বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, মিসাইল ইত্যাদি আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরী করা ইসলামী শরীয়ত সমর্থন করে কিনা?

0

সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, ছাত্র, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

প্রশ্নঃ বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমানের জন্য এটম বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র, মিসাইল ইত্যাদি আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরী করা ইসলামী শরীয়ত কতটুকু সমর্থন করে। কোরআন-হাদীসের আলোকে জানালে ধন্য হবো।

উত্তরঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ দু’টি শক্তি সৃষ্টি করেছেন। আকিদা ও আমলের দিক দিয়েও মানুষ ভাল ও মন্দ এ দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত। তেমনিভাবে এ পৃথিবীতে মানুষ কাফির ও মুসলমান এ দু’জাতি সত্তায় বিভক্ত। এ দু’টি জাতিই পৃথিবীব্যাপী আবাদ রয়েছে। এ ছাড়াও তৃতীয় আরেক জাতি রয়েছে, তারা হল মুনাফিক সম্প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক কাফির জনগোষ্ঠির পক্ষ হয়ে কাজ করে থাকে। তারা মুসলমানদের ঘরের শত্রু।

মহান স্রষ্টা আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্র কোরআনে মুসলিম সম্প্রদায়কে কাফির, মুশরিক এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে সর্বচেষ্টা-পন্থায় ‘জিহাদ’ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সৃষ্টির প্রারম্ভ কাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের এ নির্দেশ সর্বদা বলবৎ ছিল, এখনো আছে। মুসলমানদের উপর জিহাদ করা কিয়ামত পর্যন্ত ফরজে কিফায়া। কোন সময়ের জন্য জিহাদ থেকে বিমুখ হওয়া যাবে না। এমনকি অনেক সময় অন্যান্য ফরজ কার্যাদি থেকে জিহাদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। এমনকি প্রিয় নবী এবং সাহাবায়ে কেরামের খন্দকের যুদ্ধের সময় জিহাদের কারণে চার ওয়াক্ত নামায কাজা করতে হয়েছিল। জিহাদের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন-

قل ان کان اباؤکم وابنائکم واخوانکم وازواجکم وعشیرتکم واموال اقترفتموھا وتجارۃ تخشون کسادھا ومسٰکن ترضونھا احب الیکم من اللہ ورسولہٖ وجھاد فی سبیلہ فتربصوا حتی یاتی اللہ بامرہٖ واللہ لایھدی القوم الفٰسقین (سورۃ التوبہ ۲۴)

অর্থাৎ হে রসূল! আপনি আপনার উম্মতদের বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ওই ব্যবসা-বাণিজ্য যার ক্ষতি হবার তোমরা আশঙ্কা কর এবং তোমাদের পছন্দের বাসস্থান এ সব বস্তু আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা তোমাদের নিকট প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্‌ তাঁর নির্দেশ (শাস্তি) প্রদান করা পর্যন্ত। আর আল্লাহ্‌ ফাসিকদেরকে সৎপথ প্রদান করেন্‌ না। -(সূরা তাওবা, ২৪ আয়াত)

এ আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহ্‌ তা’আলা তাঁর প্রিয় রসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার প্রেরণা ও ভালবাসা পাথির্ব সকল বস্তু বিষয়ের ভালবাসা অপেক্ষা বেশি হতে হবে। অন্যথায় আল্লাহর শাস্তির অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। আর শাস্তিরও কোন সুনির্দিষ্ট করে বলে দেয়নি। তাই শাস্তির ধরণ ও প্রকৃতি এও হতে পারে যে, শত্রুর মোকাবেলা করা আমরা ছেড়ে দেব আর হাত-পা বেঁধে কাফিররা মুসলিম বিশ্বের মুসলমানগণকে তাদের নতজানু করে রাখবে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের এ করুণ অবস্থা মুসলমানদের অলসতার কারণে আল্লাহর শাস্তি নয় কি? আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের মুহাব্বত এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকে বিমুখ হওয়ার পরিণতি নয় কি?

শত্রুর মোকাবেলায় শত্রুর চেয়ে উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ‌উচিত এবং ইসলামের শিক্ষাঃ

আল্লাহ্‌ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করছেন-وَاعِدُّوْا لَھُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّۃٍٍ وَّ مِنْ رباط الخَیْل ترھبون بِہٖ عدُوا اللّٰہ وعدوّکم (سورۃ انفال، ۶۰)

 অর্থাৎ আর তাদের (মোকাবেলার) জন্য প্রস্তুত রাখো তোমাদের সামর্থ ও শক্তি অনুযায়ী এবং প্রচুর সংখ্যক ঘোড়া লালন-পালন কর যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু এবং তোমাদের শত্রুদের ভীতি প্রদর্শন করবে।-সূরা আনফাল, ৬০

উপরোক্ত আয়াতে জিহাদের উপকরণ অর্থাৎ অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা রেখে মুসলমানদেরকে সমরাস্ত্রে সজ্জিত থাকারও নির্দেশ করা হয়েছে যাতে কেউ শুধুমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে অস্ত্র ছাড়া বসে না থাকে। কারণ, আল্লাহ্‌ তাজ্ঞআলা এসব উপকরণের মধ্যেও অনেক প্রভাব রেখেছেন। সে সব প্রভাব শক্তিকে নিজেদের কাজে লাগানোর জন্য নির্দেশ করা হয়েছে।

আলোচ্য আয়াতে কোন নির্দিষ্ট অস্ত্রের কথা বলা হয়নি বরং ‘শক্তি’ (কুওয়্যাত) সঞ্চার করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। সুতরাং যে সব শক্তি যুদ্ধের মধ্যে কাজে আসবে সব ধরনের শক্তিকেই ‘কুওয়্যাত’ বলা হয়। যেমন, ইমাম বায়দ্বাভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি قُوَّةٌ (কুওয়্যাত) শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, كل ما يتقوى به فى الحرب অর্থাৎ ‘শক্তি’ হল প্রত্যেক সে সব বস্তু যা দ্বারা যুদ্ধ ও রণাঙ্গনে শক্তি অর্জন করা যায়।

ইমাম আবূ জাস্‌সাস রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘আহকামে কোরআন قوة (শক্তি) শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, عموم اللفظ شامل لجمیع مایستعن بہ علی العدو من سائر الانواع السلاح وآلات الحرب   অর্থাৎ قوة শব্দটা সাধারণভাবে বলাতে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক ওই সব অস্ত্রশস্ত্র (আধুনিক ও পুরাতন) যা দ্বারা যুদ্ধে শক্তি অর্জন করা সম্ভব হয়।

হুজূর আন্‌ওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলোচ্য আয়াত তিলাওয়াত করে এরশাদ করেছেন

اعدوا لھم ما استطعتم من قوۃ الا انّ القوّۃ الرمی الا ان القوۃ الرمی الا ان القوۃ الرمی (ابو داؤد، کتاب الجھاد باب الرمی)

অর্থাৎ হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন তাদের জন্য প্রস্তুত রেখো যে শক্তি তোমাদের মধ্যে রয়েছে। সাবধান! শক্তি হল শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করা, সাবধান! শক্তি হল, শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করা, সাবধান! শক্তি হল শত্রুর প্রতি নিক্ষেপ করা। -(আবু দাঊদ, কিতাবুল জিহাদ)

এখানে গায়েবের সংবাদদাতা নবী হুজূর আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘শক্তি’ বলতে নিক্ষেপ করাকে নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক নিক্ষিপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, বোমা-বারুদ ইত্যাদি যা কিয়ামত পর্যন্ত আবিষ্কার হবে তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

এ আয়াত ও তাফসীর এবং হাদীসের আলোকে বুঝা গেল যে, শত্রু তথা কাফির-মুশরিক ও ইয়াহুদী-নাসারা এবং মুনাফিক ইত্যাদির মোকাবেলায় বর্তমান যুগের প্রত্যেক আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র অর্জন করা মুসলমানের উপর একান্ত কর্তব্য। সূরা আনফালে বর্ণিত এ সব শক্তি প্রস্তুত রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য হল শত্রুর মনে ভয় সৃষ্টি করা। আর ভয় সৃষ্টি তখনই হবে যখন শত্রুর মোকাবেলায় ভারী ও শক্তিশালী সমরাস্ত্রের মালিক হওয়া যাবে। তাই কাফির মুশরিকগণকে সর্বদা মুসলমানদের আনুগত্যে রাখার জন্য তাদের চেয়ে উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুসলমান নেতৃবৃন্দ ও বৈজ্ঞানিকদের উপর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে একান্ত দায়িত্ব। উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক যুগে যুগে খোদাদ্রোহী ও নবী-দ্রোহীরা যে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র ঈমানদারদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, নবীগণের ঈমানদার উম্মতগণ উক্ত সময়ের অস্ত্র-শস্ত্রের মাধ্যমে শত্রুকে প্রতিহত করেছেন এবং আল্লাহর দ্বীন কায়েম করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় সাহাবায়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রত্যক্ষ নির্দেশে আল্লাহর রসূলের দুশমনের মোকাবেলায় তৎকালীন সমরাস্ত্র তীর, বল্লম, নেযা, বর্শা, তলোয়ার ইত্যাদি জিহাদের ময়দানে ব্যবহার করেছেন এবং শত্রুকে প্রতিহত করেছেন। বদর, ওহুদ, হুনাইন, তবুক, ইয়ারমুক ইত্যাদি যুদ্ধসমূহ ইসলামের ইতিহাসে তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। সুতরাং বর্তমান আধুনিক বিশ্বে শত্রুর মোকাবেলায় আধুনিক মারণাস্ত্রসমূহ এটম বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র বিভিন্ন প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ইত্যাদির প্রয়োগ ও ব্যবহার মুসলিম মুজাহিদদের একান্তই জরুরী। আদি যুগের তীর-বল্লম-তলোয়ার নিয়ে বসে থাকলে শত্রুর মোকাবেলা করা মোটেই সম্ভবপর নয়, বরং শত্রুরা আধুনিক শক্তিশালী মারণাস্ত্র দিয়ে মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে সহজেই। তাই আল্লাহ্‌-রসূলের দুশমনদের বিরুদ্ধে কুফর ও তাগুতী শক্তির মোকাবেলায় জিহাদের নিয়্যতে মুসলিম রাষ্ট্রনায়কগণ বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রসহ আধুনিক মারণাস্ত্র প্রস্তুত করা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা এবং মুজাহিদীন-ই ইসলাম কর্তৃক শত্রুর মোকাবেলায় তা প্রয়োগ করা মোটেই ইসলাম পরিপন্থী নয়, বরং কোরআন-সুন্নাহ্‌ মোতাবেক অবশ্যই জরুরী। এটাই ইসলামী শরীয়তের চূড়ান্ত ফায়সালা। তবে এ সমস্ত মারণাস্ত্রের সাহায্যে এক মুসলিম রাষ্ট্র আরেক মুসলিম রাষ্ট্রকে বা এক মুসলিম অপর মুসলমানকে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ধ্বংস করা, ঘায়েল করা বা ক্ষতিগ্রস্ত করা অবশ্যই জঘণ্যতম জুলুম ও নিন্দনীয় অপরাধ। যা ইসলামের দৃষ্টিকোণে অবশ্যই হারাম ও বর্জনীয়।

[সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ. 17-19]

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •