= শানে রিসালত –
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান =
ক্বিয়াম-ই তা’যীমী জায়েয
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
إِنَّآ أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ـ لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
তরজমা:
৭. নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি ‘হাযির-নাযির’ করে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে;
৮. যাতে হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান আনো এবং রসূলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। [সূরা ফাত্হ: আয়াত-৭ ও ৮, কানযুল ঈমান]
এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর সুস্পষ্ট প্রশংসা। এ আয়াতে হুযূর-ই আক্রামের বহু প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে। আর মুসলমানদেরকে ওই দরবারের প্রতি তা’যীম সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শা-হিদান (شَاهِدًا)-এর অর্থ হাযির এবং প্রত্যক্ষকারীও হতে পারে। হয়তো সমগ্র বিশ্বকে প্রত্যক্ষকারী অথবা মি’রাজে জান্নাত ও দোযখ এবং লওহ ও কলম প্রত্যক্ষকারী; সমস্ত সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধকারী অথবা সাক্ষী; অথবা (শা-হিদ) মানে মাহবূব।
হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, اَشْهَدُ اَنْ لاَّ اِلهَ اِلاَّ اللهُ [আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বূদ (উপাস্য) নেই।] এ’তে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সবার থেকে ‘উলূহিয়্যাৎ’ (উপাস্য হওয়া)কে অস্বীকার করার উপর সাক্ষ্য রয়েছে। বস্তুত হুযূর-ই আক্রামের সাক্ষ্যই পরিপূর্ণ; যেহেতু তা স্বচক্ষে দেখা, শোনার ভিত্তিতে নয়। হাঁ, বাচক (কোন কিছু আছে বলে) সাক্ষ্য দেওয়া সহজ; কিন্তু না বাচক (কোন কিছু নেই বলে) সাক্ষ্য দেওয়া কঠিন। যেমন কেউ বললো, ‘‘অমুক পংক্তিটা ‘গুলিস্তাঁ’ কিতাবে আছে।’’ সে ওই পংক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করতে পারবে; কিন্তু একথা বলা, ‘‘অমুক চরণটি গুলিস্তাঁ’ কিতাবে নেই’’ অত্যন্ত কঠিন। একথা সে-ই বলতে পারে, যার দৃষ্টি সমগ্র ‘গুলিস্তা’ কিতাবের উপর বুলানো হয়েছে। অনুরূপ ‘লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু-এর সাক্ষ্য স্বচক্ষে দেখে তিনিই দিতে পারেন, যিনি ‘প্রথম’ থেকে ‘শেষ’ পর্যন্ত সব কিছু সম্পর্কে জানেন এবং প্রতিটি অণু-পরমাণু যাচাই করে নিয়েছেন। তারপর বলেছেন, ‘‘আমি সব কিছু যাচাই করে নিয়েছি আর দেখেছি, আল্লাহ ছাড়া কোন খোদা নেই। শাহিদ (شاهد) শব্দের পূর্ণাঙ্গ তাফসীর ‘সূরা আযহাব’-এ আয়াত ‘ইন্না—আর সালনা-কা শা-হিদান)-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ আয়াতে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- ‘তোমরা আমার মাহবূবের প্রতি তা’যীম বা সম্মান প্রদর্শন করো।’ এখানে অবশ্য কোন প্রকার তা’যীমের শর্তারোপ করা হয়নি; বরং যেসব তা’যীম শরীয়ত হারাম করেছে, (যেমন- তা’যীমী সাজদাহ্ করা, তা’যীমী রুকূ’ ইত্যাদি), ব্যতীত যে তা’যীম তোমাদের পক্ষে সম্ভব হয়, তোমরা করো! কথা বলার সময় তাঁকে সম্মান করো, তাঁর নাম শরীফ সম্মানের সাথে নাও। তাঁকে ‘আল্লাহ্’ কিংবা ‘আল্লাহর পুত্র’ বলোনা, অবশিষ্ট যত শব্দ সম্মানের পাবে, সবই বলতে পারো। তাঁর প্রতিটি বস্তুর সম্মান করো, তাঁর চুল মুবারক নিয়ে চুমু খাও, তাঁর পোশাকের, পাদুকাযুগল শরীফের, তাঁর লিখিত নামের এবং তাঁর পবিত্র শহরের, মোটকথা যার সাথে তার সম্পর্ক হয়, সেটারই তা’যীম করো। অনুরূপ, নিজের হাত-পা ইত্যাদি দ্বারা, নিজের প্রতি নড়াচড়ায় তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো।
এমনকি সম্মানিত ফক্বীহগণ বলেছেন, যখন হুযূর-ই আক্রামের রওযা শরীফে সালাম দেওয়ার জন্য হাযির হও, তখন হাত বেঁধে তেমনিভাবে দন্ডায়মান হও, যেমন নামাযে দন্ডায়মান হও।
[দেখুন, ফাতাওয়া-ই আলমগীরী; বাবু যিয়ারতে ক্ববরিন্ নবিয়্যি: কিতাবুল হাজ্ব]
অনুরূপ, তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য দন্ডায়মান হওয়া, তাঁর বরকতময় হাতে পায়ে চুমু খাওয়া, যেমনটি সাহাবা-ই কেরামের নিয়ম ছিলো, মুস্তাহাব।
[দেখুন, মিশকাত শরীফ: কিতাবুল আদব: বাবুল ক্বিয়াম এবং বাবুল মুসাহাফাহ্ ওয়াল মু‘আনাক্বাহ্]
যেসব হাদীসে সম্মানার্থে দাঁড়াতে নিষেধ করা হয়েছে, তা হচ্ছে ওই দন্ডায়মান হওয়া, যা এমনি যে, বড় লোকটি উপবিষ্ট থাকবে, আর চতুর্দিকে লোকেরা তার সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবে। এজন্য এরশাদ হয়েছে- لاَ تَقُوْمُوْا كَمَا تَقُوْمُ الْاَعَاجِمُ (তোমরা তেমনিভাবে দাঁড়িয়োনা, যেমনভাবে দাঁড়ায় অনারবীয় লোকেরা।) এর অতি উত্তম গবেষণাবলব্ধ^ আলোচনা করা হয়েছে ‘জা-আল হাক্বক্বু ওয়া যাহাক্বাল বাত্বিল’ নামক কিতাবে।
ওযূর পানি দাঁড়িয়ে পান করো, ঝমঝম কূপের পানি দাঁড়িয়ে পান করো।
হযরত সা’দ ইবনে মু‘আয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর-ই আক্রামের মজলিস শরীফে আসলেন। তখন হুযূর-ই আক্রাম আনসারীদের উদ্দেশে এরশাদ করলেন, ‘‘তোমরা তোমাদের সর্দারের তা’যীমের জন্য দাঁড়িয়ে যাও!’’ মোটকথা, তা’যীমী ক্বিয়াম জায়েয এবং ‘সুন্নাহ্’ দ্বারা প্রমাণিত। অনুরূপ, মীলাদ-মাহফিল করা এবং তাতে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের উল্লেখ করে দাঁড়ানোও হুযূর-ই আক্রাম আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর প্রতি সম্মান দেখানোর সামিল। শরীয়তসম্মতভাবে, যা যে কোন প্রকারের তা’যীম করা হোক, জায়েয। এর পক্ষে কোন প্রমাণ পেশ করারও প্রয়োজন নেই।
হযরত ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মদীনা শরীফে কখনো ঘোড়ার উপর আরোহণ করতেন না এবং মদীনা শরীফের সীমানার অভ্যন্তরে কোন কোন হযরত তো পায়খানা করার জন্য বসতেন না, এ সম্মানের পক্ষে তো কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, না সাহাবা-ই কেরাম থেকে, না তাবে’ঈদের থেকে; কিন্তু ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অন্তরের অনুপ্রেরণা রয়েছে, অথচ কেউই তা করতে তাঁকে নিষেধ করেনি। এ আয়াতে যেহেতু ইয্যাত ও সম্মান প্রদর্শন শর্তহীন (مطلق), সেহেতু এ’তে কোন প্রকারের শর্তারোপ করা ভুল হবে।
‘তাফসীর-ই রূহুল বয়ান’ প্রণেতা মহোদয় আয়াত مَاكَانَ مُحَمَّدٌ اَبَا اَحَدٍ -এর তাফসীর প্রসঙ্গে লিখেছেন, আয়াযের পুত্রের নাম ছিলো ‘মুহাম্মদ’। সুলতান তার নাম অতি আদব সহকারে উচ্চারণ করে তাকে ডাকতেন। একবার তিনি বললেন, ‘‘হে আয়াযের পুত্র! এখানে এসো।’’ আয়ায আরয করলো, ‘‘আজ (আমার পুত্রের) কি ত্রুটি হলো, আপনি তার নাম নিলেন না?’’
তিনি বললেন, ‘‘আমি তখন ওযূ বিহীন ছিলাম। আমি তার নাম ওযূবিহীন অবস্থায় নিইনা।’’ কবির ভাষায়-
هزار باربشويم دهن به مشك وگلاب ـ هنوزنام تو گفتن كمال بےادبى است
অর্থ: প্রথমে আমাদের মুখটি হাজার বার মিশক ও গোলাবের পানি দিয়ে ধুইয়ে নিয়ে তারপর, হে আল্লাহর রসূল, আপনার নাম ওই মুখে উচ্চারণ করাও পূর্ণাঙ্গ বে-আদবীর সামিল।
বলুন, এ সম্মান প্রদর্শনের পক্ষে প্রমাণ কোথায়? (প্রয়োজনও নেই।)
অনুরূপ, মীলাদ শরীফের মাহফিল করাও হচ্ছে রসূলে আক্রামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার নামান্তর। মীলাদ শরীফ উদযাপনের পক্ষেও অতি উৎকৃষ্ট গবেষণালব্ধ আলোচনা এবং এর পক্ষে ক্বোরআনের আয়াতসমূহ বহু হাদীস শরীফ, ইজমা’-ই উম্মত এবং নবীগণের আমল ‘জা-আল হক্ব’ শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাসআলাঃ হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ‘ঈমান’-এর অঙ্গ। তাঁর পাদুকাযুগল শরীফের প্রতি অসম্মান করাও কুফর।