ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে তাঁর কবরে ৪০ দিন পর্যন্ত কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা কি?

0

প্রশ্ন করেছেন- মাওলানা আব্দুল করিম, গহিরা, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। =
 প্রশ্ন: আমার মায়ের ইন্তেকালে পর ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে তাঁর কবরে ৪০ দিন পর্যন্ত কুরআন শরীফ তিলাওয়াতের জন্য একজন মাওলানা সাহেব নিযুক্ত করেছি। সময় সাপেক্ষে আমিও মায়ের কবর জিয়ারত করি। দাফনের ৪/৪০ দিন পর্যন্ত কবরে কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য জিকির আযকার বৈধ কি না? মৃত ব্যক্তির নিকট সাওয়াব পৌঁছানো বা আমার মায়ের কবরে সাওয়াব পৌঁছানোর জন্য আমি আর কি কি আমল করতে পারি? জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: মা-বাবাসহ সকল আত্মীয় স্বজনের কবরে সওয়াব ও নেকী পৌঁছানোর জন্য দাফনের পর হতে চার বা চল্লিশ দিন পর্যন্ত ফাতেহা ও তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করা, জিয়ারত করা, চার দিন বা চল্লিশ দিন উপলক্ষে ফাতেহা নেয়াজ ও যিয়ারতের ব্যবস্থা করা অবশ্যই জায়েয ও সওয়াব। এ ব্যাপারে একদা এক সাহাবী হুযূর পুরনুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসূল, মাতা-পিতার তিরোধানের পর তাদের সাথে সদাচরণ করার কোন পন্থা আছে কি? যা করে আমি ধন্য হই! প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন-
نعم اربعة الصلاة عليها والاستغفار لهما وانفاذ عهدهما من بعدهما واكرام صديقهما وصلة الرحم التى لارحم لك الا من قبلهما فهذا الذى بقى من برهما بعد موقتهما [رواه البيهقى] অর্থাৎ হ্যাঁ! চারটি পন্থা রয়েছে তার (ঈসালে সাওয়াবের) জন্য (নফল) নামায পড়া, তাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা, তিরোধানের পর তাঁদের প্রতিশ্রুতি অসিয়ত ইত্যাদি কার্যকর করা এবং তাঁদের বন্ধু মহলের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা; তাদের পক্ষ হতে যারা আত্মীয় হিসেবে সাব্যস্ত তাঁদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। এগুলো তাঁদের মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ভাব বহাল রাখার উত্তম পন্থাসমূহ। [ইমাম বায়হাকী রহ.] প্রিয়নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন- استغفار الولد لابيه بعد الموت من البن অর্থাৎ পিতার তিরোধানের পর সন্তান-সন্ততিগণ তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা (মাতা-পিতার সাথে) সদাচরণ করার অন্তর্ভুক্ত।
অপর এক হাদীসে পাকে বর্ণিত হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله عزوجل ليرفع الدرجة للعبد الصالح فى الجنة فيقول يا رب انى لى هذه فيقول باستغار ولدك لك (رواه احمد)
অর্থাৎ জলীলুল কদর সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা নেক্কার বান্দার জন্য জান্নাতে দরজা এবং মর্তবাকে বুলন্দ করেন। তখন বান্দা বলেন, হে আমার রব! এত উঁচু মর্তবা আমার জন্য কিভাবে হল? তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফার ও ক্ষমা প্রার্থনার কারণে।
[মেশকাত শরীফ, ২০৬ নং হাদীস] عن عبد الله بن عباس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما الميت فى القبر الا كالغريق المتغوث ينتظير دعوةً تلحقه من اب اوام اواخٍ او صديق فاذا الحقته كان احب اليه من الدنيا وما فيها وان الله تعالى ليدخل على اهل القبور من دعاء اهل الارض امثال الجبال وان هدية الاحياء الى الاموات استغفار لهم [رواه البيهقى فى شعب الايمان] অর্থাৎ রইসুল মুফাসসেরীন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কবরে মৃত ব্যক্তির অবস্থা পানিতে ডুবন্ত সাহায্য প্রার্থনকারী ব্যক্তির ন্যায়। (কবরে মৃত ব্যক্তি) দোআ প্রার্থনার অপেক্ষায় থাকে, যা তার নিকট স্বীয় পিতা, মাতা, ভাই এবং বন্ধু-বান্ধব হতে পৌঁছে। যখন দুনিয়ার জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দো‘আ ও ইস্তেগফার মৃত ব্যক্তির নিকট কবরে পৌঁছে, তখন তার কাছে তা দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ থেকে অধিক প্রিয় হয় এবং নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কবরবাসীর নিকট পৃথিবীর জীবিত ব্যক্তিদের দো‘আ ও ইস্তেগফার বিশাল বিশাল পর্বতমালার ন্যায় (সাওয়বের পর্বতগুলো) প্রবেশ করে। আর জীবিত ব্যক্তিদের অন্যতম হাদিয়া মৃত ব্যক্তির জন্য দো‘আ ও ইস্তিগফার। [মিশকাত শরীফ, পৃ. ২০৬] হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো এরশাদ করেছেন যে, اذا تصدق احدكم بصدقة تطوعًا فليجعلها عن ابويه فيكون لهما اجرها ولاينقص من اجرها شيئًا [رواه الطبرانى] অর্থাৎ যখন তোমাদের কেউ নফল সাদক্বাহ্ প্রদান করে, তাহলে এ সাদক্বাহ্ তার পিতা-মাতার পক্ষ থেকে প্রদান করা উচিত। এ সাদক্বাহর সাওয়াব উভয়ের নিকট পৌঁছবে এবং বিন্দুমাত্র তার সাওয়াব হ্রাস পাবে না।’ [তাবরানী] একদা জনৈক সাহাবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে হাজির হয়ে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার মাতা-পিতার জীবদ্দশায় তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতাম, এখন তাঁরা উভয়ই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার কোন পন্থা আছে কি? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করলেন- اِنَّ من البر بعد الموت ان تصلى لهما مع صلوتك وتصوم لهما مع صيامك (رواه دار قطنى) অর্থাৎ মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার পন্থা এ যে, তোমরা নামাযের সাথে তাঁদের জন্যও (কিছু নফল) নামায পড় এবং তোমার রোযার সাথে তাদের জন্যও (কিছু নফল) রোযা রাখা। ‘এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমামে আহলে সুন্নাত আলা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘যদি তুমি সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের জন্য নফল নামায আদায় কর কিংবা রোযা রাখ, তাহলে তাঁদের পক্ষ থেকেও কিছু নফল নামায পড়, নফল রোজা আদায় কর, তবে তাদের নিকট এ সাওয়াব পৌঁছবে। অথবা নামায রোযা ও তোমার সম্পাদিত সকল নেক্কাজের সাওয়াব তাদের নিকট পৌঁছানোর নিয়্যত কর, তবে তাঁদের নিকট এ সাওয়াব (অবশ্যই) পৌছবে, আর তোমার এ সাওয়াব সামান্যও হ্রাস পাবে না।
[ফতোয়া-ই রজভীয়া, ৮ম খন্ড] এভাবে মাতা-পিতার ইন্তিকালের পরও কবর জিয়ারত, নামায, রোযা, হজ্ব ও সাদক্বাহ্ খায়রাত ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং সাওয়াব পৌঁছানো প্রত্যেক সন্তানের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর ছেলে সন্তানের উপর যেসব হক বা কর্তব্য বর্তায় পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে তা নি¤েœ পেশ করা হয়।
১. মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর সর্বপ্রথম, তাঁদের জানাযা প্রস্তুতকরণ, গোসল, নামায, কাফন ও দাফন ইত্যাদি কার্যাদি সম্পন্ন করা। এসব কাজের মধ্যে অতি যতœ সহকারে সুন্নাত ও মুস্তাহাবসমূহ পালন করা, যাতে তাদের জন্য সকল সৌন্দর্য, বরকত ও রহমত লাভ করাই কাক্সিক্ষত হয়। ২.তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, ৩. স্বীয় সাদক্বাহ্-খায়রাত ও নেক কাজসমূহের সাওয়াব তাঁদের নিকট পৌছাতে থাকা। সাধ্যমত এসব পুন্যকাজ অব্যাহত রাখা, স্বীয় নামায, রোযা ও হজ্ব এর সাথে মাতা-পিতার জন্যও এ সমস্ত ইবাদত সম্পাদন করা। ৪. তাঁদের উপর যদি কারো কর্জ থাকে, যথাশীঘ্রই তা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করা। নিজের সামর্থ না থাকলে আত্মীয়-স্বজন বা শুভাকাক্সক্ষীর নিকট থেকে কর্জ পরিশোধ করার জন্য সাহায্য কামনা করা। ৫. যদি তাদের উপর কোন ফরয কাজ অনাদায়ী থেকে যায়, তাহলে সাধ্য মোতাবেক তা পালন করার জন্য চেষ্টা করা। যদি হজ্বব্রত পালন না করে থাকে, তাহলে তাঁদের পক্ষ হয়ে নিজের বা অন্য কারো দ্বারা হজ্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা। যদি তাঁদের উপর যাকাত কিংবা উশর (ফসলের যাকাত) অনাদায়ী থাকে, তাহলে তার ফিদয়াহ্ বা কাফ্ফারা (ক্ষতিপূরণ) আদায় করা, এভাবে তাঁদেরকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করা।
৬. মাতা-পিতা শরীয়তসম্মত কোন অসিয়ত করে থাকলে তা যথাসম্ভব বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে সন্তানের ওপর তা পালন করা কর্তব্য নয়।
৭. তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। সব সময় তাঁদেরকে সম্মান করা।
৮. সম্ভব হলে প্রত্যেক দিন অথবা প্রতি জুমাবার তাদের কবর জিয়ারত করা এবং তথায় এমন স্বরে সূরা ইয়াসীন বা অন্য সূরা পাঠ করা যাতে তারা শুনতে পান এবং এর সাওয়াব তাদের রূহে পৌছানো। তাদের কবরের পাশ দিয়ে গমনকালে সালাম ও ফাতেহা পাঠ না করে অতিক্রম না করা।
৯. কোন সময় অন্য কারো মাতা-পিতাকে অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করার দরুন নিজ মাতাপিতাকে গালি না শুনানো।
১০. ইন্তেকালের পর মাতা-পিতার বড়ই কষ্টের কারণ হয় যখন জীবিত সন্তানগণ পাপ কাজে লিপ্ত হয়। সুতরাং সন্তানগণ যেন কখনো কোন পাপ কাজ করে তাঁদেরকে কষ্ট না দেয়। কারণ, মাতা-পিতার নিকট সন্তান-সন্তুতিদের যাবতীয় নেক কাজের সংবাদ পৌঁছে থাকে। তখন তাঁরা পুলকিত হন। আর যখন তাঁরা সন্তানের কোন পাপ কাজ অবলোকন করেন, তখন তাঁরা ব্যথিত হন এবং দুঃখ পান। কবরের মধ্যে মাতা-পিতাকে কষ্ট প্রদান করা সন্তান-সন্তুতিদের জন্য অমঙ্গল ও নেহায়ত পরিতাপের বিষয়। মৃত্যুর পর মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কিত উল্লিখিত সকল বিধান পবিত্র হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে নেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাদকায় আমাদেরকে এসব নেককাজ পালন করার তাওফীক দিন। আমিন।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •