নিয়মিত উত্তর দিচ্ছেন: অধ্যক্ষ মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়ার রহমান। সাবেক-অধ্যক্ষ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।
মুহাম্মদ সোহেল রানা, মাওলানা মুহাম্মদ আলী আকবর, মাওলানা মুহাম্মদ ইব্রাহীম, মুহাম্মদ শফিউল আজম হক (মিন্টু), মুহাম্মদ রাজা মিয়া।
সর্ব সাং- মুহাম্মদপুর ৩নং ওয়ার্ড, জোয়ারা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: আমাদের এলাকার এক তবলীগ অনুসারী মন্তব্য করল ‘‘(যদি) মিলাদ শরীফ এবাদত মনে করে পড়ে, তাহলে জাহান্নামী (হবে)।’’ তার এ উক্তি এবং উক্ত ব্যক্তির ব্যাপারে শরীয়তের ফয়সালা কি?
উত্তর: উপরোক্ত ঘটনা যাছাই বাচাই পূর্বক ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক এই মর্মে ফতোয়া/ফয়সালা প্রদান করা হচ্ছে যে, তাবলীগ জামাত একটি বাতিল ফেরক্বা/ভ্রান্ত দল/পথভ্রষ্ট দল। তাবলীগ জামাতের আকিদা হলো মূলত ওহাবী আকিদা। যেমন- ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত তাবলীগ জামাতের নির্ভরযোগ্য মাদরাসা ‘মাদরাসায়ে আমিনিয়া’ এর দারুল ইফতা/ফতোয়া বিভাগ থেকে বলা হয়-
تقوية الايمان بهشتى زيور وغيره مذكوره كتابيں مستند اور صحيح هيں ان كے لكھنے والے متدين عالم تھے جوان كتابوں كو باطل كھتاهے وه گمراه هے ـ يه بات غلط هے كه مولانا الياس مرحوم اور مولوى محمد يوسف صاحب ان كتابوں كے خلاف هيںـ گيارھويں ـ ـ تيجه وغيره كو يه ناجائز هى سمجھتے هيں يه دونوں حضرات مولانا اسماعيل شهيد ـ مولانا رشيد احمد صاحب گنگوهى اورمولانا تهانوى كے مانے والے
অর্থাৎ তাকভিয়াতুল ঈমান, বেহেশতি জেওর এবং অন্যান্য (ওহাবী কিতাব) এগুলো নির্ভরযোগ্য এবং সহীহ্ কিতাব। এসব কিতাবের লিখকগণ দ্বীনদার আলেম ছিলেন। এ সমস্ত কিতাবগুলোকে যারা বাতিল বলে তারা গোমরাহ্/পথভ্রষ্ট। মাও: ইলিয়াস (তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা) এবং মৌঃ ইউসুফ (তাবলীগ জামাতের আর একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা) সাহেব এ সমস্ত কিতাবের বিরুদ্ধে ছিলেন এ কথা সঠিক নয়। বরং তারা গেয়ারভী শরীফ, চাহরম ইত্যাদিকে নাজায়েয মনে করতেন। এই দুই হযরত মাওঃ ইসমাঈল দেহলভী শহিদ (ওহাবী গুরু), মাওঃ রশিদ আহমদ সাহেব গাঙ্গুহী (ওহাবী গুরু) এবং মাওঃ থানভী (ওহাবী গুরু)-এর অনুসারী ছিল। (ফতোয়া-প্রদানে- মুহাম্মদ জিয়াউল হক দেহলী, মাদরাসায়ে আমিনিয়া, দিল্লিী।)
[তাবলীগী জামাত, আল্লামা এরশাদ কাদেরী, পৃ. ১৫৪]
আর ওহাবীদের গুরু ইসমাঈল দেহলভী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী এবং আশরাফ আলি থানভীর আকিদা ছিল বাতিল আকিদা/ভ্রান্ত আকিদা। যেমন- তাদের আকিদা হল-
১. আল্লাহ্ মিথ্যা বলতে পারেন।
[ফাতাওয়া-ই রশিদিয়া, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, খ.-১, পৃ.৯]
২. হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তা‘আলা তেমনি অদৃশ্য জ্ঞান দান করেছেন, যেমন-জ্ঞান জানোয়ার, পাগল এবং শিশুদের নিকটও রয়েছে।
[হিফযুল ঈমান, আশরাফ আলি থানভী, পৃ. ৭]
৩. নামাযে হুযূর আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি খেয়াল যাওয়া গরু-গাধার খেয়াল যাওয়ার অপেক্ষাও মন্দতর। [সেরাতে মুস্তাক্বীম, ইসমাঈল দেহলভী, পৃ. ৮৬]
৪. নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান শুধু বড় ভাইয়ের মতই করা চাই।
[তাক্বভিয়াতুল ঈমান, ইসমাইল দেহলভী, পৃ. ১৬]
৫. হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করে মাটিতে মিশে গেছেন।
[তাক্বভিয়াতুল ঈমান, ইসমাঈল দেহভলী, পৃ. ৫৯]
৬. নবীর মর্যাদা উম্মতের মধ্যে গ্রামের চৌধুরী ও জমিদারের মত। [তাকভিয়াতুল ঈমান, ইসমাইল দেহলভী, পৃ. ৬১]
৭. মীলাদ শরীফ, মিরাজ শরীফ, ওরস শরীফ, খতম শরীফ, চেহলামের ফাতিহাখানি এবং ঈসালে সাওয়াব সবই নাজায়েয, ভুল প্রথা, বিদআত এবং কাফির ও হিন্দুদের প্রথা। [ফাতাওয়া-ই রশীদিয়া, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী,
খন্ড-২, পৃ. ১৫০, এবং খ-৩, পৃ. ৯৩-৯৪]
৮. মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা তেমনি, যেমন হিন্দুরা তাদের কানাইয়্যার জন্মদিন পালন করে। [বারাহীন-ই ক্বাতেয়া, পৃ. ১৪৮ ও ফাত্ওয়ায়ে মীলাদ শরীফ, পৃ. ৮]
এছাড়াও তাবলীগ জামাতের আরো কিছু ভ্রান্ত আকিদা হল-
১. ‘দরুদ-তাজ’ অপছন্দনীয় এবং পাঠ করা নিষেধ।
[ফাযাইলে দরুদ শরীফ, পৃ. ৯২, ফাযাইলে আমাল তথা তাবলীগী নেসাব থেকে গৃহীত]
২. টঙ্গি ইজতেমার মাঠে এক রাকাতে উনপঞ্চাশ কোটি রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়।
[দাওয়াতে তাবলীগ, মুহাম্মদ আশরাফ আলী, পৃ. ৮০]
৩. গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহা, মিলাদ কিয়াম ইত্যাদি পালন করা নাজায়েয। [তাবলীগী জামাত, পৃ. ১৫৪] আর উক্ত ব্যক্তির বক্তব্য, ‘‘(যদি) মিলাদ শরীফ এবাদত মনে করে পড়ে, তাহলে জাহান্নামী (হবে)।’’ তার এ বক্তব্য সম্পূর্ণ শরিয়ত বিরোধী এবং ঈমান বিধ্বংসী বক্তব্য। কারণ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদ পালন করা এমন এক ইবাদত/সওয়াবের কাজ যা যুগ যুগ ধরে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িনে কেরাম, তবে-তাবেয়িনে কেরাম, বুযুর্গানে দ্বীন পালন করে আসছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদ পালনের পক্ষে অসংখ্য কুরআন-হাদীসের দলিল রয়েছে। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَالِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُوْنَ অর্থাৎ হে হাবীব! আপনি বলুন, আল্লাহর দয়া এবং রহমতকে কেন্দ্র করে তারা (আপনার উম্মতেরা) যেন আনন্দ উদযাপন করে এবং এটাই হবে তাদের অর্জিত সব কর্মফলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। [সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৮]
অত্র আয়াতে আল্লাহর রহমত’ বলতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।
প্রখ্যাত সাহাবি হযরত কাতাদাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত- سئل عن صوم يوم الاثنين قال ذاك يوم ولدت فيه الحديث ـ অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন- ঐ দিনেই আমার শুভাগমন হয়েছে।
[মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-২৮০৪, খ.৩, পৃ.১৬৭]
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা হতে বর্ণিত-
انه كان يحدث ذات يوم فى بيته وقاتع ولادته صلى الله عليه وسلم فيستبشرون ويحمدون الله ويصلون عليه الصلاة والسلام فاذا جاء النبى صلى الله عليه وسلم قال حلت لكم شفاعتى ـ
অর্থাৎ তিনি (হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা) একদিন তাঁর গৃহে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদে পাক উপলক্ষে লোকজনকে নিয়ে আলোচনা করছেন এবং হুযূর করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদতে পাকের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করছেন, সকলে এগুলো শুনে আনন্দিত হচ্ছেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলার প্রশংসা করছেন আর আল্লাহর নবীর উপর দরুদ-সালাম পাঠ করছেন। হঠাৎ করে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ আনলেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) বৈধ।
[আত্-তানভীর ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাজির, ইমাম আবুল খাতাব ইবনে দাহিয়া]
আর এ জন্য সারা বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুগ যুগ ধরে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালিত হয়ে আসছে। এমনকি সৌদি আরব তথা মক্কা-মদিনায় বর্তমান সৌদি তথা ওহাবি হুকুমাত আসার পূর্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মীয় গাম্ভীর্যের সাথে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হত। যেমন-
১. আল্লামা ইবনে জুবাইর (জন্ম ৫৪০হি. ওফাত ৬১৪হি.) বলেন-
يفتح هذا المكان المبارك اى منزل النبى صلى الله عليه وسلم يدخله جميع الرجال للتبرك به فى كل يوم الاثنين من شهر ربيع الاول ففى هذا اليوم وذلك الشهر ولد النبى صلى الله عليه وسلم
অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে জায়গায় জন্মগ্রহণ করেছেন তা উন্মুক্ত করা হয় এবং রবিউল আউয়াল মাসের প্রতি সোমবার বরকত হাসিলের জন্য উক্ত স্থানে লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করে। [কিতাবুল রিহাল, ইবনে জুবাইর, পৃ. ১১৪-১১৫হি.]
২. প্রখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা (জন্ম: ৭০৫হি. মৃত্যু-৭৭৯হি.) বলেন-
انه بعد كل صلاة جمعة وفى يوم مولد النبي صلى الله عليه وسلم يفتح باب الكعبة بواسطة كبير بنى شيبة وهم حجاب الكعبة وانه فى يوم المولد يوزع القاضى الشافعى وهو قاضى مكة الاكبر نجم الدين محمد ابن الامام محى الدين الطبرى الطعام على الاشراف وسائر الناس فى مكة ـ
অর্থাৎ প্রত্যেক জুমার নামাযের পর এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দিন কাবা শরীফের দরজার দারোয়ানের দায়িত্বে নিযুক্ত বনি শায়বা কর্তৃক কাবা শরীফের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দিন মক্কা শরীফের প্রধান কাজি নজমুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে ইমাম মুহিউদ্দীন তাবারি মক্কার সকল অভিজাত ব্যক্তিবর্গ এবং সকল জনসাধারণের জন্য খাবারের আয়োজন করেন। [ইবনে বতুতার সফরনামা, খ.১, পৃ. ৩০৯-৩৪৭]