মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করার ফযীলত এ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে থাকে যে, খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবী-ই আকরামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করেন। শুধু তা নয়, আল্লাহ্ তা‘আলা মু’মিন-মুসলমানদেরকেও তাঁর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করার এবং অতি উত্তম রূপে সালাম পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র ক্বোরআনুল করীমের সূরা আহ্যাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
তরজমা: নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফেরেশতাগণ দুরূদ প্রেরণ করেন ওই অদৃশ্য বক্তা (নবী)’র প্রতি, হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ ও খুব সালাম প্রেরণ করো!
[সূরা আহ্যাব: আয়াত-৫৬, কান্যুল ঈমান]
এ আয়াত শরীফে কতিপয় সুক্ষ্ম বিষয় লক্ষণীয়
প্রথমত: আল্লাহ্ তা‘আলা আয়াতের শুরুতে إِنَّ (ইন্না) এনেছেন। আরবী ভাষায় ‘ইন্না’ ওই উক্তিতে ব্যবহৃত হয়, যাকে যে কোন ধরনের সন্দেহ থেকে মুক্ত করা উদ্দেশ্য হয়। সুতরাং এ বাক্যে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ শরীফ পাঠ বা প্রেরণের যে তথ্যটা দেওয়া হয়েছে, তাতে যে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই, তা প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য।
দ্বিতীয়ত: এ আয়াত শরীফ আল্লাহ্ তা‘আলা يُصَلُّونَ ক্রিয়াপদটি مضارع(মুদ্বা-রা‘আ)-এর এনেছে। যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় কালের অর্থ বুঝায়। সুতরাং مضارع -এর ক্রিয়ারূপটা এনে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাগণের দুরূদ প্রেরণ কোন এ যমানায় সমাপ্ত হয় না। বরং ক্বিয়ামত পর্যন্ত, এমনকি চিরকাল ব্যাপী চলতে থাকবে।
তৃতীয়ত: বাক্যটি جمله فعليه থেকে جمله اسميه তে রূপান্তরিত হয়েছে; যা সার্বক্ষণিক এর অর্থ বোধক। সুতরাং আয়াতে এ কথার দিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলা ও ফেরেশতাদের দুরূদ সব সময় জারী রয়েছে ও থাকবে।
চতুর্থত: আয়াত শরীফে আল্লাহ্ তা‘আলা صلواة ওسلام (সালাত ও সালাম) উভয়টি এরশাদ এর মাধ্যমে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতাগণ যেভাবে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উঁচু মর্যাদা বর্ণনা করেছেন, তেমনি তাঁকে প্রতিকূল ও তাঁর শানে শোভা পায় না এমন সব কিছু থেকে মুক্ত রেখেছেন। দুরূদ শরীফের অগণিত ফযীলতের মধ্যে নিম্নে কয়েকটা মাত্র উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
সহীহাইন (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)-এ হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَنْ صَلّٰى عَلَىَّ وَاحِدَاةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرًا-
যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দুরূদ শরীফ পাঠ করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা আপন অনুগ্রহে তার উপর দশটি রহমত প্রেরণ করেন।
রাসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অন্য হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন-
مَا مِنْ عَبْدٍ صَلّى عَلَىَّ اِلَّا خَرَجَتِ الصَّلوٰةُ مِنْ فِيْهِ مُسْرِعَةً فَلَا يَبْقٰى بَرُّ وَلَابَحْرٌ وَلَا شَرْقٌ وَلَا غَرْبٌ اِلَّا تَمُرُّ بِه وَيَقُوْلُ اَنَا صَلوٰةُ فُلَانٍ صَلّٰى عَلٰى مُحَمَّدِ نِ الْمُخْتَارِ خَيْرِ خَلْقِ اللهِ فَلَا يَبْقٰى شَىْءٌ اِلَّا صَلّى عَلَيْهِ-
অর্থ: যে কোন ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করে, ওই দুরূদ শীঘ্র তার মুখ থেকে বের হয়ে স্থলভাগ, জলভাগ এবং পূর্ব ও পশ্চিম অতিক্রম করে, আর বলেন, ‘‘ আমি অমুকের পুত্র অমুকে (পঠিত) দুরূদ শরীফ, সে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার উপর, যিনি আল্লাহ্র পছন্দনীয়, সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সেরা-এর উপর পাঠ করে প্রেরণ করছে।’’
সুতরাং তার একথা শুনা মাত্র সমস্ত সৃষ্টি তাঁর প্রতি দুরূদ শরীফ পাঠ করে প্রেরণ করতে এবং ওই দুরূদ পাঠকের জন্য রহমত প্রার্থনা করতে আরম্ভ করে দেয়। রাসূল-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেন-
اِنَّ اَوْلَى النَّاسِ بِىْ اَكْثَرُ هُمْ عَلَىَّ صَلٰوةً-
অর্থ: ওই ব্যক্তি আমার বেশী নিকটে, যে আমার উপর বেশী পরিমাণে দুরূদ শরীফ পাঠ করে।
হুযূর-ই আকরাম আরো এরশাদ ফরমায়েছেন-
اِنَّ الْجَنَّةَ تَشْتَاقُ اِلٰى خَمْسَةِ نَفَرٍ تَالِىْ الْقُرْاٰنِ وَحَافِظِ اللِّسَانِ وَمُطْعِمِ الْجِيْعَانِ وَمُكْسِى الْعُرْيَانَ وَمَنْ صَلّٰى عَلى حَبِيْبِ الرَّحْمٰنِ-
অর্থ: নিশ্চয় বেহেশ্ত পাঁচ ব্যক্তির জন্য আগ্রহী ১. ক্বোরআন তিলাওয়াতকারী, ২. নিজের রসনাকে অনর্থক কথাবার্তা থেকে রক্ষাকারী, ৩. ক্ষুধার্তদেরকে আহার দাতা, ৪. উলঙ্গদেরকে পরিধানের কাপড় দাতা এবং আল্লাহ্র মাহবূব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দুরূদ পাঠক।
ইমাম যুহরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
اِنِّىْ لَقِيْتُ جِبْرَئِيْلَ فَبَشَّرَ نِىْ فَقَالَِ قَالَ اللهُ تَعَالٰى مَنْ صَلّٰى عَلَيْكَ صَلَّيْتُ عَلَيْهِ وَمَنْ سَلَّمَ عَلَيْكَ سَلَّمْتُ عَلَيْهِ فَسَجَدْتُّ لِلّهِ شكرًا-
অর্থ: আমি জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ করলাম। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এ মর্মে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আপনার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করে আমি তাঁর প্রতি রহমত প্রেরণ করি এবং যে ব্যক্তি আপনার উপর সালাম পাঠ করে আমি এর শোকরিয়া স্বরূপ আল্লাহ্র জন্য সাজদাহ্ করেছি।’’
হুযূর-ই আকরাম আরো এরশাদ ফরমায়েছেন-
مَنْ صَلّٰى عَلَىَّ عَشْرًا فِىْ اَوَّلِ النَّهَارِ وَعَشْرًا فِىْ اٰخِرِ النَّهَارِ نَالَتْهُ شَفَاعَتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ-
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার উপর দিনের শুরুতে (সকালে) দশবার দুরূদ শরীফ পাঠ করে এবং দিনের শেষভাগে (সাজদায়) দশবার দুরূদ শরীফ পাঠ করে ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত তার নসীব হবে।
এবার দুরূদ শরীফের ফযীলত প্রসঙ্গের কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
ঘটনা: হযরত শায়খ শিবলী কা’বা শরীফে এক যুবককে দেখলেন- সে কা’বা শরীফের ‘তাওয়াফ করছে। কিন্তু প্রতিটি চক্করে অন্যান্য দো‘আ না পড়ে শুধু দুরূদ শরীফ পড়ে যাচ্ছে। তিনি ওই যুবককে বললেন, ‘‘তুমি কি দুরূদ শরীফ ছাড়া অন্য কোন দো‘আ জানো না?’’ জবাবে যুবকটি বললো, ‘‘অনেক দো‘আ জানি, কিন্তু যেই উপকার আমি দুরূদ শরীফে দেখেছি, তা অন্য কোন দো‘আয় দেখিনি।’’ যুবকটি বললো, আমি অমুক বছরে আমার পিতার সাথে হজ্জে আসছিলাম। যখন বাগদাদ পর্যন্ত পৌঁছলাম তখন আমার পিতার খুব জ্বর হলো। এমনকি কয়েকদিন পর তিনি মারা গেলেন। মারা যাবার পর দেখলাম- তার চেহারা একেবারে শুয়রের মতো হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে- আমি খুব কান্নাকাটি করলাম। একটি কাপড় দিয়ে তার চেহারা ঢেকে দিলাম। একথা লজ্জায় না কাউকে বলতে পারছিলাম, না একাকী তাকে কাফন পরিয়ে দাফন করতে পারছিলাম।
নিরুপায় হয়ে বসে চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ আমার চোখে ঘুম এসে গেলো। স্বপ্নে দেখছিলাম একজন খুব সুন্দর ও পবিত্র চেহারাধারী পুরুষ আমার পিতার নিকট আসলেন। আর পিতার চেহারা থেকে কাপড় সরিয়ে নিজের হাত বুলিয়ে দিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমার পিতার চেহারাটুকু চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেলো। এরপর তিনি চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। আমি তখন তাঁর পবিত্র দামন ধরে সবিনয় আরয করলাম, ‘‘আপনি কে? আমার এমন অসহায় অবস্থায় এসে আমাকে সাহায্য করলেন!’’ তিনি বললেন, ‘‘আমি হলাম গুনাহগারদের সুপারিশকারী, পাপীদের আশ্রয় দাতা মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্!’’ এটা শুনতেই আমি তাঁর কদমে পড়ে কদমবুচি করে আরয করলাম, ‘‘হে আল্লাহ্র রসূল! আমার পিতার মৃত্যুর সংবাদ আপনি কিভাবে পেয়েছেন? আমি তো এ পর্যন্ত এ খবর কাউকে দিই নি!’’
হুযূর-ই আকরাম এরশাদ করলেন, ‘‘তোমার পিতা প্রতি রাতে আমার উপর তিনশ’ বার দুরূদ শরীফ পাঠ করে আমার সমীপে প্রেরণ করতো। আজ রাতে যখন ওই দুরূদ শরীফ আমার নিকট পৌঁছলো না, তখন আমি ওই ফেরেশতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে আমার নিকট তার দুরূদ শরীফ পৌঁছাতো, আজ অমুকের দুরূদ শরীফ আসলো না কেন? তখন ফেরেশতাটা আরয করলো, ‘‘এয়া রসুলাল্লাহ্! আজ তার মৃত্যু সংঘটিত হয়ে গেছে।’’ এটা শুনতে তার প্রতি আমার দয়া হলো এবং আমি এসে গেলাম।’’
একথা বলে হুযূর-ই আকরাম তাশরীফ নিয়ে গেলেন। পরদিন ফজরের নামাযের পর দেখতে পেলাম- শহরের চতুর্দিক থেকে লোকেরা দলে দলে এদিকে আসছে। তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম- আপনাদেরকে কে খবর দিয়েছেন? সবাই বললো, আমরা ভোরে আসমানী আহ্বান শুনতে লাগলাম- যে ব্যক্তি চায় যে, সে তার সব গুনাহ্ থেকে পাক সাফ হয়ে যাবে, সে যেন অমুনক মহল্লায় যে লোকটার মৃত্যু হয়েছে তার জানাযায় শরীক হয়।’’ সুতরাং আমরা ছুটে এলাম।
মোটকথা, অতঃপর অতি সুন্দরভাবে কাফন-দাফন ও জানাযার নামায সম্পন্ন হলো। সুতরাং যুবকটি বললো, ‘‘আমি দুরূদ শরীফের এমন ফযীলত দেখে আমি সুযোগ পেতেই শুধু দুরূদ শরীফ পাঠ করি। মসনভী শরীফের একটি পংক্তি দিয়ে নিবন্ধটির ইতি টানলাম-
بر محمد صلى الله عليه وسلم رسانم صد سلام- اۤں شيع مجر مان يوم القيام
অর্থ: হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে শত-সহ¯্র সালাম প্রেরণ করছি, যিনি ক্বিয়ামতের দিন গুনাহ্ গারদের সুপারিশকারী। আসুন! আমরা এ ফযীলতমণ্ডিত কাজটি করতে সচেষ্ট হই।
লেখক: মহাপরিচালক আন্জুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।