশ্রুসিক্ত হয়। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ্’র ভয়ে অশ্রুসিক্ত চক্ষুযুগলকে জাহান্নাম ¯পর্শ করবে না।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
عَيْنَانِ لاَ تَمَسُّهُمَا النَّارُ: عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ، وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ
“দু’ শ্রেণির চক্ষুকে (ব্যক্তি) জাহান্নাম ¯পর্শ করবে না। এক. যে চক্ষু আল্লাহ্’র ভয়ে ক্রন্দন করে, দুই. যে চক্ষু আল্লাহ্’র পথে রাত পাহারা দেয়”। (সুনানু তিরমিযি)

তিন. বিনয় নবীগণের গুণ
আল্লাহ্’র নবী-রাসূলগণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সর্বক্ষেত্রে বিনয়, ন¤্রতা ও একাগ্রতা। ছিল না তাদের দাম্ভিকতা- অহংকার। আর এ গুণে গুণান্বিত হয় রাসূলের সে সব মু’মিন উম্মত; যারা নামাযে বিনয়ী হয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ “তারা (নবীগণ) ছিল আমার নিকট বিনীত”। (সূরা আম্বিয়া: ৯০)

চার. গুনাহর মার্জনা
বিনীত ব্যক্তিদের নামায গুনাহ’র কাফ্ফারা স্বরূপ। একাগ্রতাপূর্ণ নামাযের জন্য মহান আল্লাহ্ বান্দার সকল সগিরা গুনাহ ক্ষমা করেন। হাদীসে পাকের বর্ণনা অনুযায়ী নামায স¤পাদনার্থে উত্তমরুপে অযু, ধীরভাবে স্থির রুকু ও বিনয়ী মুসল্লির সগিরা গুনাহ মোছন হতে থাকে।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ تَحْضُرُهُ صَلَاةٌ مَكْتُوبَةٌ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهَا وَخُشُوعَهَا وَرُكُوعَهَا، إِلَّا كَانَتْ كَفَّارَةً لِمَا قَبْلَهَا مِنَ الذُّنُوبِ مَا لَمْ يُؤْتِ كَبِيرَةً وَذَلِكَ الدَّهْرَ كُلَّهُ
“যে কোন মুসলিম ব্যক্তির ফরজ নামায উপস্থিত হয়, অত:পর উত্তমরুপে নামাযের অযু করে, নামাযে বিনয়ী হয় এবং যথাযথ রুকু আদায় করে। সে নামায তার পূর্বের সকল গুনাহের কাফ্ফারা হবে যতক্ষণ না বড় গুনাহ স¤পাদন করে, আর তা যুগ-যুগ চলতে থাকবে”। (সহীহ মুসলিম)

পাঁচ. মহা প্রতিদান
বিনীত-একাগ্র নামাযী মু’মিন নর-নারীর জন্য আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে রয়েছে ক্ষমা, মার্জনা এবং মহা প্রতিদান। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ … أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
“বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী … এদের জন্য আল্লাহ্ রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান”। (সূরা আহযাব: ৩৫)

ছয়. মহা অনুগ্রহ
একনিষ্ঠ, একাগ্রচিত্তে, বিনয়ে ও খোদাভীতুতে নামায আদায়কারী মু’মিনের জন্য রয়েছে দয়াময় প্রভুর মহা অনুগ্রহ, তিনি বলেন- وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِنَ اللَّهِ فَضْلًا كَبِيرًا
“আপনি মু’মিনদের সুসংবাদ দেন যে, নিশ্চয় তাদের জন্য আল্লাহ্’র নিকট রয়েছে মহাঅনুগ্রহ”। (সূরা আহযাব: ৪৭)

সাত. আল্লাহ্’র ছায়ায় অবস্থান
নামাযে কুরআনের মধুর তিলাওয়াত ও আল্লাহ্র’ অনুগ্রহরাজির বর্ণনায় চক্ষু শীতল করে। আবার আল্লাহ্’র মহাক্ষমতা ও শাস্তির বর্ণনায় হৃদয় প্রক¤িপত হয়, চক্ষু হয় অশ্রুসিক্ত। আল্লাহ্’র যিকরে অশ্রুসিক্ত ব্যক্তি কিয়ামতের মহাপ্রলয়ের সময় আল্লাহ্’র ছায়ায় আশ্রয় পাবে; যা কতই না বড় অনুগ্রহ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاه سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ فِي ظِلِّهِ، يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ …
“সাত শ্রেণির মানুষ সেদিন আল্লাহ্’র ছায়ায় স্থান পাবে; যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোন ছায়া থাকবে না। … যে ব্যক্তি একাকী আল্লাহ্’র যিকির করে আর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়”। (সহীহ বুখারী)

আট. দোয়া কবুল হওয়ার মাধ্যম
গুনাহ মার্জনা ও আল্লাহ্’র অনুগ্রহ কামনায় নামাযে অনেক দোয়া-প্রার্থনা রয়েছে। আর বিনয়ী নামায ম’ুমিনের ইহ-পরকালীন মঙ্গলময়-কল্যাণকর দোয়া-ফরিয়াদ আল্লাহ্ তা’আলা কবুল করে থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ
“আল্লাহ্ তো একমাত্র মুত্তাকীদের থেকে কবুল করেন”।
(সূরা মায়িদাহ: ২৭)

নয়. একাগ্রতাহীনদের জন্য নামায বোঝা স্বরূপ
বিনয়ী ও একাগ্রচিত্তে আদায়কৃত নামায মুসল্লিকে প্রশান্তি দেয়, যারা অপেক্ষায় থাকে সর্বদা নামাযের ওয়াক্তের। এর ব্যতিক্রম কিছু মুসলমান রয়েছে যাদের জন্য নামায বড়ই ভারী ও বোঝা স্বরূপ। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেন, وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِين
“ইহা (নামায) বিনীতগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে কঠিন (ভারী বোঝা)”। (সূরা বাকারা: ৪৫)

দশ: উদাসীনদের জন্য নামায অভিশাপ স্বরূপ
যাদের নামাযে একাগ্রতা রয়েছে তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ। আর যারা নামাযে উদাসীন এবং লোক দেখানো নামায পড়ে, তাদের জন্য নামায অমঙ্গল,দুর্ভোগ ও অভিশাপ। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,
فَوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ
“সুতরাং দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীদের, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য উহা করে”। (সূরা মা‘উন: ৪-৬)
অতএব আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী বিনয়ের সাথে, একাগ্রচিত্তে, আল্লাহ্’র ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে,অশ্রুসিক্ত ও খোদাভীরু হয়ে নামায আদায়ে মু’মিনের চক্ষু শীতল হয়,অন্তর প্রশান্তি লাভ করে, নেমে আসে উভয় জগতে সুখের বাতাস, আর অনন্তকালে রয়েছে অবিরাম খোদায়ী অনুগ্রহ। এটাই তো মু’মিনের সফলতা। আল্লাহ্ তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: প্রভাষক (আরবী), কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •