এ উপমহাদেশে অসাধারণ বেলায়তী শক্তি, দ্বীনী বিষয়াদিতে গভীর ইল্ম বা জ্ঞান, ওই ইল্ম অনুসারে অকৃত্রিম আমল, দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে অস্বাভাবিক আন্তরিকতা, বিশুদ্ধ আক্বাইদ পোষণ, বাতিল আক্বীদাগুলোর মূলোৎপাটনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, দ্বীনের বিশুদ্ধতার সংরক্ষণের জন্য সাচ্চা আলিম তৈরির অব্যর্থ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সমাজের সর্বস্তরে সুন্নিয়াতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ যত আউলিয়া-মাশাইখের শুভ পদার্পণ ঘটেছে তাঁদের মধ্যে শাহানশাহ্ -ই সিরিকোট হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা ও আমলের সংরক্ষণ এবং দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে তাঁর ঐতিহাসিক অবদানগুলোর সুফল ও সুদূর প্রসারী ফলশ্র“তির যথাযথ মূল্যায়ন করতে গেলে আজ একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, বিশেষত এদেশে শাহানশাহ-ই সিরিকোট হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটির শুভাগমন না ঘটলে হয়তো এ দেশের মুসলিম সমাজে শরীয়ত, ত্বরীক্বত ও সুন্নিয়াতের ইতিহাসে এক দুঃখজনক অধ্যায় রচিত হতো। দ্বীন-ইসলামের মৌলিক নিষ্কলুষ আদর্শ, শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের প্রকৃত শিক্ষা ও দীক্ষার মাধ্যমে মুসলিম সমাজকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের ভালবাসার মজবুত ও অটুট রশিতে গ্রথিত রাখার ক্ষেত্রে যেই বেলায়তী শক্তিসমৃদ্ধ সৎ সাহস, দূরদর্শিতা ও অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার দরকার, তা-ই তিনি যথাযথভাবে প্রয়োগ করেছেন। এ কারণে আজ মুসলিম সমাজ, বিশেষ করে সুন্নী-সমাজ আল্লাহ্ ও রসূল এবং এ মহান ওলীর প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। এসব ক্ষেত্রে তিনি এ দেশে চিরদিন এক অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
ইল্মে তাসাওফের মূলনীতিগুলোর নিরিখে শাহানশাহে সিরিকোট ছিলেন একজন বরহক মুর্শিদ এবং অতি উচ্চ পর্যায়ের ওলী। ইমামে আহলে সুন্নাত, আ’লা হযরত শাহ্ মুহাম্মদ আহমদ রেযা ফাযেলে বেরলভীর অমূল্য ‘ইরশাদ’ অনুসারে, পীরে কামিল ও মুরশিদে বরহক্ব হলেন তিনিই যাঁর মধ্যে চারটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান-১. বিশুদ্ধ সুন্নী আক্বিদা পোষণ, ২. যথেষ্ট দ্বীনী শিক্ষা ও জ্ঞান-সমৃদ্ধ হওয়া, ৩ তাক্বওয়া- পরহেযগারীর উজ্জ্বল পায়কর হওয়া এবং ৪. বিশুদ্ধ আক্বিদাসম্পন্ন কামিল ওলীগণের (মাশাইখ) মাধ্যমে ত্বরীক্বতের সিলসিলা সরাসরি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছানো। শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল্-ক্বওলুল জামীল’- এ লিখেছেন সহীহ্ মুরশিদ হলেন তিনি, যাঁর মধ্যে নিম্নলিখিত শর্তাবলী যথাযথভাবে পাওয়া যায়-
এক. ক্বোরআন-হাদীসের যথেষ্ট ইলম (জ্ঞান) এবং ফিক্বহ্-শাস্ত্রের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকাও তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে। কারণ, এসব বিষয়ের জ্ঞান, বিশেষতঃ চার মাযহাবের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও যে কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ ইত্যাদি না থাকা যেমন দূষণীয়, তেমনি মাযহাবের চার ইমামের বিরোধিতার মধ্যে পথভ্রষ্টতা অনিবার্য ও সুস্পষ্ট। তদুপরি, বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে, প্রয়োজনে মুর্শিদ তাঁর মুরিদদেরকে শরীয়তের অনুশাসনগুলো পালনের নির্দেশ দেবেন, শরীয়ত-বিরোধী কার্যকলাপে বাধা দেবেন, তাদেরকে আত্মশুদ্ধি অর্জনের দিকে পথপ্রদর্শন করবেন। মন্দ চরিত্র ও অভ্যাসগুলো বর্জন করাবেন এবং সদ্গুণাবলী অর্জনে তাদেরকে অভ্যস্ত করবেন ইত্যাদি। এসবের জন্য মুর্শিদের মধ্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান (তা ইলমে লাদুনী হোক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্জিত হোক) থাকা আবশ্যক। ইল্ম ব্যতীত এসব বিষয় সম্ভবই নয়। ‘শিফাউল আলীল’ শরহে ‘আল্ক্বাওলুল জামীল’, ‘ক্বুওয়াতুল ক্বুলূব’, ‘আওয়ারিফুল মা‘আরিফ’ ‘ইহ্য়াউল উলূম’, ‘কীমিয়া-ই সা‘আদাত’ এবং হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর লিখিত প্রসিদ্ধ কিতাব ‘ফুত্হুল গায়ব’ ও ‘গুনিয়াতুত্ব ত্বালেবীন’ ইত্যাদিতে এমনই লিপিবদ্ধ হয়েছে।
দুই. বায়‘আত গ্রহণের জন্য মুর্শিদের মধ্যে তাক্বওয়া ও আদালত (যথাক্রমে খোদাভীরুতা ও মানবিক উন্নত গুণাবলী দ্বারা সমৃদ্ধতা) থাকা ওয়াজিব (অপরিহার্য)। অর্থাৎ তিনি তো কবীরাহ্ গুনাহ্ থেকে বিরত থাকবেনই, সগীরাহ্ গুনাহ্ অনিচ্ছাসত্ত্বে বা অজ্ঞাতসারে হয়ে গেলেও সেটার উপর অবিচল না থেকে তার প্রতিকারেও সচেষ্ঠ হবেন। শাহ্ আবদুল আযীয আলায়হির রাহমাহ্ ‘আল-ক্বাওলুল জামীল’-এর হাশিয়ায় লিখেছেন, মুর্শিদের জন্য তাক্বওয়ার শর্ত এ জন্য আরোপ করা হয়েছে যে, বায়‘আতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। এটা অর্জিত হয় নেক্ কার্যাদির অনুশীলনেরই মাধ্যমে। মুর্শিদ নিজে এমন অনুশীলনে অভ্যস্ত না হয়ে শুধু মুরিদদেরকে মৌখিকভাবে সুন্দর ভাষায় হিদায়ত করলে তা প্রভাব ফেলতে পারে না। আর যারা নিছক এটাই করে থাকে, তারা বায়‘আতের হিকমত থেকে বহু দূরে। [শেফাউল ‘আলীল]
তিন. মুর্শিদ-ই কামিল দুনিয়ার মোহ্, বিলাসিতা ও উচ্চাভিলাষ মুক্ত হবেন, আখিরাতমুখী এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি সদা আগ্রহী ও উদ্গ্রীব হবেন। তিনি অপরিহার্য ইবাদত-বন্দেগীও নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত যিক্র-আয্কার ইত্যাদির সংরক্ষক ও সেগুলোর প্রতি সদা যতœবান থাকবেন। তাঁর হৃদয়-মন থাকবে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত।
চার. মুর্শিদ-ই কামিল শরীয়তের বিধানাবলী পালনের নির্দেশদাতা ও শরীয়ত বিরোধী কার্যাবলীতে বাধা প্রদানকারী হবেন। তিনি কোন বিষয়ে রায় প্রদানে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, বিবেকে পরিপূর্ণ এবং মানবিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হবেন, যাতে তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা যায়।
পাঁচ. বায়‘আত গ্রহণকারী মুর্শিদ কোন কামিল ব্যক্তির সুহবত বা সাহচর্যে রয়েছেন এমন হবেন। তিনি ওই কামিল ওলীর সাহচর্যে দীর্ঘদিন রয়ে তাঁর নিকট থেকে ত্বরীক্বতের আদাব (নিয়মাবলী) শিখে থাকবেন এবং নূরে বাত্বিন ও নূরে ঈমান হাসিল করে থাকবেন। এ শর্ত এজন্য আরোপ করা হয়েছে যে, আল্লাহর বিধিবদ্ধ নিয়ম চলে আসছে যে, সফলতাপ্রাপ্তদের দর্শন ব্যতীত সাফল্য লাভ করা যায় না, যেমন- বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ (আলিমগণ)-এর সাহচর্য ব্যতীত ইল্ম পাওয়া যায় না, এমনকি কর্ম্মকারের সাহচর্যে না গেলে কর্ম্মকার হওয়া যায় না, কাঠমিস্ত্রির নিকট না গেলে কাঠমিস্ত্রি হওয়া যায় না ইত্যাদি। হযরত আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেছেন, আল্লাহর এ নিয়মের রহস্য হচ্ছে- মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলা এভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা সাধারণত স্বজাতীয় বিজ্ঞজনের সাহচর্য ও সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না; কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর বিষয়টি ভিন্নরূপ। তাদের বৈশিষ্ট্যাবলী সৃষ্টিগত ও জন্মগত। প্রশিক্ষণগত খুব কমই হয়ে থাকে। যেমন- মাছ সাঁতার শিখেছে জন্মগতভাবে; কিন্তু মানুষ প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যতীত তা করতে পারে না।
বলাবাহুল্য, মুর্শিদে কামিলের উপরিউক্ত শর্তাবলী শাহানশাহে সিরিকোটের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে লক্ষণীয়। আলহামদু লিল্লাহ্। শাহানশাহে সিরিকোট শুধু সুন্নী আক্বীদার পূর্ণাঙ্গ ধারকই ছিলেন না বরং তিনি ও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিদের প্রত্যেকে হলেন সুন্নী আক্বীদার প্রবাদপুরুষ। এমনকি, তাঁদের ‘মুরিদ’ বলতেই খাঁটি সুন্নী আক্বিদাসম্পন্ন- একথা বিশ্বের সর্বত্রই সুপ্রসিদ্ধ। শাহানশাহে সিরিকোট ও তাঁর উত্তরসূরি বুযুর্গণ শুধু দ্বীনী শিক্ষায় সমৃদ্ধই নন বরং উপমহাদেশের অনেক সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বীনী সুন্নী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিষ্ঠাপূর্ণ-প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকও। তাঁদের ঊর্ধ্বতন শায়খ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্ ‘ইল্মে লাদুনী’র ধারক। তাঁর রচিত মজমু‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই রসূল’ (ত্রিশ পারা সম্বলিত বিরাটাকার দুরূদ শরীফ গ্রন্থ) এর জ্বলন্ত স্বাক্ষর। তাঁদের তাক্বওয়া-পরহেয্গারীর পূর্ণাঙ্গতা আজ সর্বজন বিদিত। শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের পূর্ণাঙ্গ সমন্বয় ত্বরীক্বা-ই ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য। দেশে-বিদেশে শতসহস্র মাদরাসা ও খানক্বাহর অনন্য শোভামণ্ডিত অস্তিত্ব ও কর্মতৎপরতা এ বিষয়কেও মধ্যাহ্ণ সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ ত্বরীক্বার হাক্ব্ক্বানিয়াতের অন্যতম সমুজ্জ্বল প্রমাণ হচ্ছে-এ ত্বরীক্বতের ‘শাজরা’ শরীফ। বর্তমান মুর্শিদে বহরক্ব থেকে আরম্ভ করে সর্বোর্ধ্বে শাহানশাহে দু’আলম, নূরে মুজাস্সাম, রহমতে আলম, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত শায়খের উল্লেখ, উচ্চাঙ্গের উর্দু কবিতায় করা হয়েছে। উপমহাদেশে ত্বরীক্বতের ইতিহাসে নিদ্ধির্ধায় শাজরা প্রকাশ এ মহান তরীক্বার আরেক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
বলাবাহুল্য, শাজরা শরীফে উল্লিখিত প্রতিজন শায়খের বেলায়ত ও বুযর্গী আপন আপন যুগে সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমানায়খ-ই ত্বরীক্বত থেকে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ হয়ে শাহে বেলায়ত মাওলা আলী শেরে খোদার মাধ্যমে শাহানশাহে দু’আলম হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যেই ত্বরীক্বতের সিলসিলাহ্ বা পরম্পরা পৌঁছে যায় সেটার বরকত ও কার্যকারিতা যে নিশ্চিতভাবে অব্যাহত থাকে, তাতে সন্দেহের অবকাশই থাকতে পারে না।
শাহানশাহে সিরিকোটের অসাধারণ নবীপ্রেম (ইশক্বে রাসূল) থেকে এসব ক’টি বিষয়ের বাস্তব প্রমাণ মিলে। কোন ওলী যেমন শরীয়তবিরোধী কোন বিষয়কে সহ্য করতে পারেন না, তেমনি তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের শানে বিন্দুমাত্র বেয়াদবী তথা অশালীনতাকেও সহ্য না করা স্বাভাবিক। এ ধরনের ইশক্বে রসূলতো কামিল ওলীর বড় পরিচয়। চট্টগ্রামের বাঁশখালীস্থ শেখের খিলের ঘটনা এর উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
প্রসিদ্ধি আছে যে, শাহানশাহে সিরিকোট আলায়হির রাহমাহ্ উক্ত স্থানে তাঁর নূরানী তাক্বরীরের প্রারম্ভে পবিত্র ক্বোরআনের আয়াত-‘‘ইন্নাল্লা-হা ওয়ামালা-ইকাতাহু- ইয়ুসাল্লূ-না ‘আলান্নাবিয়্যি; ইয়া আইয়্যুহাল্লাযী-না আ-মানূ-সাল্লূ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লিমূ তাস্লী-মা’’ তিলাওয়াত করে উপস্থিত লোকদেরকেও দুরূদ শরীফ পাড়ার প্রতি ইঙ্গিত করছিলেন। তখন কিছু হতভাগা লোক দুরূদ শরীফ না পড়ে তা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলো। এটা দেখে অসাধারণ ইশক্বে রসূলের এ মহান পায়কর অসহনীয় ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির সাথে অবলোকন করেছিলেন যে, এখানে তথা এদেশে এমন লোকও আছে, যারা মুসলমান নামের জঘন্য নবীদ্রোহী। কারণ, যেই আয়াত শরীফে খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফিরিশতাগণ মহান নবীর উপর দুরূদ শরীফ পড়ছেন, আর মু’মিনদেরকেও নির্দেশ দিচ্ছেন তারাও যেন মহান নবীর উপর দুরূদ ও সালাম যথাযথ গুরুত্বের সাথে পাঠ করে, ওই আয়াত শরীফ তথা আল্লাহর প্রিয় কাজ ও তাকীদসহকারে নির্দেশের প্রতি তারা অবজ্ঞা প্রদর্শনের মতো ধৃষ্টতা দেখালো। এহেন জঘন্য বেয়াদবী মুসলমান মাত্রকেই যেখানে ব্যথিত করে এবং তার মধ্যে ক্ষোভের উদ্রেক করে, সেখানে একজন মহান ওলীর পক্ষে তা সহ্য করা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? সুতরাং তিনি তখনই তাঁর পূর্ণ বেলায়তী শক্তি প্রয়োগ করে এর এক যুগান্তকারী প্রতিকারের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি মনের ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে এসে ষোলশহরস্থ নাজির পাড়ায় তাশরীফ আনলেন এবং দায়েম-নাজির জামে মসজিদে বসেই বর্তমান ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, তিনি ইতোপূর্বে এরশাদ করেছিলেন- প্রকৃত সুন্নিয়াত প্রতিষ্ঠার জন্য চাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা)। এর জন্য তিনি স্থানের বৈশিষ্ট্যাবলীও এভাবে বলেছিলেন- মাদ্রাসাটি এমন জায়গায় হবে যা শহরও নয়, গ্রামও নয়, সেখানে মসজিদও থাকবে, পুকুরও থাকবে। (ওয়হ্ মাদরাসা আয়সী জাগাহ্ মে হোগা, জো শহর ভী না হো, গাঁওভী না হো। ওহাঁ মসজিদ ভী হো, তালাব ভী হো।) জামেয়ার বর্তমানকার মনোরম জায়গাটা যেন তিনি তাঁর বেলায়তী দৃষ্টিতে তখনই দেখে চয়ন করে নিয়েছিলেন। সুতরাং তিনি ওইসব বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত স্থান নাযির পাড়ায় এসে ওখানকার ওই জামে মসজিদে বসেই ওই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সূচনা করেছিলেন। ওই প্রথম বৈঠকেই জামেয়া প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করেই শাহানশাহে সিরিকোট প্রশান্ত হয়েছিলেন। তখন যাঁরা হুযূর ক্বেবলার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ও এ যুগান্তকারী খিদমতে অংশগ্রহণের প্রতিশ্র“তি দিয়ে হুযূর ক্বেবলাকে খুশী করেছিলেন তাঁরা কতোই ভাগ্যবান! তাঁরই ইচ্ছা, দো‘আ ও কৃপাদৃষ্টির বরকতে আজ ‘জামেয়া’ আপন মহিমায় তার বরকত দ্বারা গোটা সুন্নী দুনিয়া তথা গোটা দেশ, জাতি ও মুসলিম সমাজকে ধন্য করে আসছে।
মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করে তিনি ক্ষান্ত হননি; বরং এর প্রতি তিনি তাঁর বেলায়তী শক্তিসঞ্জাত পৃষ্ঠপোষকতাকেও অব্যাহত রেখেছেন। তিনি জামেয়া সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী ও নসীহত করে গিয়েছেন তা থেকেও একথার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তবতা তো আছেই। তিনি তাঁর সমস্ত মুরীদকে, বিশেষভাবে, জামেয়ার খিদমতের জন্য তাকিদ দিয়ে গেছেন। খিদমতকারীদেরকে উভয় জাহানের শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাফল্যের প্রতিশ্র“তিরূপী সুসংবাদ দিয়েছেন। পক্ষান্তরে এতে অবহেলা কিংবা এর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের অনিবার্য ক্ষতি সম্পর্কেও সতর্ক করে গেছেন। সর্বোপরি, তাঁর সন্তুষ্টি, ভালবাসা ও কৃপাদৃষ্টি পাওয়ার জন্য জামেয়ার প্রতি সর্বাধিক মনযোগ দেওয়া ও যতœবান হওয়াকে পূর্বশর্ত সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘‘মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদরাসা কো দেখো। মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তো মাদ্রাসা কো মুহাব্বত করো।’’ (আমাকে দেখতে চাইলে মাদ্রাসা কে দেখো, আমাকে ভালভাসলে মাদরাসাকে ভালবাসো।) অন্যান্য নসীহতগুলোও শাজরা শরীফ ইত্যাদিতে সংরক্ষিত আছে; যেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালনীয়। তিনি জামেয়ার জন্য মান্নাত করাকে মান্নতকারীর মনষ্কামনা পূরণের অব্যর্থ উপায় সাব্যস্ত করেছেন, যার বাস্তবতার প্রমাণ আজ ভুরিভুরি। আরো লক্ষ্যণীয় যে, মাদরাসা পরিসর দিন দিন বাড়ছে, সে অনুপাতে ব্যয়ভারও; কিন্তু শাহানশাহে সিরিকোটের বেলায়তী দৃষ্টি ও দো‘আর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনার সুব্যবস্থা অলৌকিকভাবে হয়ে যাচ্ছে। তাই, এ প্রসঙ্গে একথা নিদ্ধির্ধায় বলা যাচ্ছে যে, জামেয়ার-আনজুমান এবং এ মহান তরীক্বতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া এবং এসব দ্বীনী খিদমতে আত্মনিয়োগ করা উভয় জাহানের সাফল্যের নিশ্চিত চাবিকাঠি। ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী আযীযুল হক শেরে বাংলা আলায়হির রাহমাহ্ও নিদ্ধির্ধায় বলেছিলেন- ‘‘দর যমা-নশ মান নাবী-নম মিসলে ঊ- পীরে মগাঁ-।’’ (এ যুগে তাঁর মতো পীরে কামিল আমি আর দেখিনি।) [দিওয়ান-ই আযীয; বাংলা সংস্করণ, পৃ.১৪৬]
পক্ষান্তরে, এ জামেয়ার প্রতি কেউ অসম্মান প্রদর্শন করলে কিংবা উদাসীনতা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন করলে তার দুর্ভোগের কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শাহানশাহে সিরিকোটের সুযোগ্য উত্তরসূরিদের মধ্যেও অকৃত্রিম ইশক্বে রসূলের একই ধরনের ঝলক পরিলক্ষিত হয়। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এক মৌলভী আমাদের আক্বা ও মাওলা, আলিমে মা-কা-না ওয়ামা- ইয়াকূ-ন রসূলে আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইল্মকে অস্বীকার করা এবং সেটার উপর হঠ ধরে থাকার কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় সুন্নী ওলামা-ই কেরামের ফাত্ওয়া মতে কাফির সাব্যস্ত হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে জানার পর বর্তমান হুযূর ক্বেব্লা হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব মুদ্দাজিল্লুহুল আলী পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ওই মুরতাদের প্রতি অসন্তুষ্টি ঘোষণা করেছেন এবং তাকে বয়কট করার জন্য সকল পীরভাই ও মুরীদকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামের প্রকৃত আদর্শ (সুন্নী মতাদর্শ)-কে স্থায়ীভাবে অম্লান রাখার জন্য দক্ষ, মুত্তাক্বী-পরহেযগার, মুনাযির, লেখক, ওয়াইয এবং নিষ্ঠাপূর্ণ ওলামা তৈরী করার বিকল্প নেই। তাই শাহানশাহ্ সিরিকোট বিভিন্নভাবে দ্বীনী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের ঈমান-আক্বিদা ও আমলের হিফাযতের জন্য এবং আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের নিমিত্তে এ খাঁটি তরীক্বার ব্যাপক প্রসার করেন। শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের খিদমত সমান্তরাল গতিতে পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি খানক্বাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এসব প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’র মতো সংস্থা (ট্রাস্ট)।
সর্বোপরি, রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য খলীফা ও উত্তরসূরিদের। বলাবাহুল্য, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে মুর্শিদী সাইয়্যেদী হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ আনজুমানের উন্নয়নকে অব্যাহত রাখেন। জামেয়ার সার্বিক উন্নতি সাধন করেছেন। জামেয়ার লেখাপড়া ও শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নকে অব্যাহত রাখার প্রতি বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন। জামেয়ার মতো ঢাকার বুকে ‘কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা ও হালিশহরে একাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে সারা দেশে এ পর্যন্ত শতাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে-তাঁর এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও খলীফা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মুদ্দাজিল্লুহুল আলীর দো‘আ ও পৃষ্ঠপোষকতার ‘বরকতময় ছোঁয়া’ পেয়ে। এসব প্রতিষ্ঠানও উন্নতির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ষোলশহর আলমগীর খানকাহ্ শরীফ ও বলুয়ারদীঘিপাড়স্থ খানকাহ্ শরীফ ছাড়াও আজ দেশের বহু স্থানে বহু খানক্বাহ্ শরীফ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ও করে যাচ্ছে।
মাদারযাদ ওলী হযরতুল আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নির্দেশে প্রসিদ্ধ ‘গাউসিয়া কমিটি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে দেশের একমাত্র সুন্নী মুখপত্র ‘মাসিক তরজুমান-ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত’।
দ্বীনী-শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত এ তরীক্বার মহান শায়খ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্র ‘ইলমে লাদুনী’ দ্বারা লিখিত ‘মজমু‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই রসূল’কেও অতি যতœসহকারে ছাপিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর সুযোগ্য খলীফা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সংস্করণগুলো প্রকাশ করিয়েছেন হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্। তিনি এ মহান বরকতময় অনন্য গ্রন্থের উর্দু ভাষায় অনুবাদও করিয়েছেন এবং সেটার বঙ্গানুবাদ প্রকাশের জন্য জরুরী হিদায়ত ও দো‘আ করে গেছেন। সুতরাং বর্তমানে হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব ক্বেবলার বরকতময় পৃষ্ঠপোষকতায় সেটার বাংলা উচ্চারণসহ বঙ্গানুবাদও প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত সপ্তম পারা (উচ্চারণসহ বঙ্গানুবাদ) প্রকাশিত হয়েছে।
শাহানশাহে সিরিকোট হলেন নায়েবে গাউসুল ওয়ারা, ইলমে লাদুনীর ধারক, উলূমে ইলাহিয়্যার প্রস্রবণ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমার সুযোগ্য খলিফা। দীর্ঘ আঠার বছর যাবৎ তিনি আপন মুর্শিদে বরহক্ব হযরত চৌহরভীর সান্নিধ্যে র’য়ে এবং তাঁর মাদরাসা (মাদরাসা-ই রহমানিয়া, হরিপুর)-এর খিদমত ও পরবর্তীতে পৃষ্ঠপোষকতা করে বেলায়তের উচ্চাসনে আসীন হয়েছেন। তারপর আপন মুর্শিদের নির্দেশে সুদূর বার্মায় গিয়ে দীর্ঘদিন দ্বীন, মাযহাব ও তরিক্বতের অনন্য খিদমত আন্জাম দেন। এ সফরের ফলে সুদূর বার্মায় যেমন অগণিত বার্মাবাসী এ মহান ওলীর সান্নিধ্য ও এ মহান বরকতমণ্ডিত তরীক্বতে সামিল হবার সুযোগ পান। তেমনি তখনকার সময়ের অনেক বার্মা প্রবাসী বাংলাদেশীও শাহানশাহে সিরিকোটের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হন। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হবার পূর্বেই অগণিত মানুষ শাহানশাহে সিরিকোটের নূরানী পরামর্শক্রমে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রক্ষা পেয়েছিলেন। এরপর এদেশের মানুষ শাহানশাহে সিরিকোটের পদধূলিত অকল্পনীয়ভাবে ধন্য হয়েছে; সুগম হয়েছে সর্বস্তরে সুন্নিয়াত প্রতিষ্ঠার পথ। ইতোপূর্বে শাহানশাহে সিরিকোট আফ্রিকা সফর করেছেন এবং সেখানেও শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের প্রসারে বহু ঐতিহাসিক অবদান রাখেন।
পরিশেষে বলতে হয়- ইসলামের প্রকৃত আদর্শ যেমন আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের মতাদর্শ, তেমনি প্রকৃত ঈমানদার হচ্ছেন এ মতাদর্শেরই অনুসারীরা। অনেক দিন আগে অগণিত আউলিয়া-ই কেরামের শুভাগমনের ফলে এ দেশে ইসলাম প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে এদেশের শতকরা আশিজন মুসলমান। দীর্ঘদিন যাবৎ এদেশের সুন্নী মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা ও আমল নিরাপদ ছিলো; কিন্তু ক্রমশ অইসলামী ও অসুন্নী চক্রগুলোর অশুভ পদচারণা ও নানা পরিকল্পিত অপৎপরতার ফলে এদেশের সুন্নী মুসলমানদের আক্বিদা ও আমল তাদের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে।
বলাবাহুল্য, এর বহুবিদ কারণও রয়েছে। যেমন-
ক. দীর্ঘদিন যাবৎ সুন্নী ওলামা-মাশাইখ এ বৃহত্তম সুন্নী জনগোষ্ঠীকে তাদের ঈমান আক্বিদা সম্পর্কে সচেতন থাকার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে সক্ষম হননি। উল্লেখযোগ্য হারে সুন্নী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। সুন্নী ওলামা-মাশাইখ পরিকল্পিতপন্থায় ব্যাপকভাবে সুন্নী মতাদর্শ প্রচারে সচেষ্ট থাকতে পারেন নি বললেও চলে। দেশের জন সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে সাথে তদনুযায়ী সুন্নিয়াতের প্রচার করা সম্ভব হয়নি।
খ. যেসব সম্মানিত ওলীর মাধ্যমে এদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে ওইসব মহান ওলীর আদর্শকে সংশ্লিষ্ট অনেক এলাকায়ও ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সত্য বলতে কি? সুন্নী সাধারণকে ওলী ভক্তির প্রতি সবসময় উৎসাহিত করা হয়েছে; যার আর্থিক ফলটুকু সংশ্লিষ্টরা ভোগ করেছেন সত্যি; কিন্তু ওই ওলীগণের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দীক্ষাগুলোর চর্চা যথাযথভাবে হয়নি বললেও অত্যুক্তি হবে না। ফলে মানুষের মন ক্রমশ অন্যদিকে ধাবিত হতে থাকে।
গ. ইত্যবসরে অসুন্নী শক্তিগুলো, যেমন দেওবন্দী-ওহাবীরা, মওদূদীপন্থী জামাতীরা, আহলে হাদীস, আহলে ক্বোরআন, কাদিয়ানী ও কোন কোন স্থানে শিয়া মতবাদীরা পরিকল্পিত পন্থায় সুন্নী সমাজে ঢুকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, এখনো কিছু সংখ্যক নিষ্ঠাবান সুন্নী ওলামা-মাশাইখের উপস্থিতি বা প্রচেষ্টার সুবাদে, ক্ষেত্র বিশেষে, সুন্নী ওলামা ও মাযার সংশ্লিষ্টরা আর্থিক এবং ভক্ত ও সমর্থকদের দিক দিয়ে সচ্ছল থাকলেও তাঁদের অবস্থান এবং সামগ্রিকভাবে সুন্নী মুসলমানদের ক্ষেত্রগুলো আশংকাজনকহারে সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আজ অনেক মাযার-দরবারে হয়তো প্রকৃত সুন্নিয়াতের শরীয়ত ও ত্বরীক্বতের চর্চাশূন্য, নতুবা সেগুলো সুন্নী মুসলমানদের হয়ে গেছে ও দ্রুত হাতছাড়া হতে যাচ্ছে।
ঘ. সুন্নী মুসলমানগণ ক্রমশঃ সুন্নিয়াত ভিত্তিক রাজনীতি-বিমুখ হয়ে অসুন্নী কিংবা সুন্নী-বিদ্বেষী রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ওদিকে অসুন্নীরা এবং অইসলামীরা এক্ষেত্রে সোচ্ছার ও সমৃদ্ধ। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, প্রচার মাধ্যম, কর্মসংস্থান এবং অসুন্নী মতবাদগুলোর নানা কৌশলে ব্যাপক প্রচারণা ক্রমশঃ সুন্নীদের স্থানগুলো দখল নিচ্ছে। ফলে অনেক সুন্নী না বুঝে কিংবা বাধ্য হয়ে অথবা অর্থ ও সুবিধা ভোগের লোভে সুন্নী মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এহেন আশংকাময় অবস্থায় সুন্নীয়াতের বিশাল ক্ষেত্রকে আগাছামুক্ত করার উপযুক্ত সময় এসেছে।
এমনি অবস্থায় শাহানশাহে সিরিকোটের দূরদর্শী ও সাহসী পদক্ষেপ ও অবদানগুলো ইসলাম ও সুন্নিয়াতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও কালজয়ী। তাই আর কালবিলম্ব না করে শাহানশাহে সিরিকোটের নিষ্কলুষ বরকতময় ত্বরীক্বত ও অত্যন্ত গঠনমূলক পদক্ষেপগুলোতে সম্পৃক্ত হলেই কিংবা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করলেই একদিকে প্রত্যেকের ঈমান-আক্বীদার হিফাযত কিংবা সুদৃঢ় হবে, অন্যদিকে অসুন্নীদের বিভিন্ন চক্রান্তের দিকে দ্রুত ধাবিত সুন্নী সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। তাই, নিদ্ধির্ধায় বলি- শাহানশাহে সিরিকোট হোন সকল শ্রেণীর সুন্নীদের অন্যতম আদর্শ এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।