আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আ’লা হযরতের চিন্তাধারা
মুহাম্মদ নেজাম উদ্দিন…
১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন হিন্দু জাতি এবং ইংরেজ উভয়ের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলিম জাতি দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে হিন্দু প্রাধান্যের ফলে তারা কেবল মান-ইজ্জতই হারায়নি, জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধও হারাতে বসে। এমন সময় তাদের ভাগ্যাকাশে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার ( ১৮৫৬-১৯২১) ন্যায় এক উজ্জ্বল জ্যেতিষ্কের উদয় হয়। তিনি মুসলমানদের রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দু জাতি থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র কর্মপন্থা অবলম্বনের উপদেশ দেন এবং সেসাথে তাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাদপদতা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও প্রদান করেন। তিনি মনে করতেন, ‘অর্থনীতি ও রাজনীতি পরস্পর অবিচ্ছেদ্য; একই বিভাগের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুসলমানদের শান্তি ও মুক্তির জন্য অবশ্যই এ উভয় ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব আদর্শকে অক্ষুণœ রাখতে হবে।’ তিনি ভারতের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেন তা হচ্ছেঃ
১. ‘সরকারি হস্তক্ষেপের ব্যাপার আছে এমন কতিপয় সীমিত বিষয় ছাড়া অপর সব বিষয়ের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের হাতে নিতে হবে এবং আমাদের সমস্যা আমাদের মাধ্যমেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কোটি কোটি (ব্রিটিশ আদালতে) স্ট্যাম্প এবং আইনজীবীর ফি বাবৎ নষ্ট হচ্ছে, যাতে একের পর এক গৃহ উজাড় হয়ে যাচ্ছে তা বেঁচে যেতো।’
২. ‘আমাদের কোন সামগ্রী মুসলিম ব্যবসায়ী ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে কেনা উচিত হবে না, যাতে আমাদের টাকা আমাদের মধ্যে সঞ্চিত থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, যাতে আমাদের প্রয়োজনের জন্য অন্য কারো উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। আমেরিকা এবং ইউরোপ আমাদের কাছ থেকে সস্তায় কাঁচামাল নিয়ে তৈরী জিনিস চড়া দামে বিক্রি করে।’
৩. বোম্বাই, কলকাতা, রেঙ্গুন এবং মাদ্রাজের ধনী মুসলমানদের উচিত ‘মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।’
৪. ‘সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো যে, আমাদেরকে ধর্মের রশি মজবুত করে ধরতে হবে। এর মাধ্যমেই আমাদের পূর্ব পুরুষরা উন্নতির শীর্ষস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং বিশ্বময় তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এক যুগে ভাতের কাঙ্গালরা সিংহাসনে আরোহণ করেছিলো। আর তা ছেড়ে দেওয়ার কারণে আজকের মুসলমানদের এহেন লাঞ্ছনার গর্তে পতিত করেছে। আর সুদৃঢ় দ্বীন, দ্বীনি শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। মুসলমানরা যদি এ চারটি প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়, তবে ইনশা-আল্লাহ্ আজই তাদের অবস্থা সামলে উঠবে।’’ [সূত্র তাদবীরে ফালাহ্]
আ’লা হযরত তাঁর প্রথম প্রস্তাবনায় মুসলমানদেকে মামলা-মোকাদ্দমা ও বিলাসিতায় টাকা অপচয় না করে তা মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনে সঞ্চয় করার পরামর্শ দেন। আর এ সঞ্চয় যেনো ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে অযথা পড়ে না থাকে সে জন্য সুদবিহীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রতি আহ্বান জানান। যাতে হিন্দু মহাজনের চক্রবৃদ্ধি সুদের অভিশাপ থেকে মুসলমানগণ মুক্তি লাভ করে এবং ব্যাংক থেকে সুদবিহীন ঋণ নিয়ে যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারে।
আ’লা হযরত ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের মধ্যেকার তৎকালীন অসম বাণিজ্যের পর্যালোচনা করে এ বলে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, ‘আমেরিকা এবং ইউরোপ আমাদের কাছ থেকে সস্তায় কাঁচামাল নিয়ে তৈরি জিনিষ চড়া দামে বিক্রি করে।’ এ অসম বাণিজ্যের ফলে ভারতবর্ষকে ক্রমশ দূর্বল ও পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। এ দেশের কাঁচামাল ইউরোপের শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছে। ফলে ইংরেজ আমলে ভারতবর্ষে প্রয়োজনীয় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি। বরং উল্টোভাবে এ দেশের অনেক শিল্পকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ফলে ভারতবর্ষের রফতানির চেয়ে আমদানি করতে হয় অনেক বেশি। এ জন্য ভারতবাসী নিজ প্রয়োজন মেটাতে ইংরেজদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে তারা প্রতিনিয়তই আরো দরিদ্র হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আ’লা হযরত মুসলমানদেরকে ইংরেজ চাকুরির প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ঘটাতে উৎসাহিত করেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি তৎকালীন মুসলমানদের ক্ষীয়মান মানসিকতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে আ’লা হযরত বলেন, মুসলমানদের মধ্যে যারা একটু সামাজিক মর্যাদা সচেতন, তারা ব্যবসা-বাণিজ্যকেই নীচতা মনে করে, আর চাকুরি নামের দাসত্বের জন্য ধর্ণা দেয়। হারাম কাজ করা, হারাম খাওয়াকে মনে করে গৌরব ও মর্যাদার। কেউ কেউ ব্যবসা করলেও ক্রেতাদের এতটুকু বোধও নেই যে, স্বজাতির কাছ থেকে ক্রয় করি। চড়া দামে অতিরিক্ত মুনাফা নিলেও লাভ তো স্বজাতি ভাইয়েরই হচ্ছে। ওদিকে বিক্রেতার অবস্থা হচ্ছে, পুরো লাভ একই খদ্দের থেকে উদ্ধার করে নিতে চান। বেচারা ক্রেতা নিরুপায় হয়ে বিধর্মী (হিন্দু) থেকেই কিনতে যান। এ অভ্যাস কি ছাড়তে পারবেন?’’
আ’লা হযরত মুসলিম উম্মাহর বিশেষত ভারতীয় মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক উন্নতির পথে যে দু’টি জিনিসকে বাধা মনে করতেন, তা হচ্ছে, দারিদ্র্য আর দ্বীনি শিক্ষা থেকে বিমুখতা। তাঁর মতে, দারিদ্র মনুষ্যত্ব ও বিশ্বমানবতার চরম শত্রু। স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া ব্যক্তিসত্তার বিকাশ যেমন অসম্ভব, তেমনি আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ছাড়া মানবতার পূর্ণতা লাভও সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার গটাতে তিনি উৎসাহিত করেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলধন জোগাতে সুদবিহীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রতি ধনাঢ্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান।
আর মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নতির জন্য আ’লা হযরত যে বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন তা হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষা। আ’লা হযরতের মতে, ‘মুসলমানদের দ্বীন (ধর্ম) তাঁদের শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত। এ দ্বীন ও দ্বীনি শিক্ষাই হচ্ছে তাঁদের প্রাণকেন্দ্র এবং মৌলিক বিষয়। এটা আঁকড়ে ধরে ছিলো বলেই আমাদের পূর্বরুষরা মর্যাদার উচ্চ শিখরে উপনীত হতে পেরেছিলেন। এক মুঠো ভাতের কাঙ্গালদের শীর্ষ মুকুটধারী হবার গৌরব দিয়েছিলো। আর তা ছেড়ে দেওয়াটাই পরবর্তীদের এহেন লাঞ্ছনার গহ্বরে পতিত করেছে।’’
আলা হযরতের মতে, মুসলিম জাতির দুঃখ-দুর্দশা ও অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার মূল কারণ হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষার অভাব। তিনি প্রচলিত ব্রিটিশ শিক্ষানীতির কট্টর সমালোচক ছিলেন এবং ইসলামী শিক্ষার আদলে স্বতন্ত্র শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর মতে, দ্বীনি শিক্ষা লাভের ফলে মুসলমানদের বিদ্যা-বুদ্ধি, চিন্তা-ভাবনা ও দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি নতুন নতুন বিষয় ও যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে তাঁদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি লাভ করাও সহজতর হয়ে উঠবে। অন্যদিকে দ্বীনি শিক্ষার ফলে হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হবে, ফলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রেখে চারিত্রিক উন্নতি লাভ করতে পারবে।