নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বেমেসাল, বেনজির
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস আলকাদেরী
==========
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাওমে বেসাল (রাতে ইফতার ও পানাহার না করে লাগাতার রোযা রাখা) হতে নিষেধ করেছেন। তখন তাঁকে কোন পুরুষ (সাহাবী) বলেছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি তো সাওমে বেসাল রাখেন। তখন তিনি (নবীজী) বললেন-ايّكم مِثلى انّى ابيت يطعمنى ربى ويسقينى- ‘‘তোমাদের মধ্যে কে আমার মতো হবে? নিশ্চয় আমি রাত-যাপন করি, আমার প্রভু আমাকে খাওয়ান ও আমাকে পান করান।’’
উপরিউক্ত হাদীসে পাকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, ঘোষণা দেন যে, ايّكم مثلى (তোমাদের মধ্যে কে আমার মতো হবে?) অর্থাৎ তোমাদের কেউ আমার মত হতে পারবে না। উলামায়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলেন, কোন উম্মত কোন দিক থেকে রাসূলে পাকের মতো নয়। রাসূলে পাক সব দিক দিয়ে বেমেসাল (অতুলনীয়), কারো মতো নন। বরং তিনি নিজেই নিজের উপমা। সে জন্যে মাওলানা শাহ্ আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
لم يأت نظيرك فى نظر مثل تو نه شد پيدا جانا-
(ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কোন দৃষ্টিতে আপনার দৃষ্টান্ত আসেনি, আপনার মতো কাউকে সৃষ্টি করা হয়নি।
এ প্রবন্ধে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এমন কিছু দিক তুলে ধরতে চাই, যেগুলোতে তিনি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
¬¬
সৃষ্টির উপাদানের ক্ষেত্রে নবীজী মানুষের মতো নন
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- ইমাম আবদুর রাজ্জাক (ইমাম বুখারীর দাদা ওস্তাদ) মোয়াম্মার হতে, তিনি ইবনে মুনকাদির হতে, তিনি হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে, তিনি (হযরত জাবের) আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গ। আপনি আমাকে খবর দিন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সকল বস্তুর পূর্বে কোন বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তিনি (রাসূলে পাক) বলেন, সকল বস্তুর পূর্বে তাঁর (আল্লাহ্র) নূর হতে তিনি তোমার নবীজীর নূর সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী (লা-মাকানে) পরিভ্রমণ করতে থাকে . . . .।
উপরিউক্ত হাদীসে মরফু দ্বারা প্রমাণ হলো যে, সর্বপ্রথম আমাদের নবীজীর নূর মোবারক, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আমাদের নবীজীর সৃষ্টির উপাদান নূর।
সাধারণ মু’মিন যখন সহবাস করে তখন ললাটের স্পর্শ হতে নফসে মুতমায়িন্না স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু আম্বিয়া কেরামের মাতা-পিতার ললাট হতে বরকত মণ্ডিত পারস্পরিক নৈকট্যের সময় নফসে ইলাহি কিংবা রূহে ইলাহি স্থানান্তরিত হয়। এ নেয়ামত নবী ছাড়া কারো ভাগ্যে জোটে না। এ জন্যই নবীগণ নূর। এবং নবীগণের পিতা-মাতা মু’মিন। নবীগণ নূরবিহীন হতে পারেন না। তাঁদের মাতা পিতা গায়রে মু’মিন হতে পারেন না।
নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তরিত হওয়ার বিবরণ
এ নূরে মুহাম্মদী সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা‘আলা নিজের কুদরতের হাতের মাধ্যমে আদম আলায়হিস্ সালামের কপালে রাখলেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলার বাণী- وَنَفَخْتُ فيه من روحى- (আমি তাঁর মধ্যে আমার রূহ ফুঁক দিলাম।) এ জন্যেই ফেরেশতাদের নির্দেশ দিয়েছেন- اسجدوا لادم (তোমরা সবাই আদম আলায়হিস্ সালামকে সাজদা কর) এ নির্দেশ পেয়ে ফেরেশতাগণ আদম আলায়হিস্ সালামকে সাজদা করলেন, ইবলিস ব্যতীত, সে অস্বীকার করল এবং অহংকার করল। ফলে সে কাফেরদের দলভুক্ত হয়ে গেল।
হযরত আদাম আলায়হিস্ সালাম থেকে নূরে মুহাম্মদী তাঁর ছেলে শিষ আলায়হিস্ সালামের মধ্যে স্থানান্তরিত হলো। এভাবে নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তরিত হয়ে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সলাম এবং তাঁর থেকে হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম এবং তাঁর থেকে তাঁর ছেলে হযরত কায়জার, তাঁর থেকে তাঁর ছেলে হামল, তাঁর থেকে তাঁর ছেলে নাবাত এবং তাঁর থেকে তাঁর ছেলে আদনান পর্যন্ত এসে পৌঁছে। এভাবে নূরে মুহাম্মদী স্থানান্তরিত হতে হতে হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত এসে পৌঁছায়।
রাসূলে পাকের মাতা-পিতার বিবাহ ও নূর মোবারক স্থানান্তর
৫৬৯ খ্রিস্টাব্দের পহেলা রজব মা আমেনা ও হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার বিবাহ্ সম্পন্ন হয়। সেদিন শুক্রবার রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূর মোবারক পিতা আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে মা আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর রেহেমে স্থান লাভ করেন। স্বামী-স্ত্রীর এ সাক্ষাৎ হয় শিয়াবে আবিতালিবে। ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বিবি আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এ রাতেই বিবি আমেনাকে স্বপ্ন যোগে জানানো হয় যে, তুমি এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানবকে ধারণ করেছ। সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার নাম রাখবে মুহাম্মদ (অতিপ্রশংসিত)।
পশুদের বলাবলী
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, সে রাতেই কোরাইশদের গৃহপালিত পশুগুলো পরস্পরের মধ্যে বলাবলী করছিল যে, আজ সমগ্র পৃথিবীর প্রদীপ, আল্লাহর প্রিয় রাসূল মাতৃগর্ভে এসেছেন। তাদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল।
গর্ভকালীন অবস্থা
বিবি আমেনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, গর্ভকালীন আমার এমন কোন কষ্ট কিংবা বেদনা অনুভব হয়নি- যা গর্ভকালীন অন্য মেয়েরা অনুভব করে থাকে। এমনকি প্রথম ছয় মাসে আমার এতটুকু অনুভূতি ছিল না যে, আমি গর্ভবতী কিনা। শুধু এতটুকু উপলব্ধি করতে পারলাম, এ সময়ে আমার মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর জাগ্রত ও স্বপ্নে কেউ আমাকে বললেন, হে আমেনা! তোমার স্বীয় গর্ভধারণের খবর আছে? আমি আরজ করলাম, না। তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি এ উম্মতের পয়গাম্বরকে গর্ভধারণ করেছ। তখন আমি গর্ভবতী হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম।
ভূমিষ্টের সময় যখন নিকটবর্তী হলো, তখন সে শুভ সংবাদদানকারী অদৃশ্য লোক আসলেন। আমাকে বললেন, এ শব্দগুলো উচ্চারণ করে নিন- اُعِيْذُ بالصمد الواحد من شر كلّ حاسد (আমি তাঁকে অমুখাপেক্ষী একক (আল্লাহ) এর আশ্রয়ে দিচ্ছি, প্রত্যেক হিংসুকের অনিষ্টতা হতে। এ শব্দগুলো পাঠ করানোর পর আমাকে বললেন, যখন আপনার সন্তানের বেলাদত (জন্ম) হয়, তখন আপনি তাঁর নাম রাখবেন মুহাম্মদ (অতিপ্রশংসিত)।
ভূমিষ্টের পর ছয়টি মোজেযা প্রকাশ
হযরত সফিয়া বিনতে আবদুল মোত্তালিব (রাসূলে পাকের ফুফু) বলেন, আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবের রাতে তাঁর মায়ের ঘরে দাই ছিলাম। তাঁর ভূমিষ্টের সময় যে নূর তার শরীর মোবারক হতে বের হয়েছে তা চেরাগের আলো হতে অধিকতর উজ্জ্বল ছিল। সে রাতে আমি ছয়টি আলামত (অলৌকিক বিষয়) প্রত্যক্ষ করেছি- ১. যখন বাচ্চা দুনিয়াতে আসলেন তিনি সাজদা করেছেন, ২. মাথা মোবারক তুলে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- لااله الا الله انّى رسول الله , ৩. ঘরকে আমি নূরের আলোতে আলোকিত দেখেছি, ৪. আমি যখন তাঁকে ধোয়াতে চেয়েছি- অদৃশ্য হতে কোন আহ্বানকারী আমাকে বললেন, হে সফিয়া তুমি কষ্ট করিও না আমরা তাঁকে গোসল দিয়েছি, ৫. তিনি খৎনাকৃত ছিলেন এবং নাভিও কাটা ছিল, ৬. আমি যখন তাঁকে আচ্ছাদন ও মোড়াতে চেয়েছি তখন আমি তাঁর পষ্ঠদেশে নবুয়তের মোহর দেখেছি- যা দু’কাঁধের মাঝখানে ছিল, যাতে লেখা ছিল- لااله الا الله محمد رسول الله ।
উপরিউক্ত হাদীসের বর্ণনায় সফিয়া বিনতে আবদুল মোত্তালিব বলেন যে, যখন তিনি সাজদায় পড়েছেন- তখন তাঁর মুখের নিকট আমার কান নিলাম, শুনতে পেলাম তিনি উম্মতি, উম্মতি বলছেন। এখানে উল্লেখ্য, যে নবী দুনিয়াতে এসে উম্মতকে তালাশ করেছেন- তিনি কিয়ামতের ময়দানেও উম্মতকে তালাশ করবেন।
আরো একটি লক্ষ্যনীয় বিষয়, হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম দুনিয়াতে এসে انى عبد الله (আমি আল্লাহর বান্দা) বলে মাকে অপবাদ হতে মুক্ত করেছেন। আর আমাদের নবী দুনিয়াতে এসে لا اله الا الله বলে সমগ্র সৃষ্টির মালিক আল্লাহ্ তা‘আলাকে শরীক হতে মুক্ত করেছেন।
হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর মুক্তকরণ হতে আমাদের নবীজীর মুক্তকরণ বড়। আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হলো তিনি চল্লিশ বৎসর পর নবূয়ত লাভ করেছেন- তাই নয় বরং তিন যখন দুনিয়াতে এসেছেন তখনই রাসূল ছিলেন। না হয় لا اله الا الله انّى رسول الله (নিশ্চয় আমি আল্লাহর রাসূল) একথা বলা বৈধ হতো না। যে রাসূল নয়, সে নিজেকে রাসূল দাবী করতে পারে না।
হালিমা (রাদ্বি.)’র বাহন দ্রুতগামী হওয়া
এতিম শিশু সন্তান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে ধাত্রী হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যখন নিজ ঘরের দিকে রওনা হলেন, তখন বাহন (গাধা) অত্যন্ত দ্রুতগামী হয়ে গেল। অপর ধাত্রীদের বাহন অতিক্রম করে বনু সা’দের আগে চলে যাচ্ছিলো। তখন বনু সা’দের অপর ধাত্রীরা তাঁকে বলতে লাগল, হে হালিমা! তুমি তোমার বাহনের (গাধার) লাগাম টেনে ধর, যাতে আগে না যায়- যেন আমরা তোমার সাথে যেতে পারি। তারা প্রশ্ন করল, হে হালিমা! এটা কী সে গাধা নয় যা মক্কায় যাওয়ার সময় দুর্বলতার কারণে চলতেও পারছিল না? বরং সকল বাহনের পিছে ছিল? তখন তিনি বললেন, আমি তাদেরকে উত্তর দিলাম হ্যাঁ, এটি সে বাহন যা মক্কায় যেতে দুর্বলতার কারণে সকল বাহনের পেছনে ছিল। তখন তারা উত্তর দিল, এখানে কোন রহস্য রয়েছে। এ গাধার শান অনেক বড়।
গাধার ঘোষণা
হযরত হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি শুনলাম, আমার গাধা স্পষ্ট ভাষায় বলছে, ‘‘আল্লাহর শপথ, আমার শান বড়। আমি এখন জিন্দা হয়ে গিয়েছি। আমি শক্তি পেয়েছি। হে বনী সা’দের মেয়েরা! তোমরা কী জান না? আমি কাকে আমার পিঠে উঠিয়েছি? ‘‘আমি তো-حامل رسول رب العالمين রাব্বুল আলামীন (বিশ্ব জগতের প্রভু) এর রাসূলকে বহনকারী।’’ হযরত হালিমা বলেন, আমি পথিমধ্যে রাস্তার দু’পাশে ও মরুভূমি হতে এ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কোনো ব্যক্তি আমাকে বলছেন, হে হালিমা পরিশেষে তুমি তো ধনী হয়ে গিয়েছ এবং বনী সা’দের মেয়েদের মধ্যে অনেক বড় বুযুর্গ হয়ে গেছ। এরপর আমি এক ছাগলের পালের পাশ দিয়ে চললাম। প্রত্যেক ছাগল এক এক করে সকলেই আমার কাছে আসল এবং বলতে ছিল, হালিমা তুমি কী জান তোমার দুধপানকারী কে? তিনি হচ্ছেন আসমান জমিনের স্রষ্টার রাসূল এবং বনী আদমের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
বরকতময় হলো বিবি হালিমার ঘর
বিবি হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘‘আমাদের অঞ্চলে তখন দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল। কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে আমার পালিত পুত্রের বরকতে আমাদের কোন অভাব রইল না। অন্যদের মেষ ও ছাগলের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল খাদ্যের অভাবে। কিন্তু আমাদের মেষ ও ছাগল দিনের শেষে ঘরে ফিরে আসতো দুধভর্তি স্তন নিয়ে। আমরা সে দুধে সকলে পরিতৃপ্ত হতাম। এভাবে আমাদের অভাব দূর হয়ে গেল। আমার স্বামী এ অবস্থা দেখে বলতেন, ‘‘হালিমা আমাদের এ সন্তান ভবিষ্যতে মহামানব হবেন।’’ হযরত হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা আরো বলেন, যে রাতে এ শিশু ঘরে এনেছি সে রাতে আমার দুর্বল উটনী যা কোন ধরনের তদবির ও কুশল করার পরও এক ফোঁটা দুধ দিতো না- সে উটনী এত বিপুল পরিমাণ দুধ দিল যে, গোটা পাত্র ভর্তি হয়ে গেল।
ছায়া দিত মেঘ মালা
বিবি হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর মেয়ে শায়মা বলেন, আমি কোরাইশী ভাইকে নিয়ে মেষ চড়াতে গেলে দেখতে পেতাম মরুভুমির প্রখর রোদে এক খণ্ড মেঘ তাঁকে ছায়া দিত এবং তাঁর সাথে সাথে ঘুরে বেড়াত। যত দিন তিনি আমাদের প্রতিপালনে ছিলেন, ততদিনই এরূপ অবস্থা ছিল।
দুধপানকালে ইনসাফ
বিবি হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘‘প্রথম দিন শিশু নবীকে চুমু খেয়ে তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে ডান স্তনের দুধ পান করতে দিলাম। শিশু নবী তৃপ্তি সহকারে দুধপান করলেন। অতঃপর বাম স্তন থেকে দুধ পান করাতে গেলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন। দুধপানকালীন পূর্ণ সময়ে শিশু নবীর এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। তখন আমার কোলে আমার আপন শিশু আবদুল্লাহ্ (তাঁর দুধশরীক ভাই) ছিলো। এ শিশুর এ ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা দেখে আমি অভিভূত হতাম।
ক্বোরআন শরীফ নাযিলের পূর্বে বিধান বাস্তবায়ন
বিবি হালিমার ঘরে নবীজী ২৩ মাস ১৩ দিন পর দুধ পান বন্ধ করে দেন। ২৪ মাস পর্যন্ত দুধ পান করা ক্বোরআনের বিধান। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী ক্বোরআন নাযিলের বহু পূর্বেই ক্বোরআনের বিধান বাস্তবায়ন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৭ দিন হযরত হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা গ্রহণের পূর্বে অতিবাহিত হয়।
বক্ষ বিদারণ
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মোট চার বার বক্ষবিদারণ হয়। ১. হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার ঘরে অবস্থানকালে চার বছর বয়সে, ২. দশ বছর বয়সে, ৩. হেরাপর্বতের গুহায় জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম এর সাথে কথোপকথনের সময় এবং ৪. মিরাজের রাতে। প্রথম বক্ষ বিদারণের বিবরণ- একদিন শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুধ ভাই ও অন্যান্য বালকদের সাথে মাঠে মেষ চরাতে গিয়েছিলেন। এ সময় সাদা কাপড় পরিহিত দু’জন লোক এসে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে ধরে একটু আড়ালে নিয়ে যান। তাঁকে চিৎ করে শুইয়ে তাঁর বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করে একটি সোনার থালায় রেখে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করেন।
এ প্রসঙ্গে খাদেমে রাসূল হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের বুকে সেলাইয়ের চিহ্ন দেখতে পেতাম।
শয়তান নবীজীর আকৃতি ধারণ করতে পারে না
স্বপ্ন দু’প্রকার। কিছু স্বপ্ন আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে আর কিছু স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে। নবীগণের সকল স্বপ্ন আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে। এগুলো অহী ও সত্য। সাধারণ মানুষ তথা গায়রে নবীর ভাল স্বপ্ন আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে এবং খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে। সাধারণ মু’মিনের ভাল স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের একভাগ। তাই কোন ব্যক্তি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলে তিনি বাস্তবেই তাঁকে দেখেছেন কেননা শয়তান রাসূলে পাকের আকৃতি ধারণ করতে পারে না। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-من رانى فى المنام فقد رانى فان الشيطان لايتمثل فى صورتى-
অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখল, সে অবশ্যই আমাকে দেখল, কেননা শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি স্বপ্নে দেখবে অচিরেই সে আমাকে জাগ্রত অবস্থায় দেখতে পাবে।
নবীজীর রক্ত পবিত্র ও হালাল
কুদুরী কিতাবের বর্ণনা মোতাবেক রক্ত, প্রস্রাব-পায়খানা ও মদ অপবিত্র। এক দেরহাম কিংবা তা থেকে নাপাকির পরিমাণ কম হলে ওটা সহকারে নামায পড়া জায়েয। তবে এক দেরহাম থেকে বেশি হলে তা সহকারে নামায পড়া জায়েয নয়। এবং যা নাপাক তা হারাম। কিন্তু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের রক্ত মোবারক পাক ও হালাল। যেমন উহুদযুদ্ধে নবীজীর মুখের নিন্মপাটির সম্মুখ ভাগের দু’টি দাঁত মোবারকের কিয়দাংশ শহীদ হয়ে গেল। যখন নবীজীর মুখ মোবারক হতে রক্ত বয়ে যাচ্ছিল, তখন আবু সায়ীদ খুদরীর পিতা হযরত মালিক বিন সিনান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জখম হওয়া স্থানে মুখ লাগিয়ে খুন মোবারক চুষে পান করে ফেলেন, তা জমিতে পড়তে দেননি। তাঁর এ ভালোবাসা দেখে নবীজী এরশাদ করলেন-من مس دمى دمه لم تصبه النار-
অর্থাৎ আমার রক্ত যার রক্তের সাথে মিশেছে তাকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না।
প্রস্রাব মোবারকও হালাল
হযরত উম্মে আয়মন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রাতে ঘরের পাশে একটি মাটির পাত্রের দিকে গেলেন। এতে প্রস্রাব করলেন। রাবীয়া (বর্ণনাকারীনী উম্মে আয়মন) বলেন, আমি রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম এবং আমি তৃষ্ণার্ত হলাম। আমি পাত্র থেকে পানি পান করলাম। এমতাবস্থায় আমি তা উপলব্ধি করতে পারিনি। যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রভাত করলেন, তখন তিনি বললেন, হে উম্মে আয়মন! তুমি এ পাত্রের দিকে যাও। অতঃপর এতে যা আছে তা ঢেলে দাও। আমি আরজ করলাম, আল্লাহর শপথ, এতে যা ছিল তা আমি পান করেছি। (উম্মে আয়মন হতে যিনি বর্ণনা করেছেন) তিনি বলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হেসে দেন। এতে তাঁর (নবীজীর) সম্মুখের দাঁত প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি (নবীজী) বলেন- انّك لا يَفْجَعُ بطنك بعدها নিশ্চয় এরপর কখনো তোমার পেঠ ব্যথা করবে না।
নবীজীর প্রতিটি বাণী ওহী
নবীজীর প্রতিটি বাণী ওহী। যেমন আল্লাহ্ তাঁর শানে বলেন-
وما ينطق عن الهوى ان هو الاوحى يوحى-
অর্থ: তিনি (নবীজী) নিজের প্রবৃত্তি থেকে বলেন না, উহা (যা বলেন তা) নয়। তবে এমন ওহী যা তার প্রতি নাযিল করা হয়।
এ ওহী দু’প্রকার। জলী ও খফী। জলী (প্রকাশ্য) ওহী হলো ক্বোরআনুল করীম এবং খফী (অপ্রকাশ্য) ওহী হলো হাদীস শরীফ। ক্বোরআনুল করীমের শব্দ ও অর্থ উভয় আল্লাহর পক্ষ হতে জিবরাঈল আলায়হিস সালামের মাধ্যমে পঠিত অবস্থায় নবীজীর প্রতি অবতীর্ণ হয়। হাদীস শরীফ শব্দ ও জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম ব্যতীত সরাসরি নবীজীর অন্তরে অবতীর্ণ হয়। অতএব, নবীজীর বাণী হয়তো ক্বোরআন অথবা হাদীস থেকে।
নবীজীর বিবাহের বিধান
আমাদের জন্য চারের অধিক বিবাহ্ করা জায়েয নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
فانكحوا ما طاب لكم من النساء مثنى وثلاث ورباع-
অর্থাৎ তোমরা মহিলাদের থেকে তোমাদের পছন্দ অনুযায়ী দু’জন অথবা তিন জন অথবা চারজন বিবাহ্ কর। কিন্তু আমাদের নবীজীর (নূর নবী কিতাবের উল্লেখ অনুযায়ী) ১২ (বার) জন সহধর্মিণী ছিলেন। যাঁরা আমরা ঈমাদারদের সম্মানিত মাতা। এ বিবিগণের কাউকে বিবাহ্ করা উম্মতের জন্য জায়েয ছিল না। কোন উম্মত মারা গেলে তাঁর স্ত্রীকে অপর মু’মিন বিয়ে করতে পারে। কিন্তু পিতার ইন্তেকালের পর যেমন পিতার স্ত্রীকে পুত্র বিবাহ্ করতে পারে না, অনুরূপ নবীজীর স্ত্রীগণ ঈমানদারদের মাতা। তাঁদেরকে বিবাহ্ করাও জায়েয নেই।
নবীজী ঘুমালে অজু ভাঙ্গে না
ঈমানদার অজু করে ঘুমালে অর্থাৎ এতটুকু নিদ্রা আসলে যে কোন কিছুর সাথে হেলান দিয়ে ঘুমালে যদি সে জিনিসটা সরিয়ে ফেললে লোকটা পড়ে যায়- তাহলে অজু ভেঙ্গে যাবে। কেননা মু’মিনের শরীরের সাথে সাথে তার ক্বলবও ঘুমিয়ে পড়ে, তার কোন অনুভূতি থাকে না-
এমতাবস্থায় পায়খানার রাস্তা দিয়ে বায়ু বের হওয়ার আশংকা আছে- যা সে মু’মিন টের পায় না। তাই শরীয়ত ফায়সালা দিয়েছে- ততটুকু ঘুম এলে অজু ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু নবীজী ঘুমালেও অজু ভাঙ্গত না। কেননা নবীজীর শরীর মোবারক ঘুমালেও ক্বলব জাগ্রত। তাই শরীয়ত বলেছে ঘুমালেও নবীজীর অজু ভাঙ্গে না।
তিনিই সকল জ্ঞানের সমুদ্র
দুনিয়াতে আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোন শিক্ষক নেই বরং তিনিই সকলের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- الرحمن علّم القران (রাহমান তথা আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন শিক্ষা দিয়েছেন।) এখানে কর্ম উহ্য। কর্ম হলো নবীজী। সুতরাং যাঁর শিক্ষক অসীম ইলমের মালিক আল্লাহ্ তা‘আলা, তাঁর ইলমও অসীম। সেই জন্যই আল্লামা শারফুদ্দীন বুসিরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
وكلهم من رسول الله ملتمس غرقا من البحر او رشفًا من الديم-
(নবী-রাসূলগণের প্রত্যেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে ইলমের সমুদ্রের এক অঞ্জলি অথবা মুষলধারে বৃষ্টির এক ফোঁটা তালাশকারী।
তথ্যসূত্র:
ক্বোরআনুল করীম, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মেশকাত শরীফ, নুগামায়ে হাবীব, মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া, মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, ফাতওয়ায়ে নঈমিয়া, معارج النبوة, নূর নবী, বেদায়া-নেহায়া, আন্ নবুয়ত ওয়াল আম্বিয়া, اصح السير, مختصر القدورى ইত্যাদি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম।