যখন পূণ্য যাবে অন্যের আমলনামায়

0

কাশেম শাহ

মুুমিন-মুসলমান ব্যক্তি তার সারাজীবনে অনেক নেক আমল করে থাকেন। নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত থেকে শুরু করে দান-সাদাকাহ সহ আরও অনেক ভালো কাজ। মানুষ আশা করে এসব ভালো কাজের প্রতিদান তিনি নিশ্চয় শেষ বিচারের দিন পাবেন। হাশরের ময়দানে মানুষের ভালো-মন্দ সব আমল হাজির করা হবে। কোরআন শরীফের সুরা আল-ইমরান এর ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করছেন, ‘স্মরণ কর সে দিনকে যেদিন তোমরা প্রত্যেকেই যা কিছু ভাল কাজ করেছো এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছো তা চোখের সামনে দেখতে পাবে। আর তখন সে কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান তৈরি হতো তবে খুবই ভালো হতো! আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’
এই যে এত ভালো কাজ, পূণ্যের কাজ দুনিয়াতে মানুষ করে যাচ্ছে -তার সবকিছুর ফল কি সে হাশরের ময়দানে ভোগ করতে পারবে? অথচ এসবই তো তার পূণ্যময় আমল। কত আশা নিয়ে, সময়-শ্রম-অর্থ দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি কামনায় দুনিয়ার জীবনে নেক কাজ করে গেছেন, কিন্তু কিয়ামতের ময়দানে দেখা যাবে তার সেই নেক আমলগুলো সব কেটে নেওয়া হচ্ছে। আর দিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন ব্যক্তিদের মাঝে, যাকে কিনা সে চিনেই না। না সে তার মা-বাবা, না আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-বন্ধু। কেউ না।
কে সে? সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছে দুনিয়াতে যার আপনি গীবত (কারও অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে মন্দ আলোচনা) করে গেছেন। তাকে ঠকিয়েছেন। নেক আমল করেছেন আপনি আর আপনার পুরস্কার ভোগ করছে আরেকজন। কতই না হতাশার মুহূর্ত সে সময়, যখন সামান্য ভালো কাজের পুরস্কারের আশায় মানুষ বুক বাঁধবে, আবার, আরেকটিবার দুনিয়ায় আসার জন্য আফসোস করবে, মাটি হয়ে যেতে চাইবেন। সেই মুহূর্তে আপনি নিশ্চুপ দেখে থাকবেন আপনার পূণ্য কাজ চলে যাচ্ছে আরেকজনের আমলনামায়।
হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারী শরীফে এসেছে, রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলা পূর্বাপর সকল মানুষকে কিয়ামতের দিন এক মাঠে একত্রিত করবেন। অতঃপর তাদের অবস্থা এমন হবে যে, তাদের চক্ষু পরস্পরকে বেষ্টন করবে এবং তারা যে কোন আহ্বানকারীর আহ্বান শুনতে পাবে। আর সূর্য তাদের নিকটবর্তী করা হবে।’ [হাদিস নং ৩৩৬১] এ জন্য বিচার দিবসকে- ‘ইয়ামুল হাসরা’ বা অনুতাপের দিনও বলা হয়েছে। আল্লাহ্ পবিত্র কুর’আনে বলেন, ‘তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিন সম্বন্ধে, যেদিন সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে; অথচ (এখন) তারা উদাসীন আছে এবং তারা বিশ্বাস করে না। [১৯:৩৯] আমাদের সময়, সুযোগ এখনো বাকী। শেষ নিঃশ^াস নেওয়ার আগেই আমরা যাদের গীবত করেছি তাদের কাছে যেন ক্ষমা চেয়ে নিই। যাদের হক আমাদের দ্বারা নষ্ট হয়েছে তা যেন তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি। যার সাথে যেভাবে পারি দুনিয়াতেই যেন আপোস করে নিই। হাশরের ময়দানে আমাদের যেন এ বলে অনুতাপ করতে না হয়, হায়! আমি কেন সময় থাকতে ক্ষমা চেয়ে নিইনি, আমি যাকে ঠকালাম তাকে তার প্রাপ্যটা দান করে আসিনি।
তাই সময়ের মূল্য দিতে হবে, নিজেকে ছোট মনে করতে হবে। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, আমার রব তো জানেন, আমার দ্বারা কার ক্ষতি হয়েছে, কাকে আমি ঠকিয়েছি, কাকে কষ্ট দিয়েছি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই, হে আমার প্রতিপালক! আমি যাকে কষ্ট দিলাম, আমার কথায়-কাজে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার আগেই তুমি আমি কিংবা তার কাছে মৃতুদুত পাঠিও না। আমাদের কাউকেই নিয়ে যেও না তোমার কাছে, কারণ দুনিয়াতে তার কাছে ক্ষমা চাইতে না পারলে তো হাশরের ময়দানে তুমিও ক্ষমা করবে না। হে আমার রব! সে সময়ের মুখোমুখি তুমি আমায় করিও না।

২. না পেয়েও কৃতজ্ঞ যিনি
মসজিদের বাইরে প্রতি শুক্রবারে ভিক্ষা করতে আসেন এক অন্ধ ভিক্ষুক। হাতে লাঠি, পরনে জীর্ণ-শীর্ণ কাপড়। হাসিমাখা মুখে পড়ে যান মহান রবের সন্তুষ্টি কামনায় প্রশংসাবাক্য (হামদ)। লোকটাকে দেখে ভাবি, এত কষ্ট যার জীবনে, সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার এত সন্তুষ্টি আসে কোত্থেকে। আমরা এত সুস্থ সুন্দর জীবন পেয়েও, এত স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন পেয়েও সুখি না, আর যে লোকটি চোখেই দেখতে পায় না, খোলা আকাশের নিচে কিংবা জীর্ণ কোনো কুটিরে কাটে তার রাত, সকালে জানে না দুপুরের খাবার যোগাবে কে, বিকেলে জানে না রাতের খাবার আসবে কোথা থেকে আর সে লোক কি-না মহান রাব্বুল আলামীনের প্রশংসায় বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেকে।
সেই অন্ধ ব্যক্তিকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল দুনিয়ার আলো চোখে দেখতে না পারার জন্য আফসোস কিংবা কোন সময় আল্লাহর প্রতি অভিমান হয় কিনা? উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ্ আমাকে এত ভালোবাসেন যে হয়তো তিনি আমাকে তাঁকে (আল্লাহকে) দেখানোর আগে দুনিয়ার অন্য কিছুই দেখাতে চান না।’
সুবহানআল্লাহ্! কি মহান কৃতজ্ঞতাবোধ, কি গভীর চিন্তা! আর আমরা সব পেয়েও আল্লাহর প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না। খাবার পরে সামান্য হাত তুলে মুনাজাত করার চর্চাও আমাদের মাঝে নেই। অথচ পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে আল্লাহতাআলা বলছেন, ‘তোমরা আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৫২)
আফ্রিকার কোনো এক পাহাড়ে পরিবারের সাথে থাকতো ১১ বছরের নুসাইবা। নুসাইবা ছিল মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। কিন্তু সে কথা বলতে পারতো না। নুসাইবার বাবার নাম হাকিম আল মাসুদ, মায়ের নাম জারাহ। সিরিয়া থেকে তারা অভিবাসী হয়ে কোনো এক সময় আফ্রিকায় আশ্রয় নেন। মাসুদ আর জারাহ দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। তারা আল্লাহর কাছে সবসময় একটি সন্তানের জন্য দোয়া করতেন। জারাহ দিনের বেশিরভাগ সময় নফল ইবাদতে কাটাতেন। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত ছিল জারাহ’র নিয়মিত কাজ। মাসুদও ছিলেন স্থানীয় একটি হেফজখানার শিক্ষক।
একদিন সব দোয়া কবুল হলো জারাহ’র। তার কোল আলো করে এলো নুসাইবা। অন্য দশটি ছেলে মেয়ের মতো নুসাইবাও হেসে খেলে বড় হচ্ছিল। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই জারাহ বুঝতে পারেন, নুসাইবা কথা বলতে পারে না। এক বছর বয়সেও যখন মা কিংবা বাবা বলে ডাকতে পারে না, তখন জারাহ-মসুদ বুঝে যায় তাদের এতদিনের একমাত্র চাওয়া নুসাইবা নির্বাক। আল্লাহ তাকে কথা বলার সুযোগ দেননি।
মনে কষ্ট এলেও এ নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে কোনোদিন দুঃখবোধ ছিল না। তারা এটাকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। এর মধ্যে নুসাইবাকে তার বাবা প্রতিদিন নিজের সাথে করে হেফজখানায় নিয়ে যেতেন। সব ছেলে-মেয়েরা যখন সুর করে, উচ্চ আওয়াজে কোরআন তেলাওয়াত করতো নুসাইবা তখন দূরে দাঁড়িয়ে তাদের সেসব তেলাওয়াত শুনতো। এভাবে কেটে গেছে বহু বছর।
নুসাইবার বয়স যখন ১১, তখন একদিন হঠাৎ তার মা-বাবার ঘুম ভাঙে মধুর কোরআন তেলাওয়াতে। মধ্যরাতে কোরআনের তেলাওয়াত শুনে বিছানা থেকে ওঠে বসেন দুজনেই। খুঁজতে থাকেন এত মধুর সুর কোত্থেকে ভেসে আসে। বিছানা থেকে নেমে সুরের সন্ধানে গিয়ে দেখে তাদের মেয়ে, হ্যাঁ তাদের মেয়ে নুসাইবা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে কোরআন তেলাওয়া করছে।
ঘটনার আকষ্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন দুজনেই। দাঁড়িয়ে শুনতে থাকেন নুসাইবার তেলাওয়াত, যে সুরা ফাাতেহা থেকে শুরু করে একে একে পবিত্র কোরআনুল করিমের সব সুরা পড়ে যাচ্ছিলো। এক সময় মসজিদ থেকে ফজরের আজান ধ্বনি ভেসে এলে থামে নুসাইবার তেলাওয়াত। তখন সে তার মা বাবাকে বলে, আমি যখন বুঝতে শিখলাম, জানতে পারলাম আমি কথা বলতে পারি না। তখন আমার খুব ইচ্ছা হতো আমি যেন কোরআন পড়ি। প্রতিদিন মায়ের মুখে শুনে, বাবার মাদ্রাসায় শুনতে শুনতে আমার ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ হয়ে গেছে, কিন্তু, আফসোস আমি কাউকে শুনাতে পারতাম না। তখন আমি প্রতিরাতে ঘুমাতে এলে আল্লাহকে আমার তেলাওয়াত শুনাতাম। আর আর্জি জানাতাম, হে পরওয়ারদেগার, আমার এ কোরআনের সুর যেন আমি সবার কানে পৌঁছে দিতে পারি। আল্লাহ আজ আমার দোয়া কবুল করেছেন। সুবহান আল্লাহ।
আবু দাউদ শরীফে হজরত ইবনে ওমরের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে হজরত রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর শোকর যিনি আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিলেন, আমাকে রাতে আশ্রয় দিলেন, আমাকে পানাহার করালেন, যিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করল এবং বিশেষ অনুগ্রহ করল, অধিক পরিমাণে দান করল।’

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •