ড. মুহাম্মদ ইছমাইল নোমানী
উপমহাদেশে ইংরেজদের দুঃশাসন ও কাদিয়ানী-ওহাবী বাতিল মতবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তখন ১২৭২ হিজরির ১০ শাওয়াল/১৮৫৬ খ্রি. ১৪ জুন শনিবার যোহরের সময় ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শহরে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত আজিমুল বরকত ইমামুল ইশকে ওয়াল মুহাব্বত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযিলে বেরেলভী শুভ জন্মলাভ করেন। তিনি ক্ষুরধার লিখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে বাতিল মতবাদের সমোচিত জবাব দিয়ে ইসলামের বাস্তব রূপ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতাদর্শ বিশ্বের বুকে তুলে ধরেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ এই কলম সম্্রাট ৭২টি বিষয়ে প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান চেয়ে বিশ্ব মুসলিম তাঁর শরণাপন্ন হতেন-যা প্রশ্নোত্তর সম্বলিত ফাতাওয়া-ই রেজভিয়া আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত। এ ছাড়া তিনি নিত্য নতুন অনেক বিষয়ে রচনা করেছেন সময়োপযোগী তথ্য ও তত্ত্ববহ বহু কিতাব। তম্মধ্যে কারেন্সি নোট (প্রচলিত কাগজী মুদ্রা) সংক্রান্ত গ্রন্থখানা প্রসিদ্ধ। যখন কাগজী মুদ্রার প্রথম প্রচলন শুরু হয়েছিল তখন আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমন করেছিলেন। সে কাগজী মুদ্রা বা কারেন্সি নোট প্রচলন শুরু হলে সারা বিশ্বে এ মাসআ’লা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সেটা কি আসলে স্বর্ণ-রৌপ্যের মান রাখে; না সাধারণ কাগজ হিসেবে গণ্য? সাধারণ কাগজ হলে তাতে যাকাতের বিধান আরোপ হবে না। আর স্বর্ণ-রৌপ্য হিসেবে গণ্য হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। এ বিষয়ে সারা মুসলিম বিশ্বের ন্যায় মক্কা শরীফেও তৎসম্পর্কে গবেষণা আরম্ভ হয়। জামাল ইব্ন আব্দুল্লাহ মক্কা মোকাররমায় হানাফী মাযহাবের বড় ইমাম ছিলেন। তাঁর কাছে কারেন্সি নোট সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি তাওয়াক্কুফ (নিরবতা অবলম্বন) করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির দর্শন ও তাঁর কালজয়ী ফাতওয়া তখন সমগ্র মুসলিম বিশে^ সমাদৃত হয়। তাঁর সুখ্যাতি শুনে তখন ইমাম শায়খ আব্দুল্লাহ মীরদাদ বিন্ শায়খুল খোতাবা শায়খ মুহাম্মদ আবুল খায়র রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আ’লা হযরতের নিকট কারেন্সি নোট সম্পর্কে বারটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। মক্কা শরীফের বড় বড় বিশেষজ্ঞ ওলামা কিরাম তখন আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার কাছে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেনÑ কারেন্সি নোট বা কাগজী নোট কি মুদ্রা, না সাধারণ মাল; না একটি রিসিট (রশিদ)? এ সম্পর্কে তাঁকে বারটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। আ’লা হযরত একদিন ও আরেক দিনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে সম্পর্কে লিখিত ফাতওয়া দিলেন ‘কিফলুল ফকীহিল ফাহিম ফী আহকামি ক্বিরত্বাসিদ দারাহিম’ (كفل الفقيه الفاهم في احكام قرطاس الدراهم)। লিখিত উক্ত গ্রন্থখানা শায়খুল আইম্মা আল্লামা আহমদ আবুল খায়র মীরদাদ হানাফী, সাবেক মুফতি ও কাযী শায়খ সালিহ কামাল, হাফিযুল কুতুব সৈয়দ ইসমাইল খলীল হানাফী ও মুফতি আব্দুল্লাহ সিদ্দীক রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সহ মক্কা মোকাররমার নির্ভরযোগ্য ওলামা কিরাম আদ্যোপান্ত শুনে আ’লা হযরতের ভূয়সী প্রশংসা করেন। হানিফী মাযহাবের বিশিষ্ট ইমাম জামাল ইব্ন আব্দুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আ’লা হযরতের উক্ত কিতাব পড়ে অভিভূত হয়ে যান। তখন শায়খ আব্দুল্লাহ সিদ্দীক তাঁকে বললেন- উক্ত কিতাবের লেখক মক্কায় অবস্থান করছেন। তা শুনে তিনি আ’লা হযরতের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং দ্বীনি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। আ’লা হযরত উক্ত কিতাবখানা আরবি ভাষায় প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তান হযরত হুজ্জাতুল ইসলাম হামেদ রেযা খান বেরলভী উর্দুতে অনুবাদ করে বেরলি থেকে তা ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। উক্ত কিতাব লিখে অনেক দলীল-প্রমাণ সহকারে উপস্থাপন করে দিলেন- কানেন্সি নোট বা কাগজী নোট মূল্যবান সম্পদ (مال متقوم)এবং তা মুদ্রা।
যে বারোটি প্রশ্ন আ’লা হযরতকে করা হয়েছিল সেগুলো হলো-
১. ওই কারেন্সি নোট কি মাল; না নথিপত্রের মতো কোনো সনদ?
২. যখন সেটি নিসাব পরিমাণ হওয়া অবস্থায় এক বছর অতিবাহিত হয় তখন তার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে কি না?
৩. তাকে মোহর হিসেবে ধার্য্য করা যাবে কি না?
৪. যদি কেউ সংরক্ষিত স্থান থেকে তা চুরি করে তজ্জন্য হাত কাটা যাবে কি না?
৫. যদি কেউ তা নষ্ট করে ফেলে তার পরিবর্তে তাকে নোট বা রুপিয়া দিতে হবে কি না?
৬. রুপিয়া, আশরাফি ও পয়সার বিনিময়ে তা বেচাকেনা জায়িয কি না?
৭. কেউ কাপড় দিয়ে তা বদলালে তা বায়’ (বেচাকেনা) হবে; না মালের বদলে বস্তুর বিনিময় হবে?
৮. সেটাকে কর্জ হিসেবে দেয়া জায়িয হবে? জায়িয হলে পরিশোধের সময় নোট দিতে হবে; নাকি রুপিয়া?
৯. রুপিয়ার বিনিময়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে তা বেচাকেনা জায়িয কি না?
১০. তা দিয়ে বায়’ সাল্ম (অগ্রিম মাল ক্রয়) কি বৈধ?
১১. কারিন্সি নোটে যা লেখা আছে তার কম বা বেশিতে বিক্রি করা যাবে কি না?
১২. যদি সে কারেন্সি নোট বৈধ হয় তাহলে কি এটাও বৈধ হবে যে, যায়দ নামক ব্যক্তি আমর থেকে ১০টি নোট কর্জ নিতে চায়। আমর বলল- আমার কাছে রুপিয়া নেই। আমি ১০টি কারেন্সি নোটকে আপনার নিকট ১২টির বদলে কিস্তি আকারে বিক্রি করছি। প্রতি মাসে এক রুপিয়া করে পরিশোধ করবো। এ ধরণের লেনদেনকে কি সুদ মনে করে নিষেধ করা হবে? যদি নিষেধ করা না হয় তাহলে সুদের মধ্যে ও এ ধরণের লেনদেনে পার্থক্য কি? তা কি হালাল; না হারাম? অথচ উভয় পার্শ্বে রয়েছে একই মাল আর তাতে বৃদ্ধি পাওয়া গেছে।
আ’লা হযরত সে প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে গিয়ে অনেক বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো- আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মাল (مال)কে চার ভাগ করেছেন।
১. এমন মাল যা সর্বদা ثمن ওয়ালা বা মূল্যমান। আবিস্কার থেকেই মূল্যমান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমনÑ স্বর্ণ, চাঁদি। এগুলো সর্বযুগে সবসময় মূল্যমান বস্তু হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে।
২. সর্বদা مبيع বা বিক্রিত বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত। যেমনÑ কাপড়-চোপড় ইত্যাদি।
৩. মালের মধ্যে এমন কোনো গুণ (وصف ) থাকে যা কোনো সময় مبيع বা বিক্রিত বস্তু আর কোনো সময় ثمن ওয়ালা (মূল্যমান) হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৪. প্রকৃতপক্ষে তা বস্তু; কিন্তু পরিভাষায় তা ثمن ওয়ালা হিসেবে ব্যবহৃত। যেমন- টাকা, রিয়াল, দিরহাম, রুপি ইত্যাদি। তিনি অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেনÑ নগদ কারেন্সি নোট (টাকা) থাকলেও যাকাত ওয়াজিব স্বর্ণ-চাঁদির মতো। মোদ্দাকথা- আ’লা হযরত নগদ টাকা, ডলার, পাউ-, রিয়াল যে ধরণের মুদ্রা হোক না কেন- সবগুলোকে মূল্যমান ধরে তিনি নগদ টাকা থাকলে সাহেবে নিসারের উপর যাকাত আবশ্যক বলেছেন।
মৌলভী রশীদ আহমদ গাংগুহী ফাতওয়া দিয়েছেনÑ কাগজী নোট হলো চেক। চেক হলে তা যেহেতু শরীয়তের দৃষ্টিতে নগদ মাল নয়, তাই কারো নিকট কোটি টাকার চেক থাকলেও শরীয়ত মতে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। আ’লা হযরত আঠারোটি দলিল দিয়ে তা রদ্দ করে দিয়েছেন। আ’লা হযরতের ফাতওয়াই এখন সারা বিশে^ প্রচলিত। গাংগুহী সাহেবের ফাতওয়া মতে কাগজী নোট হলো চেক। চেক দিয়ে তো মুদীর দোকানেও কোন বেচাকেনা হয় না। গাংগুহীর ফাতওয়া অচল। বিশে^র মানুষ গাংগুহীর ফাতওয়াকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে দিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে আ’লা হযরতের ফাতওয়াকে। তাই নেসাব পরিমাণ স্বর্ণ-চাঁদি থাকলে যেমন যাকাত ওয়াজিব তেমনি সমপরিমাণ নগদ কারেন্সি নোট (ছাপানো টাকা) থাকলেও যাকাত ওয়াজিব।
আর কোটি টাকার চেক থাকলে পরিপূর্ণ মালিকানা (ملك تام) অর্জিত হয় না বিধায় তাতে যাকাত ওয়াজিব নয়।
মূল্যবান বস্তু চুরি করলে যেমন হাত কাটা হয় তেমনি ১০ দিরহাম বা সমপরিমাণ কারেন্সি নোট (কাগজে ছাপানো টাকা) চুরি করলেও ইসলামি রাষ্ট্রে ইসলামি আইন মতে হাত কাটা যাবে। ইসলামি আইনে কিন্তু মূল্যবান সম্পদ (مال متقوم) না হওয়ার কারণে কেউ কুরআন শরীফ চুরি করলে এমনকি স্বর্ণ দিয়ে সেটার কভারকে মোড়ানো হলেও হাত কাটা যাবে না। কারণ কুরআন مال متقوم নয়; বরং তা অমূল্য সম্পদ।
পরিশেষে বলব- আ’লা হযরত অপরাজেয় এক কলম স¤্রাট, যার সামনে বাতিলরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নি। তাঁর কলমের সামনে সবাইকে মাথা নত করতে হয়েছে। তাই তাঁর দর্শনকে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারলে মুসলিম বিশ্ব বাতুলতা গোমরাহী থেকে মুক্তি পাবে। আল্লাহ তা‘আ’লা আ’লা হযরতের দর্শনকে সর্বত্র প্রচার করার তাওফিক দান করুন। আমীন!
লেখক : অধ্যক্ষ-আল আমিন বারীয়া কামিল মডেল মাদরাসা, বাহির সিগন্যাল, চট্টগ্রাম।