আবসার মাহফুজ
পৃথিবীর মানচিত্রের প্রায় ৩৫ ভাগ জুড়ে রয়েছে অর্ধশতাধিক মুসলিমরাষ্ট্রের অবস্থান। সারাবিশ্বে বাস করে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান। দুনিয়ার সব মুসলমানকে নিয়েই গড়ে উঠেছে ‘মুসলিমউম্মাহ’। এই মুসলিমউম্মাহকে ‘মুসলিমবিশ্ব’ও বলা হয়। পবিত্র কোরানে এই মুসলিমউম্মাহকে ‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন’ বা ‘শ্রেষ্ঠজাতি’ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মুসলিমবিশ্বের অগাধ সম্পদ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জনসংখ্যা, মানবিকমূল্যবোধ, জ্ঞানবিজ্ঞানে অবদানসহ নানাদিক বিবেচনায় নিলে এর সত্যতা মিলে সহজেই। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই একসময় সারাবিশ্ব শাসন করেছিল মুসলমানরা, বিশ্ববাসীকে দিয়েছে কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা; ইতিহাসের ভাষায় যা ‘ইসলামের স্বর্ণযুগ’। কিন্তু এখন? এখন তো মুসলিমবিশ্বকেই শাসন ও শোষণ করছে ইসলামবিদ্ধেষী সা¤্রাজ্যবাদীরা। এখন নানাভাবেই মুসলিমবিশ্বের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। আবার এ ব্যাপারে সহযোগিতা করছে একশ্রেণির মুসলমান ও শাসকচক্র। আজ সারা মুসলিমবিশ্বে ছড়ি ঘুরাচ্ছে ইসলামের শত্রুরা। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে ঠেলে দিয়ে ফায়দা লুঠছে তারা। এর কারণ কি? একসময় যেখানে সমগ্রবিশ্বই ছিল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে আজ কেনো মুসলমানদের চরম দুর্দদশা? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করা, একইসঙ্গে যুৎসই সমাধান-উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এই দাবি পূরণে ব্যর্থ হলে মুসলিমউম্মাহর জন্যে যে আরো চরম দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, তা বলাই বাহুল্য।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভূমি ও ধনেসম্পদে মুসলমানরাই সেরা। পৃথিবীর ৩৫ শতাংশ ভূমি মুসলিম উম্মাহর দখলে। জনসংখ্যার দিক দিয়েও দ্বিতীয় অবস্থানে। আর যে পরিমাণ ধনসম্পদ মহান আল্লাহ মুসলিমবিশ্বকে দান করেছেন তা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের নেই। পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি এবং মুসলমান দেশের সংখ্যা ৬৫-এরও অধিক। পৃথিবীতে মোট তেল ও গ্যাসের ৮০ ভাগ, কয়লার ৬০ ভাগ, স্বর্ণের ৬৫ ভাগ, রাবার ও পাটের ৭৫ ভাগ এবং খেজুরের ১০০ ভাগই মুসলমান দেশের। পৃথিবীর মোট দেশের আয়তনের তিনভাগের একভাগ মুসলিমবিশ্বের। পৃথিবীর মোট ৩ কোটি সৈন্যের এক কোটিই মুসলমান। অমুসলিম বিশ্বের ৮৭ ভাগ বাণিজ্যই মুসলমানের সাথে। মুসলিম অধ্যুষিত আটটি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত ডি-৮এর আওতায় বিশাল মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। সম্মিলিত উদ্যোগে এ সম্পদ কাজে লাগিয়ে ডি-৮ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসের করা এক তালিকা অনুযায়ী মুসলিম দেশ কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র। ম্যাগাজিনটি বলছে, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সুবাদে ১৭ লাখ জনসংখ্যার দেশটি মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে ধনী দেশ। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে কাতারের মাথাপিছু বার্ষিক জিডিপি ছিল ৮৮ হাজার ডলার। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৪৭ হাজার ৫০০ ডলার জিডিপি নিয়ে ষষ্ঠ এবং কুয়েত ছিল ১৫তম অবস্থানে। চলতি ২০২২ খ্রিস্টাব্দের বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক এবং ২০২০ খ্রিস্টাব্দের অলিম্পিক গেমস আয়োজনের প্রতিযোগিতাকারী কাতার ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হয়েছে। সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রুনেই, মিসরসহ আরো বহু ধনী মুসলিম দেশ আছে। এই বিপুল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা গেলে মুসলিমবিশ্বে কোনো দরিদ্র্যমানুষের সন্ধান মিলবে না। একইসঙ্গে সারাবিশ্বই মুসলিমউম্মাহর কাছে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতো।
কিন্তু আফসোস, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব এবং অনৈক্যের সুযোগে মুসলিমবিশ্বের বিশাল ধনভান্ডার লুঠ করছে মুসলিমবিদ্বেষীরা। মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত লাগিয়ে দিয়ে একদিকে রক্ত ঝরাচ্ছে, অন্যদিকে বিনা বাধায় লুঠ করছে সম্পদ। সমগ্র বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ নিজেদের হওয়া সত্ত্বেও এখন শৌর্যবীর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান, গ্রহণযোগ্যতা, আত্মমর্যাদা প্রভৃতি বিবেচনায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী হচ্ছে মুসলিমসম্প্রদায়। ইসলামের শত্রুরা সুকৌশলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখে একদিকে বিভিন্ন পক্ষের কাছে চড়া দামে অস্ত্র বিক্রি করে বিপুল অর্থভান্ডার গড়ছে, অন্যদিকে সেই অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন মুসলিম জনপদ ধংস করা হচ্ছে, ইসলামের গৌরবময় ঐতিহ্যমন্ডিত স্থাপনাগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে, নিরপরাধ মুসলিম শিশু, নারী এবং যুবকদের হত্যা করা হচ্ছে, ধংস করে দেয়া হচ্ছে তেল-গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদও। একইসঙ্গে ইসলাম ও মুসলমানদের কলংকিত করার জন্যে সন্ত্রাসবাদেরও জন্ম দেয়া হয়েছে সুকৌশলে, যা ‘জঙ্গিবাদ’ নামে খ্যাত। এসব জঙ্গি ইসলামের নামে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করে বিশ্বময় ইসলামকে কলংকিত করছে। পাশাপাশি মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করছে। অথচ ইসলাম এ ধরনের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাকে সম্পূর্ণ হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছে। বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন বিশ্বগণমাধ্যমের একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে, আসলে জঙ্গিবাদীদের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদুনিয়া। তারা মুসলিমবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ফায়দা লুঠতেই মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখার পাশাপাশি জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়ে পরোক্ষে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আর ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এদের ব্যবহার করছে। বছরচারেক আগে কয়েকটি বিশ্বখ্যাত পত্রিকায় আইএস’র (ইসলামিক স্টেট) প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর বাগদাদীর সাথে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোপন বৈঠকের ছবি প্রকাশ পেয়েছিল। আফ্রিকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত বুকো হারামও পশ্চিমাবিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করছে বলে অভিযোগ আছে। অথচ এসব সংগঠন ইসলামের নামেই সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে। আবার এদের সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে প্রধানত মুসলমানরাই। বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিবেদন বলছে, জঙ্গিবাদীদের হত্যার শিকার মানুষদের ৯৫ ভাগই মুসলমান। এসব জঙ্গি একদিকে ইসলাম ও মুসলমানদের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে, অন্যদিকে ক্ষতি করছে মুসলমানদের জানমাল। এসব অপতৎপরতার মাধ্যমে তারা মুসলিমবিদ্বেষীদেরই অপস্বার্থ পাহারা দিচ্ছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে এদের মুখোশ উন্মোচনে আলেমসমাজের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ নেই। এ সুযোগে ইসলামের দুষমনরা তাদের কুউদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে নির্বিঘেœ।
আগেই বলেছি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব ও বহুধাবিভক্তির সুযোগে মুসলিমবিশ্বের সম্পদের সিংহভাগই নানা কৌশলে করায়ত্ত করছে ইসলাম ও মুসলিমেিদ্বষীরা। একদিকে ইসলামের শত্রুদের দ্বারা সম্পদ লুঠ, অন্যদিকে রক্তাক্ত ভ্রাতৃঘাতিযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মুসলিমউম্মাহ। পরিণামে মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছে। ইথিওপিয়ার বুভুক্ষু শিশুসহ সাধারণ মানুষের হাড্ডিসার ছবি বছরের পর বছর দেখছি আমরা। দেশটিতে ৯৫ ভাগ মানুষই চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। প্রতিবছরই মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। অথচ দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। কিন্তু গৃহযুদ্ধের কারণে সে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। যুদ্ধ থামানোরও নেই কোনো উদ্যোগ। পশ্চিমাবিশ্ব সুকৌশলে যুদ্ধাবস্থায় রেখেছে দেশটিকে। আর সে সুযোগে তারা চালিয়ে যাচ্ছে অস্ত্রব্যবসা। কাচাস্বর্ণ, গ্যাস এবং তেলসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদও নিয়ে যাচ্ছে বাধাহীনভাবে। সে সম্পদ ব্যবহার করে তারা আরো ধনী হচ্ছে। তাদের লোকজনের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। অথচ যারা সম্পদের মালিক তারা খেতে না পেয়ে ধুকে ধুকে মরছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় সৌদিজোটের পাশবিক হামলার জের শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ হিসেবে পরিচিত ইয়েমেনও ইথিওপিয়ার ভাগ্যাবরণ করেছে। একদিকে সৌদিজোটের নির্বিচার বোমাহামলায় মারা যাচ্ছে প্রতিদিন শতশত নিরীহ মানুষ, অন্যদিকে খেতে না পেয়ে পুষ্টিহীনতাসহ নানা রোগে মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘ বলছে, সহ¯্রাব্দের সেরা দুর্ভিক্ষের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে ইয়েমেন। প্রতিদিনই পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। অথচ ওআইসিসহ মুসলিমদুনিয়া চাইলে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ থামিয়ে দেশটিকে শোচনীয় অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা করছে না যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। কারণ যুদ্ধ বন্ধ হলে মার্কিন অস্ত্রের বাণিজ্যে মন্দাভাব আসবে। মুসলমানদের সম্পদ ও শক্তিক্ষয় রোধ হয়ে যাবে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়াসহ আরো বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে ভ্রাতৃঘাতিযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মহামূল্যবান তেল ও গ্যাসসম্পদ ধংস ও লুঠ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলিমউম্মাহ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। একসময় মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত মীমাংশায় ওআইসির ছিটেফোটা ভূমিকা দেখা গেলেও এখন তা একেবারেই নেই। কারণ এখন সে সংস্থাটিও সা¤্রাজ্যবাদীচক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর সেজন্যেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যখন মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও গণহত্যা চালায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়, তখন সংস্থাটি ‘টো’ শব্দটিও উচ্চারণ করে না। ‘জারজরাষ্ট্র’ ইসরাইল প্রতিদিনই নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করলেও ওআইসি নিন্দা জ্ঞাপনও করে না। ওইঘুর মুসলমানদের সাথে চীন বর্বর আচরণ করলে কিংবা চেচেনদের দমনে রাশিয়া পাশবিকতার আশ্রয় নিলে কিংবা কাশ্মিরি মুসলমানদের দমনপীড়নে ভারত বর্বর কৌশল প্রয়োগ করলে কিংবা মুরো মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে ফিলিপাইন সব ঘৃণিত উদ্যোগ নিলেও ওআইসির কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। শক্তিশালী মুসলমান দেশগুলোর নেতারাও নির্লিপ্ত রয়েছে গদী আর স্বার্থের কারণে। মুসলিমউম্মাহর এই কাপুরুষিত চেহারা দেখে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা মুসলিমবিশ্বকে পদানত ও নিশ্চিহ্ন করতে দিনদিন চরম বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে মুসলমানদের বিশ্বশাসন করার একটি গৌরবময় স্বর্ণালী অতীত আছে, যাদের আছে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় যাদের আছে দোর্দ-প্রতাপ পদচারণা, সভ্যদুনিয়ায় যাদের স্থান সর্বোচ্চে, যাদের দখলে আছে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ ভূমি, সারাবিশ্বের শক্তি-সম্পদের অর্ধেকেরই বেশি যে মুসলিমবিশ্বের দখলে, তাদের কেনো এই দুর্দশা। এর মোক্ষম উত্তরটি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর বিদায়হজের ভাষণেই দিয়ে গেছেন, আজ থেকে প্রায় পনেরোশ’ বছর আগে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিষ রেখে যাচ্ছি, একটি মহাগ্রন্থ আল কোরান, অন্যটি আমার সুন্নাহ। তোমরা যতোদিন এই দুটি বস্তু আকড়ে থাকবে, ততোদিন পৃথিবীর সব শক্তি তোমাদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য, কেউ তোমাদের পদানত করতে পারবে না। কিন্তু এই দুটো জিনিষ থেকে দূরে থাকলে তোমরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত জাতিতে পরিণত হবে।’ আজ মহানবীর সে ভবিষ্যৎবাণী আমরা হাঁড়েহাড়ে লক্ষ্য করছি। মুসলমানদের এই অধপতনের মূলে আছে কোরান-হাদিস চ্যুত হওয়া। কোরান-হাদিস থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে আজ মুসলমানরা অনৈক্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা থেকেও সটকে পড়েছে মুসলমানরা। ক্ষুদ্র অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রে যতজন বিজ্ঞানী আছে সারামুসলিমবিশে^ ততজন নেই। অথচ একসময় জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে মুসলমানরাই। চিকিৎসাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থবিজ্ঞান, সংখ্যাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্রায় সব বিজ্ঞানেরই জনক হচ্ছেন মুসলমান বিজ্ঞানী। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্ঞানাগার ‘দারুল হিকমা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন খলিফা হারুনুর রশীদ। তখন বিশে^র নানা প্রান্ত থেকে মণীষীরা সেখানে জ্ঞানসাধনার জন্যে আসতেন। বিভিন্ন জ্ঞানপুস্তক নানা ভাষায় অনুবাদ করে তখন সারাবিশে^ ছড়িয়ে দেয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন মুসলিম খলিফারা। কিন্তু আজ মুসলমানরা বিজ্ঞানচর্চা থেকে দূরে সরে গেছে। শিক্ষাদীক্ষায়ও মুসলমানরা অন্যদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। অথচ প্রিয় নবীজীর কাছে মহান আল্লাহর কাছ থেকে প্রেরিত পবিত্র কোরানের প্রথম ওহীটিই হচ্ছে ‘ইকরা’- পড়–ন। এই তাৎপর্যপূর্ণ শব্দটির মাধ্যমে মুসলমানদের শিক্ষালাভের ওপরই জোর দেয়া হয়েছে। বদর ও উহুদের যুদ্ধে পরাস্ত কাফিরসেনাদের মুক্তির প্রধান শর্ত ছিল মুসলিমসন্তানদের পড়ালেখা শেখানো। পবিত্র কোরান এবং হাদিস শরীফে বহুবার শিক্ষালাভের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। মহানবী (স) মুসলিম নরনারীর জন্যে জ্ঞানার্জন ফরজ ঘোষণা করেছেন। প্রয়োজন হলে চীনদেশে গিয়ে হলেও বিদ্যালাভ করতে বলেছেন। উল্লেখ্য, তখন চীনদেশ ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম ও দূরবর্তী দেশ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজ মুসলিমদের মধ্যেই অশিক্ষিত জনসংখ্যা বেশি। অগাধসম্পদের মালিক হওয়ার পরও পৃথিবীর বেশিরভাগ দরিদ্র্যদেশের অবস্থানও মুসলিমবিশে^।
শিক্ষার আলোয় অন্তর্র্দৃষ্টি প্রসারিত না হওয়া লোকজন সহজেই ভালোমন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। জীবনকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে না। সম্পদের সুব্যবহারে করে নিজের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। নিজেদের শক্তি ও সম্পদ, ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা তারা নিজেরাই জানে না। তাদের ওপর যে কেউ সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনৈক্য এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথে নিয়ে যেতে পারে। আজকে দিকভ্রান্ত মুসলিমউম্মাহর দিকে তাকালে এই সত্যের প্রমাণ মিলে। মুসলমানরা যদি পবিত্র কোরান ও সুন্নাহকে আঁকড়ে থাকতো, কোরান-সুন্নাহর আলোকে জীবন পরিচালনা করতো, তাহলে শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকতো; একইসঙ্গে বিপুল জনসংখ্যা, অগাধ সম্পদ ও বিশাল ভূখ-ের মালিক হওয়ায় তারা ইসলামের সোনালীযুগের ন্যায় সারাবিশ^কে শাসন করতে পারতো, নেতৃত্ব দিয়ে একটি মানবিক চেতনায় পুষ্ট শোষণ-বঞ্চনাহীন মানবসাম্যপূর্ণ সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়তে পারতো। তবে এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। মুসলিম আলিম-উলামাসহ বিদগ্ধজনরা কোরান-সুন্নাহর আলোকে মুসলিমবিশ^কে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিলে ইসলামের সোনালীযুগ পুনরায় ফিরে আসবে, সন্দেহ নেই। তবে কাজটি খুবই কঠিন। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা কখনো মুসলিমউম্মাহকে ঐক্যের পথে হাঁটার সুযোগ দেবে না। তাদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সুকৌশলেই এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্যে কোরান-সুন্নাহর আদর্শে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দরকার। আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্যে সর্বাগ্রে যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে পুরো মুসলিমবিশ্বে কোরান-সুন্নাহভিত্তিক সুশিক্ষার আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া। আর এ ক্ষেত্রে আলেমসমাজকেই পুরোধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।