ত্বরীক্বতকে শরীয়ত থেকে পৃথক করার ফিৎনার
মূলোৎপাটনে আ’লা হযরতের অবদান
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান….
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য শরীয়তের বিধানাবলী পালন করা অপরিহার্য। ওই মুসলমান সাধারণ লোক হোক, নিরক্ষর হোক, ব্যবসায়ী হোক, চাকুরীজীবি হোক, অফিসার হোক, ছাত্র হোক, আলিম হোক, ফক্বীর হোক, কিংবা সূফী হোক সবার ক্ষেত্রে পবিত্র শরীয়তের বিধানাবলী প্রযোজ্য ও কার্যকর।
কিন্তু কিছু সংখ্যক প্রবৃত্তিপূজারী ও ভন্ড সূফী এ মর্মে অপতৎপরতা চালিয়ে এসেছিলো যে, ‘আমরাতো ত্বরীক্বতপন্থী, আমরা ত্বরীক্বতপন্থীদের জন্য শরীয়তের বিধানাবলী পালন করা অপরিহার্য নয়। বস্তুত শয়তানের কুমন্ত্রণার শিকার হয়ে এসব মূর্খ লোক শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপ নির্দ্বিধায় সম্পন্ন করতে আরম্ভ করে। শরীয়তের অকাট্য কানুনগুলোকে শিকেয় তুলে রাখে। এমনকি নামায-রোযার বিধানগুলো পালন করাকেও বর্জন করে বসে।
যখন তাদের ওইসব শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপের জন্য পাকড়াও করা হয়, তখন নিজেদের রক্ষার জন্য তারা ত্বরীক্বতের নামমাত্র জামা পরিধান করে নিয়েছে। আর কেউ কেউ শরীয়তের নিয়ম-কানুন পালন থেকে নিজেদেরকে দায়মুক্ত ও ‘মারফূ‘উল ক্বলম’ (শরীয়তবিরোধী কাজ করলেও তাদের আমলনামায় গুনাহ্ লিপিবদ্ধ করা হবে না এমন) প্রমাণ করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। আর ভুল ও মিথ্যা বর্ণনা এবং ঘটনাবলী নিছক নিজেদের থেকে রচনা করতে থাকে। তারা এভাবে পূর্ববর্তী সত্যিকার অর্থে সম্মানিত সূফীদেরও দুর্নাম হবার কোন পন্থা বাকী রাখেনি। তাদের শরীয়তবিরোধী কর্মকান্ড সম্পাদনকে অতীতে মহান ও উচ্চ মর্যাদাবান এবং শরীয়তের বিধানাবলী পালনকারী সম্মানিত সূফীগণেরই অনুসরণ বলে চালিয়ে দিচ্ছিলো এবং মুসলিম মিল্লাতকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করছিলো। তারা ‘ত্বরীক্বত, হাক্বীক্বত ও মা’রিফাত’ নামে এক নতুন ত্বরীক্বত প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করলো। তারা সম্মানিত সূফীগণের নামের অপব্যবহার করলো। বস্তুত তারা কুপ্রবৃত্তির শিকলে আবদ্ধ কয়েদী হয়ে নিজেদেরকে নিজেরাই শরীয়তের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করে নিলো। শরীয়তের নিয়ম-কানুনের মর্যাদা ও গুরুত্বকে তাদের অন্তরগুলো এমনভাবে ঘৃণার চোখে দেখতে লাগলো। আর গর্ব-অহঙ্কারের নেশায় নিজেরা নিজেদেরকে এমন মনে করতে লাগলো যে, শরীয়তের অনুসারীদের থেকে নিজেদেরকে উঁচু মর্যাদা সম্পন্ন ও আল্লাহর দরবারে মাক্ববূল কল্পনা করতে লাগলো। তারা নিজেরা তো পথভ্রষ্ট হয়েছে, তাদের অনুসারী ভক্ত-বৃন্দকেও পথভ্রষ্ট করলো। এর মাধ্যমে তারা এক চরম বিভ্রান্তির জন্ম দিলো।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা মুহাদ্দিসে বেরলভী আলায়হির রাহমাহ্ ওয়ার রিদ্ব্য়ানকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি শরীয়ত ও তরীক্বতের হাক্বীক্বত বা বাস্তবাবস্থা এবং মা’রিফাতের এক মুজাদ্দিদ সূলভ শানে বর্ণনা দিলেন। আর ত্বরীক্বতের অনুসরণের আড়ালে শরীয়তের অনুসরণ থেকে বিমুখ মিথ্যাবাদীদের মনগড়া কথাবার্তার এমন জবরদস্ত খন্ডন করলেন যে, ওইসব মনগড়া মূলনীতিগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
ইমাম আহমদ রেযা মুহাদ্দিসে দেহলভী এ বিষয়বস্তুর উপর স্বতন্ত্র কিতাব (পুস্তক) প্রণয়ন করেছেন আর ওই কিতাবে তিনি শীর্ষস্থানীয় সম্মানিত সাহাবীগণ, তাবে‘ঈগণ, তব‘ই তাবে‘ঈগণ এবং শীর্ষস্থানীয় ওলীগণ সম্মানিত সূফীগণের উক্তি, অভিমত ও কর্মগুলো উদ্ধৃত করেছেন। তাঁদের অনেকের নাম নি¤œরূপঃ
১. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, ২. আমীরুল মু’মিনীন হযরত সাইয়্যেদুনা মাওলা আলী মুরতাদ্বা, ৩. হযরত ইমাম হাসান বসরী, ৪. হযরত ইমাম শাফে‘ঈ, ৫. হযরত জুনায়দ বাগদাদী, ৬. হুযূর সাইয়্যেদুনা গাউসুল আ’যম, ৭. হযরত সারিউস্ সাক্বাতী, ৮. হযরত আবুল ক্বাসেম ক্বুশায়রী, ৯. হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মদ গায্যালী, ১০. হযরত আবূ ইয়াযীদ বোস্তামী, ১১. হযরত আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম বোখারী কালাবাযী, ১২. হযরত শিহাব উদ্দিন সুহরুওয়ার্দী, ১৩. হযরত মুহিউদ্দিন ইবনে আরাবী, ১৪. হযরত ইব্রাহীম দাসূক্বী, ১৫. হযরত আবদুল ওয়াহ্হাব শা’রানী, ১৬. হযরত মাখদূম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানী, ১৭. হযরত নূর উদ্দীন জামী, ১৮. হযরত নিযাম উদ্দিন আউলিয়া, ১৯. হযরত মীর আবদুল ওয়াজিদ বালগ্রামী, ২০. হযরত শাহ্ কলীম উল্লাহ্ চিশতী জাহান-আবাদী এবং ২১. হযরত আবদুল গণী নাবলূসী প্রমুখ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম আজমা‘ঈন।
শরীয়ত ও ত্বরীক্বত সম্পর্কে ইমাম আহমদ রেযা মুহাদ্দিসে বেরলভী বলেছেন-
ত্বরীক্বতে যা কিছু খুলে যায় (কাশ্ফ হয়) সবই শরীয়তের অনুসরণের কারণেই হয়। অন্যথায় শরীয়তের অনুসরণ ছাড়া বড় বড় কাশ্ফ (অস্বাভাবিকভাবে অনায়াসে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া) রাহিব, যোগী ও সন্যাসীদেরও হয়ে থাকে। তারপর তারা এগুলোর দোহাই দিয়ে লোকজনকে কোথায় নিয়ে যায়? ওই জাহান্নামের আগুন ও মর্মন্তুদ শাস্তি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে ছাড়ে।
মোটকথা, শরীয়তের প্রয়োজন প্রত্যেক মুসলমানের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি মুহূর্তে আমৃত্যু রয়েছে। তরীক্বতে প্রবেশকারীদের জন্য আরো অতিরিক্ত প্রয়োজন হচ্ছে- এ পথটা যতবেশী সরু, ততবেশী যোগ্য পথপ্রদর্শকের।
শরীয়ত হচ্ছে- সমস্ত বিধান, দেহ ও প্রাণ, রূহ ও ক্বলব আর খোদায়ী ইল্ম ও সীমাহীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক। ওইগুলোর একেকটা টুকরার নাম তরীক্বত ও মা’রিফাত। সুতরাং অকাট্যভাবে সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে- সমস্ত সম্মানিত ওলীগণের জন্য সমস্ত হাক্বীক্বতকে পবিত্র শরীয়তের নিরীখে পেশ করা ফরয। কোন বিষয় যদি শরীয়তের অনুরূপ হয়, তবে সত্য ও গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় প্রত্যাখ্যাত ও ঘৃণিত। সুতরাং একথাই নিশ্চিত ও অকাট্য যে, শরীয়তই আসল, শরীয়তই মূল বা ভিত্তি, শরীয়তই হলো মানদন্ড।
শরীয়ত হচ্ছে প্র¯্রবণ, আর ত্বরীক্বত হচ্ছে তা থেকে নিসৃত নদী ও সমুদ্র।
ত্বরীক্বত হচ্ছে শরীয়তই এ-ই আলোময় পথের শাখা ।
শরীয়ত হচ্ছে বৃক্ষ আর ত্বরীক্বত হচ্ছে সেটার ফল।
ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী তাঁর উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করার জন্য, যেসব দলীল পেশ করেছেন, সেগুলো ক্বোরআন এবং হাদীস ছাড়াও ইসলামের শীর্ষস্থানীয় ওলীগণের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি থেকে গৃহীত। যেমন-
১. ত্বরীক্বতে কুবরা, ২. বাহজাতুল আসরার, ৩. ইহ্ইয়াউল উলূম, ৪. আল-ইয়াওয়াক্বীত ওয়াল জাওয়াহীর ফী আক্বাইদিল আকাবির, ৫. রিসালা-ই ক্বোশায়রিয়াহ্ (মিশর থেকে মূদ্রিত), ৬. হাদীক্বাহ্-ই নাদিয়্যাহ্ (মিশর), ৭. আওয়ারিফুল মা‘আরিফ (মিশর), ৮. ফুতূহাত-ই মক্কিয়্যাহ্, ৯. মীযা-নুশ্ শরীয়‘আতিল কুবরা, ১০. কিতাবুল ইব্রীয, ১১. নাফহাতুল উন্স, ১২. লাত্বা-ইফ-ই আশরাফিয়া, ১৩. সিয়ারুল আউলিয়া এবং ১৪. সাব‘ই সানাবিল।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা আলায়হির রাহ্মাহ্ ওয়ার রিদ্ব্ওয়ান ‘মাক্বা-লুল উরাফা’ নামের এক ঐতিহাসিক কিতাব লিখে উপরিউক্ত মাসআলাকে মধ্যাহ্ণ, সূর্যের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ’তে তিনি সমস্ত সংশয়ের অপনোদন করেছেন। তাছাড়া, তাসাওফ সম্পর্কে প্রসারিত বহু ভুলবুঝাবুঝি এবং সম্মানিত সূফীগণের বহু কবিতা বা পংক্তির ভুল ব্যাখ্যার খন্ডন করে তিনি মানুষকে সেরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে নির্ভুল দিশা দান করেছেন। এর সঠিক অনুমান তাঁর নি¤œলিখিত কিতাবগুলো পাঠ-পর্যালোচনা করলেও করা যাবে-
১. মাক্বালুল ‘ওরাফা’ বিই‘যা-যি শর‘ই ওয়া ওলামা ( ১৩২৭হি.)
২. কাশ্ফে হাক্বাইক্ব ওয়া আসরার ও দাক্বা-ইক্ব (১৩০৮হি.)
৩. ‘আত্ব ত্বালাত্ব্ত্বুফ বি জাওয়াবি মাসাইলে তাসাওফ (১৩১২হি.)
[সূত্র. ইমাম আহমদ রেযা এক মযলূম মুফাক্বির, কৃত. আল্লামা আবদুস্ সাত্তার হামদানী,
মুহাদ্দিসে বেরলভী, কৃত.-ড. মাস‘ঊদ আহমদ ইত্যাদি]